“এখন সরকারের ওপরে বড় চাপ বাড়বে। সরকার এখন কি সিদ্ধান্ত নেয়, তার ওপর নির্ভর করবে। সরকারকে খুব সাবধানে সিদ্ধান্ত নিতে হবে,” বলেন অধ্যাপক নিজামউদ্দিন।
সংগৃহিত
যে প্রক্রিয়ায় জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ জারি এবং তার ভিত্তিতে গণভোট আয়োজনের সুপারিশ করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন, তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য তৈরি হয়েছে।
পাশাপাশি সনদ বাস্তবায়ন আদেশ ও গণভোটের আইনি ভিত্তি নিয়ে ভিন্নমত দিচ্ছেন আইন বিশেষজ্ঞরা।
রাষ্ট্রপতি, নাকি প্রধান উপদেষ্টা এই আদেশ জারি করবেন, তা নিয়ে যেমন রাজনৈতিক মতবিরোধ দেখা যাচ্ছে, তেমনি বর্তমান আইনি কাঠামোয় তার ভিত্তি না থাকার কথাও আসছে।
সংবিধানে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি করে গণভোট আয়োজনের বিধান না থাকলেও সেটি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতৈক্য আছে। আবার গণভোট আয়োজনের সময় নিয়ে আছে বিভক্তি।
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের খসড়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্নমত বা ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বাদ দেওয়ার তীব্র বিরোধিতা করেছে বিএনপি; দলটি বলছে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তাদের সঙ্গে ‘প্রতারণা’ করেছে।
নিজেদের নোট অব ডিসেন্ট বাদ পড়লেও ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্তের প্রতি আস্থা রাখছে জামায়াতে ইসলামী; আর কমিশনের উদ্যোগকে অনেকটা ইতিবাচক হিসেবে নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ ঘোষণার দাবি জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।
সংবিধানে না থাকলেও ‘গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রকাশিত জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা ও অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে’ এই জারি করার কথা বলা হয়েছে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের খসড়ায়।
সেখানে বলা হয়েছে, “যেহেতু উক্ত গণভোট অনুষ্ঠানের পূর্বে জনগণের জ্ঞাতার্থে এবং উক্ত সাংবিধানিক পরিষদের দায়িত্ব সম্পাদনের সুবিধার্থে জুলাই জাতীয় সনদে অন্তর্ভুক্ত প্রস্তাবসমূহের ভিত্তিতে সরকার কর্তৃক প্রণীত একটি খসড়া বিল গণভোটে উপস্থাপন করা প্রয়োজন; এবং যেহেতু উপরে বর্ণিত মতে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ বাস্তবায়ন সম্পন্ন করিবার জন্য একটি আনুষ্ঠানিক আদেশ জারি করা একান্ত প্রয়োজন, সেহেতু সরকার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রকাশিত জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা ও অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে এই আদেশ জারি করিল।”
তবে, আইনি প্রক্রিয়ায় এমন সুযোগ না থাকার কথা বলছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম।
ফরাসি বিপ্লবের পর রাজতন্ত্র বিলোপ হয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গে টেনে সাংবিধানিক আইনের এই বিশেষজ্ঞ বলেন, “গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে সঙ্গেতো সংবিধান বাতিল হয়ে যায় না। গণঅভ্যুত্থান হলে সরকার পতন হয়। কিন্তু দেশে আইন-কানুন যা, যেখানে যেটা আছে, সেখানে তো সেটাই চলে আসছে।
“যখন একটা বিপ্লব হয়, বিপ্লবের পরে তখন দেশের সমস্ত আইন কানুন যদি মনে হয় যে বাতিল হওয়া দরকার, সেগুলো সমস্ত বাতিল হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এটাকে তো আর বিপ্লব বলা হচ্ছে না।”
রাষ্ট্রপতি, নাকি প্রধান উপদেষ্টা আদেশ জারি করবেন, এমন বিতর্কের প্রেক্ষাপট ধরে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “আসলে এখন যে পদ্ধতিতে সরকার চলছে, তা সাংবিধানিকভাবে ঠিক গ্রহণযোগ্য না। সংবিধানের আলোকেতো আর এই সরকার গঠিত হয়নি। নির্বাহী আদেশে তো কোনো আইন হয় না।
“রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারি করতে পারেন। এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যিনি প্রধান আছেন, তিনি কোনো রকম ফরমান চালু করার কোনো বিধান আসলে আমাদের দেশে নাই। যে সামরিক প্রশাসক থাকলে ফরমান চালু করার একটা বিধান থাকে তখন, যা অতীতে হয়েছে। সে ফরমান তো এখন আমাদের সংবিধান স্বীকার করে না।”
