“নির্বাচনের আগে সবাই ভোট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। আমরা মনে করি না, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কোনো চ্যালেঞ্জ হবে,” বলেন ইসি আনোয়ারুল।
সংগৃহীত
আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা এসেছে প্রধান উপদেষ্টার কাছ থেকে। নির্বাচন কমিশনও বলছে, ভোটের ৫০-৬০ দিন আগে ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তফসিল দেওয়া হবে।
তবে তফসিল দেওয়ার আগে রোডম্যাপ ঘোষণা করবে ইসি এবং তা আসতে পারে এ সপ্তাহেই।
এবারের রোডম্যাপে কী থাকছে, সেই ধারণ দিতে গিয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলছেন, তারা অক্টোবরের মধ্যে ‘মূল প্রস্তুতি’ সেরে ফেলতে চান।
এ সময়সীমার মধ্যে সীমানা পুনর্নির্ধারণ, দল নিবন্ধন, পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংস্কার, আচরণবিধিমালা জারি ও ভোটার তালিকার মতো বিষয় চূড়ান্ত করে ফেলার কথা রোডম্যাপে তুলে ধরা হবে।
নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার
ফেব্রুয়ারির ভোট সামনে রেখে ইসির চ্যালেঞ্জ, ভোট প্রস্তুতি ও কর্মপরিকল্পনা নিয়ে বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথা বলেন আনোয়ারুল ইসলাম।
তিনি বলেন, “ভোটের জন্য আমাদের নির্বাচনি যত কর্ম আছে, সবই পরিকল্পনা অনুযায়ী সম্পন্ন করব। এরমধ্যে মূল কাজগুলো অক্টোবরের মধ্যে হয়ে যাবে।
“অক্টোবরের ভেতরে আমাদের অলমোস্ট প্রস্তুতি হয়ে যাবে এবং নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাব।”
খসড়া আরপিওতে সংজ্ঞা ও অনুচ্ছেদ মিলিয়ে ৪৪টি সংশোধন প্রস্তাব রয়েছে।
বর্তমানে ১২ কোটি ৩৭ লাখের বেশি ভোটার রয়েছেন; বাদ পড়া প্রায় ৪৬ লাখের খসড়া প্রকাশ হয়েছে। ৩১ অগাস্ট চূড়ান্ত হবে এবং বিদ্যমান তালিকা থেকে মৃতদের নাম বাদ দেওয়া হবে।
এ নির্বাচন কমিশনার বলছেন, ৩১ অক্টোবর ভোটারযোগ্য তরুণদেরও জাতীয় নির্বাচনের সুযোগ দিতে সম্পূরক তালিকা হবে। নভেম্বরে চূড়ান্ত হতে পারে। এছাড়া প্রবাসী ভোটারদের জন্য প্রথমবারের মত অনলাইন নিবন্ধন অ্যাপ ও পোস্টাল ব্যালটের বিষয়টি নভেম্বরের মধ্যে শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে।
গুরুত্ব থাকবে আস্থা ফেরানোয়
ভোটের ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে বিএনপি। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ভোটের আগে রাষ্ট্র সংস্কার সম্পন্ন করার দাবি তুলেছে। ভোটের অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়নি, এমন কথাও বলছে তারা।
তবে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে রয়েছে বলে মনে করেন এ নির্বাচন কমিশনার।
তিনি বলছেন, সব দল নির্বাচনমুখী হলেই ভোটের অনুকূল পরিবেশ তৈরি হবে। আবার তফসিল ঘোষণার পর ইসির নিয়ন্ত্রণও বাড়বে।
আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, “আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যেটা রয়েছে, আমাদের বিশ্বাস, যখন আমরা সবাই নির্বাচনমুখী হব, তখন যারা নির্বাচনে অংশ নেবেন, তারাও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন। তখন স্বাভাবিকভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি দৃশ্যমান হবে।”
ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ভোটের তারিখ বিবেচনায় ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তফসিলের কথাও বলেছে ইসি। তফসিল থেকে ভোটের পরের ১৫ দিন পর্যন্ত সরকারি কর্মকর্তাদের বদলি কিংবা নির্বাচনি পরিবেশ বজায়ে ইসির কর্তৃত্ব থাকবে।
“নির্বাচনের আগে সবাই ভোট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং পারস্পরিক সহযোগিতায় উন্নতি ঘটে। আমরা মনে করি না, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি চ্যালেঞ্জ হবে।”
এবার প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটাধিকারে পোস্টাল ব্যালট পদ্ধতি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়েছে, যেটি বাস্তবায়ন করাটাও চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন কেউ কেউ।
তবে আনোয়ারুল ইসলাম বলছেন, তারা যেসব উদ্যোগ নিয়েছেন, তাতে প্রবাসী ভোটারদের কাছ থেকে ‘ভালো সাড়া’ পাবেন বলে আশা করছেন।
“আমি মনে করি, নির্বাচনের বিষয়ে জনগণের মধ্যে যে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয়েছে, সেটাই মৌলিক চ্যালেঞ্জ। এটা অকপটে আমরা স্বীকার করি। এটাকে ইতিবাচক করাটাই আমাদের প্রাথমিক কাজ। সেজন্য উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচির পাশাপাশি অংশীজনদের সঙ্গে বসবো। আশা করি, অতীতে যারা ভোট দিতে পারেননি; তারা উৎসাহ উদ্দীপনায় ভোট দিতে আসবেন।”
