যে সমাজে বৈষম্য, মৌলবাদ আর দমননীতি বেড়ে চলে, সেখানে উদীচী দাঁড়ায় এক অনমনীয় প্রতীকে—অসাম্প্রদায়িক, মানবিক ও সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্নে।
সংগৃহিত
বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী এদেশের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম বাতিঘর। ১৯৬৮ সালের ২৯ অক্টোবর প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সংগঠনটি মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে প্রতিটি ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ের সংগ্রামে গান, নাটক, আবৃত্তি, নৃত্যসহ সৃজনশীল সব হাতিয়ার নিয়ে রাজপথে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছে। সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অবিরাম লড়াই এবং একটি বৈষম্যহীন, সাম্যবাদী, মৌলবাদমুক্ত সমাজ গঠন করাই উদীচীর লক্ষ্য।
সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই উদীচীর জন্মগত অঙ্গীকার। উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা সত্যেন সেন ও রণেশ দাশগুপ্ত সমগ্র তারুণ্য ব্যয় করেছেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই করে এবং সেই ‘অপরাধে’ জেল খেটে। তারা জানতেন, সাম্রাজ্যবাদ হল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দুশমন। তাদেরই হাতে সৃষ্ট সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অস্ত্র হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা। তাই তারা উদীচীর প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে রচিত ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে। শুধু সত্যেন সেন বা রণেশ দাশগুপ্ত নন, ৫৭ বছরে উদীচীর সঙ্গে যারা যুক্ত হয়েছেন উপদেষ্টা হিসেবে, সদস্য হিসেবে এবং আরও নানাভাবে উদীচীকে সহযোগিতা করেছেন, তারাও সবাই সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী।
ধনতন্ত্রের উচ্চতর পর্যায় সাম্রাজ্যবাদ। অতীতে ধনবাদী দেশগুলো সামরিক শক্তির বলে অপর দেশ দখল, সেখানে তার বাজার সম্প্রসারণ এবং দখলকৃত দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করতো। প্রথম দিকে ইউরোপীয় দেশগুলো অন্য দেশে উপনিবেশ স্থাপন করে সেখানকার ধনসম্পদ, কাঁচামাল লুট করে নিজ দেশে নিয়ে যেত এবং দখলকৃত দেশের কুটির শিল্প ধ্বংস করে দেশটিকে তাদের ওপর নির্ভরশীল করে তুলত। আর ওই শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য সাম্প্রদায়িক বিভাজনের সৃষ্টি করত। তবে, এ যুগের সাম্রাজ্যবাদ আর্থিক চুক্তি, বাণিজ্য চুক্তি, কর্পোরেট বিনিয়োগ ইত্যাদির মাধ্যমে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে। উন্নত দেশগুলোর প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের ওপর অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর নির্ভরতা তৈরি করে।
কোনো দেশকে প্রভাব বলয়ে আনার জন্য সাম্রাজ্যবাদ সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টি করে। দেশে দেশে সামরিক শাসন জারি করতে সেনাবাহিনীকে উদ্বুদ্ধ করে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সামরিক শাসন বজায় রাখে, অবাধ্য সরকারকে নানা ছল চাতুরি দিয়ে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করে, সমগ্র বিশ্বের বড় বড় প্রচার মাধ্যম ও মিডিয়া মোগলসমূহ সাম্রাজ্যবাদের উদ্দেশ্যের পরিপোষণ করে। সাম্রাজ্যবাদ, টার্গেট দেশের মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবীদের ক্রয় করে মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব সৃষ্টি করে। বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, শাস্তিমূলক বাণিজ্য শুল্ক আরোপ করে, ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা, উড্ডয়ন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, দেশসমূহকে অসম বাণিজ্যচুক্তিতে আবদ্ধ হতে বাধ্য করে।
সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তির অন্যতম প্রধান অস্ত্র হলো সাম্প্রদায়িকতা। একথা কেউ খোলাখুলি বলে না যে ধর্মই সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতার প্রধান উৎস। কারণ সকল ধর্মেই নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব এবং এর বাইরে সকলের নিকৃষ্টতার কথা বলা আছে। যুগ পরিবর্তনের সঙ্গেসঙ্গে এবং বৈষয়িক প্রয়োজনে আধুনিক কালে এই অসহিষ্ণুতা কমেছে। বরং বলা যায়, বাস্তবতার আবরণে ঢাকা পড়েছে। এই আবৃত অসহিষ্ণুতা এবং সন্দেহকে কাজে লাগিয়ে সাম্রাজ্যবাদ তার স্বার্থ হাসিল করে। ব্রিটিশ শাসকরা ১৮০০ সাল থেকেই হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের বুদ্ধিবৃত্তিক কাজটি শুরু করে। তবুও ১৮৫৭ সালে হিন্দু-মুসলিম সিপাহীরা মিলে ঐক্যবদ্ধ বিদ্রোহ ঘটিয়েছিলেন। তারা সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে নেতা মেনেই লড়াই করেছিলেন। এতে হিন্দু-মুসলিম কারো কোনো অসুবিধা হয়নি। এই ঘটনাতে ইংরেজ শাসকরা হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের প্রয়োজনীয়তাকে আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করে। নানা ঘটনাপ্রবাহ পেরিয়ে সবশেষ ১৯৪৬ সালের হিন্দু-মুসলিম ভয়াবহ দাঙ্গার মধ্য দিয়ে ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষের চূড়ান্ত বিভাজন ঘটায় ব্রিটিশরা। দুটি দেশই পরষ্পর যুদ্ধাবস্থা বজায় রাখার জন্য সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো থেকে প্রচুর অস্ত্র কিনে সাম্রাজ্যবাদের উদ্দেশ্য পূরণে লিপ্ত হয়।
সাম্রাজ্যবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতা—এই দুটির বিরুদ্ধে জন্ম থেকেই সদা সোচ্চার উদীচী। উদীচী তার অঙ্গীকার থেকে কখনো সরে আসেনি। উদীচী সংগঠনটি হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠেনি। এর জন্মের পূর্বেও বহু নিবেদিতপ্রাণ মানুষের আত্মত্যাগের কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে। বহু মানুষের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রাম, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সংগ্রাম, রাজনৈতিক সংগ্রাম, সাংস্কৃতিক সংগ্রাম, শ্রমিক-কৃষক-মেহনতী মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ঐতিহ্য রয়েছে। উদীচীর রয়েছে, ÔYouth Cultural InstituteÕ, ‘প্রগতি লেখক সংঘ’, ‘ফ্যাসিস্টবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ’ এবং ‘সর্বশেষ ভারতীয় গণনাট্য সংঘ’ প্রমুখ স্বনামধন্য শক্তিশালী সংগঠনের উত্তরাধিকার। সেই ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার হিসেবে উদীচী সংগীত, নাটক, আবৃত্তি, নৃত্য, চারুকলা, চলচ্চিত্র, কাব্যসাহিত্য, প্রবন্ধ—সকল সৃজনকর্মেই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা ও অসাম্প্রদায়িকার ছাপ রেখে গেছে।
উদীচী যেসব গানকে সবসময় সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে তার মধ্যে অন্যতম—সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সুকান্ত ভট্টাচার্যের লেখা ও সলিল চৌধুরীর সুর করা গান, ‘অবাক পৃথিবী অবাক করলে তুমি’, শিবদাস বন্দোপাধ্যায়ের লেখা ও ভি বালসারার সুর করা যুদ্ধবিরোধী গান, ‘আজ যত যুদ্ধবাজ’, শহীদুল্লাহ কায়সারের লেখা ও শহীদ আলতাফ মাহমুদের সুর করা দেশের দেশে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইয়ের গান, ‘আমরা পুবে পশ্চিমে’, সলিল চৌধুরীর অসাম্প্রদায়িক গান, ‘ও আয় রে ও আয় রে ও ভাইরে’, রবীন্দ্রনাথের সাম্প্রদায়িক মিলনের গান, ‘আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে’, ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’, কবি নাজিম