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারির কথা প্রস্তাবে বলেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এটি ‘সাংবিধানিক আদেশ’ হবে কি-না, মঙ্গলবার ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজের কাছে জানতে চেয়েছিলেন এক সাংবাদিক।
উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “আমরা যেটা বলেছি সেটা হচ্ছে যে, এই আদেশটি সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হবে এবং এটা একটা সুস্পষ্ট সুনির্দিষ্ট বিষয় আছে। সেটি হচ্ছে, জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ। ফলে এটাকে সামগ্রিকভাবে দেখার সুযোগ নেই, লিমিটেডভাবেও দেখার সুযোগ নেই। প্রত্যেকটা বিষয়, নিঃসন্দেহে আমরা অতীত অভিজ্ঞতাকে ধার করব, সাংবিধানিক বৈশ্বিক ইতিহাস দেখব।
“কিন্তু প্রত্যেকটা রাজনৈতিক পরিস্থিতির একটা অনন্যতা আছে, সেটা আমাদেরকে বিবেচনা করতে হবে। আমরা এখন যে অবস্থায় আছি, সেটা এক ধরনের ‘স্টেট অব এক্সেপশন’। এটা আমাদের বিবেচনায় রেখেই অগ্রসর হতে হবে। সবকিছুই পুরনো বাক্সে ঢোকানো যাবে না। কিছু কিছু জিনিস সম্ভবত বাক্সের বাইরেও থাকবে।”
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আদেশ জারির ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্নকারীদের সমালোচনা করে জামায়াতে ইসলামীর আইনজীবী শিশির মনির বলেন, “সরকারের যদি আদেশ জারি করার ক্ষমতা না থাকে, তাহলে কি রাষ্ট্রপতির আছে? রাষ্ট্রপতির আদেশ জারি করার ক্ষমতা কোন আইনে পাবেন? কোন জায়গায় বলা আছে যে, রাষ্ট্রপতি সাহেব আদেশ জারি করতে পারবেন?
“এই রকম একটি অভ্যুত্থানের পর ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) আদেশ’, এটিতো সরকারই জারি করবেন। এটি আগের সরকারের রাষ্ট্রপতি কী করে জারি করবেন? আগের সরকারের রাষ্ট্রপতির কি ক্ষমতা আছে, গণঅভ্যুত্থানের ফলে? তিনিতো সেই রাষ্ট্রপতি যিনি আগে থেকে আছেন। সে রাষ্ট্রপতি কীভাবে গণঅভ্যুত্থানের চেতনা ধারণ করে একটা আদেশ জারি করবেন। এবং এই আদেশটা জারি করা হচ্ছে, জনগণের ‘কনস্টিটিউয়েন্ট পাওয়ার’ বলে যে আদেশ জারি হবে, সেটা সরকারকেই জারি করতে হবে। রাষ্ট্রপতি জারি করার কোনো এখতিয়ার থাকবে না।”
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশমালা সরকারপ্রধানের কাছে হস্তান্তরের পর মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে আসেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ।
কোথায় কার রাজনৈতিক অবস্থান
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে মঙ্গলবার সুপারিশমালা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে হস্তান্তর করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সেখানে সাংবিধানিক আদেশ জারি করে গণভোটের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের দিন বা আগে এই গণভোট হওয়ার কথা বলা হয়েছে সুপারিশে।
সুপারিশ বাস্তবায়ন ও আইনি ভিত্তি দিতে দুটি বিকল্প পদ্ধতি বাতলে দিয়েছে ঐকমত্য কমিশন। এর মধ্যে আছে সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার প্রণীত একটি পূর্ণাঙ্গ খসড়া বিল গণভোটে উপস্থাপন।
এছাড়া জাতীয় সংসদ গঠিত হওয়ার পাশাপাশি একইসঙ্গে একটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের সুপারিশ এসেছে, যা সংবিধান সংস্কার বিষয়ে গাঠনিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে।
সংবিধান সংস্কার পরিষদ প্রথম অধিবেশন শুরুর তারিখ হতে ২৭০ পঞ্জিকা দিবসের মধ্যে যদি সংস্কার সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে গণভোটে অনুমোদিত সংবিধান সংস্কার বিলটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে।
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন প্রশ্নে দলগুলোর মধ্যে মোটা দাগে দুই ধরনের বিরোধ তৈরি হয়েছে। প্রথমত, সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া; দ্বিতীয়ত হল, গণভোটের দিনক্ষণ।
বিএনপিসহ কয়েকটি দল চায়, জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে হোক। আর জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পূর্ণ ভার থাকুক নির্বাচিত সংসদের ওপর।