রিটার্নিং কর্মকর্তা ও ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়ে পরিকল্পনা
২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের ভোটের অনিয়ম তদন্তে একটি কমিশনের কাজ চলছে। আলাদাবে তিন নির্বাচনে সম্পৃক্তদের বিষয়ে মামলাও হয়েছে। ইতোমধ্যে তিন নির্বাচনের ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা, নির্বাহী হাকিমদের তালিকাও সংগ্রহ করছে পুলিশের একটি সংস্থা। নির্বাচন কমিশনও বলছে, অনিয়মে সম্পৃক্ত ছিল এমন কর্মকর্তাদের এবার দায়িত্বে রাখবে না।
প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসার মিলিয়ে প্রায় সোয়া নয় লাখের মতো লোকবল দরকার হতে পারে আগামী নির্বাচনে।
সরকারি বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তা, শিক্ষক, ব্যাংক কর্মকর্তারা দায়িত্বে থাকেন ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা হিসেবে।
এমন পরিস্থিতিতে লোকবল ব্যবস্থাপনার চ্যালেঞ্জ রয়েছে কিনা জানতে চাইলে এ নির্বাচন কমিশনার বলেন, “বাস্তবতা হলো, এত লোকবল পরিবর্তন করতে হবে, বিষয়টি এমন নয়। অধিকাংশই তো ভালো লোক, কিছু লোক বিতর্কিত হতে পারে। সিদ্ধান্ত আছে, যারা ভোটের অনিয়ম-দুর্নীতিতে ছিল, তাদেরকে আমরা ভোটে রাখব না, নতুন যারা আছেন, তাদেরকে নিয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাব।
“তফসিল ঘোষণার পর রিটার্নিং অফিসার কারা হবেন, সে বিষয়ে আদেশ জারি হবে। ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাও চূড়ান্ত হবে। তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে যেন পরিপত্রগুলো ইস্যু করতে পারি, সে প্রস্তুতি আছে।”
যেসব অগ্রগতির কথা শোনালেন ইসি আনোয়ারুল
>> সীমানা নির্ধারণ: ৩০০ আসনের খসড়া প্রকাশ হয়েছে। ১০ অগাস্টের মধ্যে ৮২টি আসনে ১৫৯৬টি দাবি আপত্তি আবেদন জমা পড়ে। শিগগির শুনানির সময় নির্ধারণ করা হবে।
>> দল নিবন্ধন: বাছাই শেষে ১২১টি আবেদন বাদ। ২২ টি দলের অস্তিত্ব ও কার্যকারিতার বিষয়ে মাঠ পর্যায়ে তদন্ত চলছে।
>> নির্বাচন পর্যবেক্ষক: অন্তত ৩১৮টি সংস্থার আবেদন বাছাই চলছে।
>> গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ: ছোট-বড় মিলিয়ে ৪৪টি সংস্কার চূড়ান্ত পর্যায়ে। এগুলো আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। দল ও আচরণবিধি অনুমোদন পেয়েছে। আরপিও সংস্কার হলে জারি হবে।
>> প্রবাসীদের জন্য আইটি সাপোর্টেড নিবন্ধন ও পোস্টাল ব্যালট পদ্ধতি প্রক্রিয়াধীন, চূড়ান্ত হলে পদ্ধতি নিয়ে প্রচারণা।
>> ভোটার তালিকা: হালনাগাদের খসড়া প্রকাশ। চূড়ান্ত হবে ৩১ অগাস্ট। সম্পূরক তালিকা নভেম্বরে।
>> নির্বাচনী সরঞ্জাম কেনাকাটা: সেপ্টেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন করার পরিকল্পনা।
>> রোডম্যাপ প্রকাশ: খসড়া কর্মপরিকল্পনা পরিমার্জন চলছে; এটা চূড়ান্তের পথে। সংলাপ, মত বিনিময়, মিটিং, ব্রিফিং, প্রশিক্ষণ, মুদ্রণ, বাজেট বরাদ্দ, আইটিভিত্তিক প্রস্তুতি, প্রচারণা, সমন্বয় সেল, আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক থেকে যাবতীয় কর্মপরিকল্পনা মাথায় রেখে উল্লেখযোগ্য খাত ও বাস্তবায়নসূচি পর্যালোচনা হচ্ছে।
‘আস্থা বাড়াবে’ রোডম্যাপ
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য আব্দুল আলীম বলছেন, কোন কাজ কখন শেষ করবে, রোডম্যাপে সাধারণত সেই টাইমলাইন থাকে। ইসির রোডম্যাপে এখন থেকে নির্বাচনের তারিখ পর্যন্ত যে কাজগুলো হবে, তার তালিকা এবং কবে শেষ হবে এরকম টাইমফ্রেম থাকবে।
তিনি বলেন, “রোডম্যাপ ঘোষণা খুবই ইতিবাচক। রোডম্যাপ হলে মানুষ জানবে, কখন কোন তারিখে কাজটা হবে; মানুষের কাছে ম্যাসেজ যাবে। এতে এক ধরনের পজেটিভ ধারণা হবে।
“কমিশনও নিজ থেকে চাপ অনুভব করবে। তারা ভাববে, ‘জনগণের কাছে রোডম্যাপ দিয়েছি, এ অনুযায়ী কাজ করতে হবে’।”
এ নির্বাচন বিশ্লেষক বলেন, “নির্বাচনের যারা অংশীজন, তারাও আস্থাশীল হবে।”
আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন উন্নতির দিকে জানিয়ে আব্দুল আলীম বলেন, “তফসিল ঘোষণার পর ইসির দিকে সবার নজর থাকবে। সরকারের সহায়তার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি এবং তফসিলের পরে দলগুলোর দাবি আমলে নিয়ে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে।”