অন্যদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দল দাবি তুলেছে, নভেম্বরেই গণভোট আয়োজন করতে হবে। আর জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আদেশ আসতে হবে প্রধান উপদেষ্টার হাত ধরে।
বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি বলেছে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদ বাস্তবায়নের যে সুপারিশমালা সরকারের কাছে জমা দিয়েছে, তা ‘অগ্রহণযোগ্য’।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় বিভিন্ন প্রস্তাবে যেসব নোট অব ডিসেন্ট দেওয়া হয়েছে, তা আদেশের তফসিলে না রাখার তীব্র সমালোচনা করেছে দলটি।
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি দেওয়ার জন্য জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন তাদের সুপারিশ সরকারের কাছে পেশ করেছে। সেখানে যে সকল বিষয়ে ভিন্নমত বা নোট ডিসেন্টসহ ঐকমত্য হয়েছে, তার উল্লেখ না রেখে দীর্ঘ আলোচনায় যেসব প্রসঙ্গ আলোচনা আসেনি, তা অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের অন্য সকল সুপারিশ অগ্রহণযোগ্য বিধায় আমরা একমত হতে পারছি না।
“আমরা অত্যন্ত দুঃখের সাথে লক্ষ্য করেছি যে, এই সকল সুপারিশ কেবল জাতিকে বিভক্ত করবে, ঐক্যের বদলে অনৈক্য সৃষ্টি করবে। মনগড়া যে কোনো সংস্কার প্রস্তাব গ্রহণ করলে জাতীয় জীবনে দীর্ঘ মেয়াদে অকল্যাণ ডেকে নিয়ে আসতে পারে।”
১৭ অক্টোবর স্বাক্ষরিত জুলাই জাতীয় সনদ-বহির্ভূত অনেক কিছু খসড়া আদেশে যুক্ত করা হয়েছে বলে মন্তব্য করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ঐক্যের বদলে অনৈক্য তৈরির প্রচেষ্টা চালিয়েছে ঐকমত্য কমিশন।
বর্তমানে গণভোট আয়োজনের সংবিধানিক পথ না থাকার কথা তুলে ধরে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন বলেন, “জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে কেবল জাতীয় সংসদ গঠিত হওয়ার কথা। সংবিধান সংস্কারের কথা না। নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক ম্যান্ডেট হচ্ছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আর রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আয়োজন। হ্যাঁ, জুলাই জাতীয় সনদ গণভোটের মাধ্যমে যদি জনগণের ম্যান্ডেট পায় তাহলে সে অনুযায়ী সংবিধান পরিষদ গঠন হতে পারে। কিন্তু জুলাই জাতীয় সনদ গণভোটে যাবে যেভাবে স্বাক্ষরিত হয়েছে, সেভাবে।”
সংসদের নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষে পিআরের সংখ্যানুপাতের (পিআর) বিষয়টিও ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই সনদে আসেনি দাবি করে তিনি বলেন, “এখানে বলা হয়েছে, নিম্নকক্ষের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতিক হারে উচ্চকক্ষ গঠিত হবে। এই রকম কিছু তো আলোচনা বা সিদ্ধান্ত হয়নি। এখানে পিআর এর ভিত্তিতে উচ্চকক্ষ গঠনের কথা বলে দিয়ে তারা নাকি এটা গণভোটে পাঠাবে। এভাবে তো সিদ্ধান্ত হয়নি।”
“আরো একটি আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে তারা ২৭০ দিন সময় নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এই সময়ের মধ্যে সংস্কার প্রস্তাবগুলো গৃহিত না হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে সংযুক্ত হবে। এটা একটা হাস্যকর ব্যাপার। অটোপাসের মতো কোনো বিষয় সংবিধানে থাকতে পারে না। এগুলো কীভাবে সুপারিশে এল আমি জানি না।”
তবে, নোট অব ডিসেন্টগুলো খসড়া আদেশ থেকে বাদ দেওয়াটাকে স্বাভাবিক হিসেবে মানছেন জামায়াতের আইনজীবী শিশির মনির।
তিনি বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, “ভিন্নমতসহ গণভোট হবে কেন? ভিন্নমতসহ যারা গণভোটে পাঠাতে চান, তারাতো শেষ পর্যন্ত সংস্কার প্রক্রিয়াটাকে অস্বীকার করছেন। ভিন্নমত দেওয়া হয়েছে জাতীয় সাংবিধানিক পরিষদে, ভিন্নমত এসেছে উচ্চকক্ষ গঠনে পিআর-এর ব্যাপারে, ভিন্নমত হয়েছে এক ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান হতে পারবেন, এই বিষয়ে।”
“জামায়াতে ইসলামীও ভিন্নমত দিয়েছে কয়েকটি বিষয়ে। আমরা যেগুলোতে ভিন্নমত দিয়েছি, অন্যরা যেগুলোতে ভিন্নমত দিয়েছে, সব ভিন্নমত উঠিয়ে, ঐকমত্য কমিশন তারা ‘রুলিংয়ের’ মাধ্যমে পাঠিয়েছে গণভোটের জন্য। এটিই প্রস্তাব করেছে।”
তিনি বলেন, “এ সমস্ত বিষয় নিয়ে আমরা যে কথা বলতে চেয়েছি, সেটি হল, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য যে প্রস্তাবটা দিয়েছে, এই প্রস্তাবটা যদি পুরোটাসহ বাস্তবায়িত না হয়, সরকার আদেশ জারি না করে, কিংবা পরবর্তী গণভোটে এগুলোকে অনুমোদন করা না হয়, তাহলে সংস্কার প্রক্রিয়া করা আর না করার মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না।”
শিশির মনির বলেন, “একটা সংস্কার প্রস্তাবের সঙ্গে আপনি একমত না-ও হতে পারেন, জনগণতো একমত হতে পারে, মানুষতো একমত হতে পারে। তাহলে সেই জায়গায় কেন এটিকে ‘অ্যালাউ’ করা হবে না। এজন্য আমরা মনে করি, সরকারই এই আদেশ জারি করতে হবে। সরকারেরই এখতিয়ার আছে, সরকারই গণঅভ্যুত্থানের সরকার, তারা এই আদেশ জারি করে এটা যথাযথ আদেশ হবে।”
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া কিংবা গণভোট নিয়ে ‘খুব দ্রুত’ সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলেছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।
পিরোজপুরে এক অনুষ্ঠানে এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ।
এদিকে শুক্রবারও পিরোজপুরে এক অনুষ্ঠানে এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ দাবি করেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোটের পক্ষে সরাসরি আদেশ জারি করতে হবে।
তিনি বলেন, “গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য অবশ্যই নির্বাচন হতে হবে। তবে এর আগে গণভোটের পক্ষে সরাসরি আদেশ জারি করতে হবে এবং সেটা আওয়ামী লীগের মনোনীত রাষ্ট্রপতি নয় বরং প্রধান উপদেষ্টাকে এ আদেশ জারি করতে হবে।
গণভোটের বিধান, যা বলছেন আইনজ্ঞ
সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে গণভোট আয়োজনের যে বিধান ছিল, তা ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাতিল করেছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার।
২০২৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর এক রায়ে পঞ্চদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ও গণভোটের বিধান বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে হাই কোর্ট। এর ফলে গণভোট বিষয়ক বিধান স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে পুনঃপ্রতিস্থাপিত হয়ে গেছে বলে মনে করছেন আইনজীবীরা।
সেটি সংবিধানে পুনঃপ্রতিস্থাপিত হলেও সংবিধান সংশোধনী বিল আকারে সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে পাস এবং রাষ্ট্রপতির কাছে যাওয়ার আগে কোনো বিষয়ে গণভোটের আয়োজনের বিধান সংবিধানে না থাকার কথা বলছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম।
তিনি বলেন, “জুলাই সনদকে সাংবিধানিক রূপরেখার মধ্যে আনতে চাচ্ছে, কিন্তু সংবিধানে বলা আছে, সংবিধানের মধ্যে যদি কোনো পরিবর্তন করতে হয়, তবে সংসদ থাকতে হবে, সংসদ থাকাবস্থায় দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রয়োজন হবে।
“দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেয়, তখন সেটা বিল আকারে রাষ্ট্রপতিরে কাছে পাঠাতে হবে এবং রাষ্টপতিকে পাঠানোর সাথে সাথে এটা গণভোটে পাঠাতে হয়। গণভোটের প্রশ্নটা তখনই আসে, যখন একটা সংসদ থাকে এবং সংসদ সংখ্যাগরিষ্ঠ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বর্তমানে সংসদও নেই, দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রশ্নই নেই, বিল আকারে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর কোনো প্রশ্নও নেই।”
এখন গণভোট অনুষ্ঠিত হলে তার কোনো ‘কার্যকারিতাতো নাই’ মন্তব্য করে আহসানুল করিম বলেন, “তারপর কি হবে? তার পরেতো আবার সংসদে যেতে হবে। সংসদকে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিতে হবে।
“যদি সংসদ তখন বলে, এটার পরিবর্তন আমি চাই না, চাইতেওতো পারে। তারওতো এখতিয়ার আছে। আমি এটা গণভোটে পাঠাব না, সেটাও তো হতে পারে। অথবা পরবর্তীতে আবার যদি গণভোটে পাঠানোর প্রয়োজন হয়, তখন এই প্রথম গণভোটটা অযথা এবং পয়সা নষ্ট করে কেন করবে? যা অকার্যকর।”
পঞ্চদশ সংশোধনীর আগে সংবিধানের ১৪২ নম্বর অনুচ্ছেদে ছিল, “(১) এই সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও (ক) সংসদের আইন-দ্বারা এই সংবিধানের কোন বিধান সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন বা রহিতকরণর দ্বারা সংশোধিত হইতে পারিবে:
“তবে শর্ত থাকে যে, (অ) অনুরূপ সংশোধনীর জন্য আনীত কোন বিলের সম্পূর্ণ শিরনামায় এই সংবিধানের কোন বিধান সংশোধন করা হইবে বলিয়া স্পষ্টরূপে উল্লেখ না থাকিলে বিলটি বিবেচনার জন্য গ্রহণ করা যাইবে না; (আ) সংসদের মোট সদস্য-সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে গৃহীত না হইলে অনুরূপ কোন বিলে সম্মতিদানের জন্য তাহা রাষ্ট্রপতির নিকট উপস্থাপিত হইবে না।”
এরপর বলা ছিল, “(১ক) (১) দফায় যাহা বলা হইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও এই সংবিধানে প্রস্তাবনার অথবা ৮, ৪৮ বা ৫৬ অনুচ্ছেদ অথবা এই অনুচ্ছেদের কোন বিধানাবলীর সংশোধনের ব্যবস্থা রহিয়াছে এইরূপ কোন বিল উপরি-উক্ত উপায়ে গৃহীত হইবার পর সম্মতির জন্য রাষ্ট্রপতির নিকট উপস্থাপিত হইলে উপস্থাপনের সাত দিনের মধ্যে তিনি বিলটিতে সম্মতিদান করিবেন কি করিবেন না এই প্রশ্নটি গণ-ভোটে প্রেরণের ব্যবস্থা করিবেন।
“(১খ) এই অনুচ্ছেদের অধীন গণ-ভোট সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতকৃত ভোটার তালিকাভুক্ত ব্যক্তিগণের মধ্যে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক আইনের দ্বারা নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে ও পদ্ধতিতে পরিচালিত হইবে।
“(১গ) এই অনুচ্ছেদের অধীন কোন বিল সম্পর্কে পরিচালিত গণ-ভোটের ফলাফল যেদিন ঘোষিত হয় সেইদিন: (অ) প্রদত্ত সমুদয় ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট উক্ত বিলে সম্মতিদানের পক্ষে প্রদান করা হইয়া থাকিলে, রাষ্ট্রপতি বিলটিতে সম্মতিদান করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে, অথবা
“(আ) প্রদত্ত সমুদয় ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট উক্ত বিলে সম্মতিদানের বিলটিতে সম্মতিদানে পক্ষে প্রদান করা না হইয়া থাকিলে, রাষ্ট্রপতি বিরত রহিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে।
“(১ঘ) (১গ) দফার কোন কিছুই মন্ত্রিসভা বা সংসদের উপর আস্থা বা অনাস্থা বলিয়া গণ্য হইবে না। (২) এই অনুচ্ছেদের অধীন প্রণীত কোন সংশোধনের ক্ষেত্রে ২৬ অনুচ্ছেদের কোন কিছুই প্রযোজ্য হইবে না।”
অতীতের তিন গণভোট
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের মানুষের প্রথম গণভোটের অভিজ্ঞতা হয়েছিল ৪৮ বছর আগে; ১৯৭৭ সালে ৩০ মে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই তার নীতি ও কাজের প্রতি আস্থা যাচাইয়ে সেই গণভোট হয়। গোপন ব্যালটের মাধ্যমে এ প্রশ্নে আস্থা ও অনাস্থা প্রকাশের ক্ষমতা দেওয়া হয় ভোটারদের।
এরপর গণভোটের পর ১৯৮৫ সালে একই ধরনের আস্থা-অনাস্থার ভোট নেন সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। ১৯৯১ সালে খালেদা সরকারের সময়ে আরেকটি গণভোট হয়েছিল দ্বাদশ সংশোধনীর উপর মানুষের সমর্থন আদায়ে।
সংবিধান স্থগিত থাকার মধ্যে রাষ্ট্রপতির আদেশে প্রথম ও দ্বিতীয় গণভোট হওয়ার তথ্য দেন আইনজীবী আহসানুল করিম। আর ১৯৯১ সালে গণভোট হয়েছিল ‘গণভোট আইন’-এর মাধ্যমে।
‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনার অথবা ৮, ৪৮, ৫৬, ৫৮, ৮০, ৯২ক বা ১৪২ অনুচ্ছেদ সংশোধনের ব্যবস্থা করিয়া কোন বিল উক্ত সংবিধানের ১৪২(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদে গৃহীত হইবার পর উহাতে রাষ্ট্রপতি সম্মতিদান করিবেন কি করিবেন না এই প্রশ্নটি যাচাইয়ের জন্য গণভোটের বিধান’ প্রণয়নের জন্য ওই আইনটি করা হয়েছিল।
আহসানুল করিম বলেন, “‘প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডার’ যখন হয়েছিল, তখনতো অন্য বিষয় ছিল। এখনতো সেই রকম হতে পারে না। এখনতো কোনো পরিষদ নেই, গণপরিষদ নেয়। এখন আমাদের সংবিধান আছে। যখন ওইগুলো করা হয়েছিল তখন সংবিধান ছিল না। ১৯৭৮ এবং ১৯৮৫ সালে যখন গণভোট হয়েছিল, তখন সংবিধান স্থগিত ছিল।
“তখন সংবিধান যদি স্থগিত না থাকত, তখন গণভোট হতে পারত না। তখন গণভোটের বিধান সংবিধানে ছিল, যেহেতু সংবিধান তখন স্থগিত অবস্থায় ছিল, তখন সেটা সম্ভব হয়েছিল।”
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে কমিশনের সদস্যরা।
‘নোট অব ডিসেন্ট’ কেন বাদ?
জুলাই সনদে সংস্কারের ৮৪টি প্রস্তাব রয়েছে, যার মধ্যে সংবিধান সংশোধন করতে হবে এমন বিষয় ৪৮টি। এর ৬১টিতে কোনো না কোনো দলের নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে। কয়েকটি সংস্কার প্রস্তাবের একাধিক ধাপ রয়েছে। বিভিন্ন ধাপসহ হিসাব করলে, নোট অব ডিসেন্টের সংখ্যা শতাধিক।
সবচেয়ে বেশি নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে বামপন্থি দলগুলো। নয়টি মৌলিক সংস্কারসহ ১৫ সংস্কারে বিএনপি ভিন্নমত জানিয়েছে। জামায়াত সাতটি এবং এনসিপি দুটি সংস্কার প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে।
সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন হবে, এমন ৪৮টি বিষয় ‘তফসিল-১’ হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করে জুলাই সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশের খসড়া সরকারকে দিয়েছে ঐকমত্য কমিশন। কিন্তু সেই তফসিলে কোনো দলেরই নোট অব ডিসেন্ট রাখা হয়নি।
নোট অব ডিসেন্ট চূড়ান্ত সুপারিশে না রাখার বিতর্কের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “ওখানে সিদ্ধান্তটা উত্থাপন করা হয়েছে। যে ‘ওভারহোয়েলমিং মেজরিটি’ পেয়ে এই সিদ্ধান্তটা। তার মধ্যে কিছু দল আছে যারা তাদের দ্বিমত পোষণ করেছেন যেগুলো সনদে লিপিবদ্ধ আছে।”
তিনি বলেন, এ সিদ্ধান্ত যাবে জনগণের কাছে। এখন সিদ্ধান্তের বিষয়ে জনগণের মতামত নেওয়া হবে।
“সংবিধান সংশোধন, সংবিধান তো জনগণের অভিপ্রায়। আমরা মনে করি, এটা অহেতুক বিতর্ক। রাজনৈতিক দলগুলো সংখ্যা গরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে ঐকমত্যে পৌঁছল এবং জনগণের কাছে গেল। এখন যদি জনগণ ইতিবাচক সিদ্ধান্ত দেয়, তাহলে গ্রহণ করা, সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করা বাধ্যতামূলক।
“এটা জনগণের অভিপ্রায়। সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে আছে। এটা অমান্য করতে পারে না। …দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছেছে, এগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত হবে-এটাতে দোষের কিছু দেখি না। সংবিধান হচ্ছে জনগণের অভিপ্রায়। এটা কীভাবে হবে এ কাযপ্রণালী বিধি আগেই করবে।”
সংবিধান সংস্কার পরিষদ এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে বলেও তুলে ধরেন বদিউল আলম মজুমদার।
ঐকমত্য কমিশনের চূড়ান্ত সুপারিশের পরও বিএনপিসহ কয়েকটি দলের সমালোচনাকে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ বলে মন্তব্য করেন বদিউল আলম।
আদেশে প্রধান উপদেষ্টা সই করতে পারেন বলে ধারণা দিয়ে তিনি বলেন, “এই সরকারটা হল জনগণের সম্মতির সরকার। এই সরকারটা তো আমাদের সংবিধানে নেই, অন্তবর্তী সরকার। একটা অভ্যুত্থান হয়েছে। অভ্যুত্থানের পরের প্রেক্ষিতে যে জনগণের অভিপ্রায় অনুযায়ী অধ্যাপক ইউনুসের নেতৃত্বে একটা সরকার গঠিত হয়েছে। এখন এই অন্তবর্তীকালীন সরকারটা জনগণের অভিপ্রায়ের সরকার, এটা হল তাদের ক্ষমতার উৎস। সংবিধানে লেখা নেই। কিন্তু জনগণের অভিপ্রায়ের সরকার এ সরকার।”
বিএনপির সঙ্গে ‘প্রতারণা’ করা হয়েছে, এমন অভিযোগ সঠিক নয় বলে মন্তব্য করেন বদিউল আলম মজুমদার।
তিনি বলেন, “জনগণের কাছে প্রশ্ন করা হচ্ছে যেগুলো সিদ্ধান্ত হয়েছে। পক্ষে পক্ষের বিপক্ষে বিতর্কের ভিত্তিতে ওটা সিদ্ধান্ত হয়েছে এবং কিছু দল এটার সাথে দ্বিমত হয়েছে এবং নোট করা হয়েছে জুলাই সনদে, ‘নোটেড প্রপারলি’।”
জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের উপস্থিতিতে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করে বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন দল ও জোট।
আদেশ জারির এখতিয়ার, যা বলছেন বিশ্লেষকরা
সাবেক সচিব এ কে এম আব্দুল আউয়াল মজুমদার বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার স্বাক্ষরে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন সংক্রান্ত আদেশ জারির এখতিয়ার নেই। প্রধান উপদেষ্টার সম্মতিতে রাষ্ট্রপতির সই লাগবে।
“সাংবিধানিক বা নির্বাহী আদেশ করতে অবশ্যই রাষ্ট্রপতির সই লাগবে। এটাতে প্রধান উপদেষ্টার এখতিয়ার নেই।”
এ ধরনের আদেশের আইনি মূল্যের চেয়ে নৈতিক মূল্যই বেশি বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এখন এই সরকার যেটা বলছে যে প্রধান উপদেষ্টা সাহেবের নির্বাহী আদেশ জারি; এটা ওনার কোনো ক্ষমতা নাই। এটা রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারি করতে পারেন। আর প্রধান উপদেষ্টা সাহেব নির্বাহী আদেশ জারি করা, না করা সমান। কারণ, এটা কেউ মানতে বাধ্য না।। এটার কোন আইনি মূল্য তেমন একটা নাই। তবে নৈতিক মূল্য আছে।”
ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য এবং সদিচ্ছা মূল বিষয় হলেও দলগুলোর এ মানসিকতা তিন দেখতে পাচ্ছেন না।
সাবেক এ আমলার পর্যবেক্ষণ হল, “এখন যদি আমরা সবাই একমত হই যে, কষ্ট করে এটা করেছি। এখন প্রধান উপদেষ্টা একটা আদেশ দিয়ে, অনুরোধ করে চিহ্ন রেখে যাক; আমরা পরে এটা মানবো। তো সেই মানসিকতা তো বোঝা যাচ্ছে না।”
সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার অনুমোদনের বিষয় না থাকায় আদেশ বা অধ্যাদেশ জারি হলেও তা বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় দেখছেন সাবেক এ সচিব।
তিনি বলেন, “এখন (রাষ্ট্রপতি) অধ্যাদেশ জারি করলেও এটা যে খুব মূল্যবান, সেটাও আমি মনে করি না। কারণ যারা ক্ষমতায় আসবে তারা যদি সেটা পাস না করে বা সেটা বাতিল করে দেয়; তাইলে কিছু করার নাই। এটা তে কোনো দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাগবে না, কিছু লাগবে না।”
আব্দুল আউয়ালের মতে, রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য থাকলে, তারা একমত হলে সম্ভব। সেটা তো দেখা যাচ্ছে না।
২৭০ দিনের মধ্যে সংসদে অনুমোদনের কথা থাকলেও তখনকার সরকার তা না মানলে করার কিছু থাকবে না বলেও মনে করেন তিনি।
“যেখানে সংবিধান সংশোধন করা অনেক কঠিন, সেখানে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাগে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এক কলমের খোঁচায় বাতিল করে দিল আওয়ামী লীগ সংবিধান থেকে। এখন এগুলা পার্লামেন্টে যদি সংবিধানের অংশ হয়, তখন গুরুত্ব পাবে।”
সাবেক এই আমলা মনে করেন, সরকার গঠন করার পরে যদি তারা সেগুলো বাস্তবায়ন করে, এটা খুবই মূল্যবান জিনিস। কিন্তু যদি রাজনৈতিক দলগুলো একমত না হয়, বাস্তবায়নের সদিচ্ছা না থাকে, তাহলে এসব কতগুলো ‘বেদরকারি কাগজ’।
স্বাক্ষরিত সনদের বিষয় চূড়ান্ত সুপারিশে বাদ দেওয়ার সমালোচনা করে সংসদ বিষয়ক গবেষক নিজামউদ্দিন আহমদ বলেন, “ঐকমত্য কমিশন এত পরিশ্রম করে সবাইকে নিয়ে আলোচনা করল, নিজেরা কষ্ট করল; শেষ পর্যন্ত ঐকমত্যের জায়গায় অনৈক্য সৃষ্টি করে গেলেন।”
রাজনৈতিকগুলোর কাছ থেকে ভিন্নমতসহ জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর নেওয়ার পর তা চূড়ান্ত সুপারিশে না রাখায় কঠোর সমালোচনা করেন তিনি।
জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক নিজামউদ্দিন বলেন, “এই যে, ১৭ অক্টোবরের সনদে উল্লিখিত আছে, সেটা ‘ফাইনাল ডকুমেন্টে’ রাখলেন না, অতএব আপনাকে এ ক্ষমতা কে দিল? দলগুলোর কাছ থেকে স্বাক্ষর নিয়ে, ওটা বাদ দিলেন। বিএনপি একা নয়, অনেকে ছিল। সাক্ষাৎ জিনিসকে যখন পরিবর্তন করেন, তখন যাদের কাছ থেকে স্বাক্ষর নিলেন, তাদের প্রতি এক ধরনের অন্যায় করলেন।”
হয়ত এমন জানলে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেওয়া দলগুলো স্বাক্ষরই করত না বলে মনে করেন এ গবেষক।
তিনি বলেন, “নোট অব ডিসেন্ট বাদ দেওয়ার এখতিয়ার নেই ঐকমত্য কমিশনের। যে জিনিস সনদের অংশ, তা বাদ দিতে পারেন না।… স্বাক্ষরটা নিয়ে আপনি কি প্রতারণার আশ্রয় নিলেন, ওদের থেকে স্বাক্ষর নিয়ে অপকর্মটা করবেন।
“এই প্রশ্ন যে কোনো সাধারণ মানুষ উদয় হবেই, হতে বাধ্য। আপনি আমার সই আনা কাগজ, আমাকে না জানিয়ে বদল করে ফেললেন- এমন করাটা ঠিক হয়নি।”
এর ফলে সরকারের ওপর চাপ বাড়বে মন্তব্য করে অধ্যাপক নিজামউদ্দিন বলেন, “ঐকমত্য কমিশন কাজটা করেছে, ভালো। এত সময় দরকার ছিল না। এখন দায়টা… ঐকমত্য কমিশন সুপারিশ করতে পারে, তাদের সিদ্ধান্ত সরকার মানতে বাধ্য না। এখন সরকারের ওপরে বড় চাপ বাড়বে। সরকার এখন কি সিদ্ধান্ত নেয় তার ওপর নির্ভর করবে। সরকারকে খুব সাবধানে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
ইতোমধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন হয়ে গেছে, এমন পর্যবেক্ষণ দিয়ে তিনি বলেন, “পরিষ্কার বিভাজন হয়ে গেছে। গণভোট, বক্তব্য নিয়ে বিভাজনে হয়েছে।
“এটা তো কারো উপর চাপাচ্ছেন। বড় রাজনৈতিক দলগুলোর উপর চাপিয়ে দিতে পারবেন না।”
সাংবিধানিক বা নির্বাহী আদেশ রাষ্ট্রপতিকে জারি করতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এ গবেষক বলেন, “২৭০ দিনের মধ্যে সংসদে অনুমোদন না হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হওয়ার বাধ্যবাধকতার বিষয়টি নজিরবিহীন। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো নজির নেই। বাংলাদেশ নজির সৃষ্টি করতে যাচ্ছে। আপনার করতে পারবেন, কিন্তু এটা দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকবে বলে আমার মনে হয় না।”
এই ক্ষমতা ঐকমত্য কমিশনকে কে দিয়েছে, এই প্রশ্ন রেখে অধ্যাপক নিজামউদ্দিন বলেন, “পৃথিবীর কোথাও আছে? স্বয়ংক্রিয়ভাবে কীভাবে কোনো জিনিস সংবিধানে যুক্ত হবে। আর গণভোট তো পার্লামেন্ট ভোটের পরে হবে। সংসদের উপর তো কিছু নাই, সংবিধান বলে দিছে। …যুক্ত করতে হলে সংসদের সিদ্ধান্ত নেবে, নিয়ম তো তাই। কিন্তু এখন তো আপনি সংসদের হাত পা বেঁধে রাখলেন।”
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশে রাষ্ট্রপতির সইয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা জারি করবে, এটা গায়ের জোরের কথাবার্তা। প্রধান উপদেষ্টার কথা অনুযায়ী হবে, সই তো রাষ্ট্রপতি করতে হবে। রাষ্ট্রপতির আদেশে সবকিছু হবে, সংবিধান পরিষ্কার বলা আছে। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার পরামর্শে করবেন।”
দলগুলোর অনৈক্যের কারণে সামনে সংকট বাড়বে মন্তব্য করে এ গবেষক বলছেন, এখন সরকারের পক্ষ থেকে সংকট সমাধান করে সামনে এগোতে হবে।