হিকমতের লেখা এবং কমল সরকারের অনুবাদ ও সুর করা, ‘ওরা আমাদের গান গাইতে দেয় না শিল্পী সংগ্রামী পল রবসন’, আন্তর্জাতিক সংগীতের প্রেরণায় কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ও সুর করা ‘জাগো অনশন বন্দী ওঠো রে যত’, আন্তর্জাতিক সংগীত ‘জাগো জাগো সর্বহারা’, কাজী নজরুলের সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী গান ‘মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম’, ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’, মাহমুদ সেলিম ও অলক দাশগুপ্তের যৌথ কথা ও সুরে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী গান, ‘বিশ্বগ্রাসী দানবটাকে বিশ্বমানব দাঁড়াও রুখে’ ইত্যাদি। ১৯৮৯-৯০ সালে মৌলবাদবিরোধী অ্যালবাম প্রকাশ করে উদীচী, যার গানগুলো রচনা করেন রেজাউল করিম সিদ্দিক রানা ও সুর দেন সাবাব আলী আরজু। গানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য— ‘তোরা মিছাই ধর্মের কথা বলিস, তোদের মুখে ধর্ম সাজে না মানুষের ধর্ম লইয়া তোরা আর খেলিস না’। এছাড়া, বেলায়েত হোসেনের সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী কাব্যপত্র ‘নগর তিলোত্তমার কথকতা’ উল্লেখযোগ্য।
গানের পাশাপাশি নাটকের মাধ্যমেও সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অগ্রগামী উদীচী। ১৯৭৪ এ দুর্ভিক্ষ সৃষ্টিকারী সাম্রাজ্যবাদ ও তার দেশীয় দোসর কালোবাজারী, মুনাফাখোর ও মজুতদারদের বিরুদ্ধে উদীচী রচনা করে ‘সাচ্চা মানুষ চাই’। ১৯৯৭ সালে জার্মান নাট্যকার বের্টেল্ট বেখট রচিত ও আতিকুর রহমানের নির্দেশিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নাৎসি বাহিনী দমন-পীড়ন-অত্যাচারের সীমা লক্সঘন-এর প্রেক্ষাপটে রচিত নাটক ‘দেওয়ালে লিখন’। ২০০১ সালে সম্পদ পাচার, সাম্প্রদায়িকতা, শিক্ষার বাণিজ্যিকিকরণ ও বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থার অসারতাকে ব্যঙ্গ করে মুনির হেলালের রচনা এবং রতন দেব ও মুনিম ইসলাম শিমুলের নির্দেশনায় উদীচী মঞ্চস্থ করে নাটক ‘বায়োস্কোপ’। ২০০২ সালে ঔপনিবেশিক শাসন ও পশ্চিমা আধিপত্যের বিরুদ্ধে আইরিশ নাট্যকার ব্রায়ান ফ্রেইল রচিত আশীষ খন্দকার অনূদিত ও নির্দেশিত নাটক দ্য ফ্রিডম অব দা সিটি, ২০০৯ সালে টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ ও সমুদ্র বক্ষে গ্যাসক্ষেত্র ইজারা দেওয়ার প্রেক্ষাপটে মারুফ রহমান রচিত ও শহীদুল আলম দিপু নির্দেশিত নাটক ‘গহনা’ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামে পরিবেশিত নাটকগুলোর অন্যতম।
সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা ও সাম্প্রদায়িকতাবিহীন দেশ গড়ার উদ্দেশ্যে ৭২’র সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন উদীচীর সভাপতি কামাল লোহানী এবং সদস্য সচিব ছিলেন অধ্যাপক বদিউর রহমান। এছাড়া, ২০০৫ সালে চার দলীয় জোট সরকার একটি সংশোধনী বিলে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফকে বাংলাদেশের আইনকানুন থেকে দায়মুক্তির প্রস্তাব আনে। এর বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে উদীচী বিশাল প্রতিবাদ সমাবশের আয়োজন করে। ৬ সেপ্টেম্বর ২০০০ সমুদ্রবক্ষে গ্যাস ব্লক বিদেশিদের ইজারা দেয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশ আয়োজন করে। ২০১৬ সালের ১৯-২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় উদীচীর উদ্যোগে তিনদিনব্যাপী ‘সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী দক্ষিণ এশীয় সাংস্কৃতিক কনভেনশন’ অনুষ্ঠিত হয়। কনভেনশনে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। ২০১৬ সালের ২২-২৮ জুলাই সারাদেশে জঙ্গীবাদবিরোধী সপ্তাহ পালিত হয়। ২০১৭ সালে পাঠ্যপুস্তক সাম্প্রদায়িকীকরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে উদীচী। যার মধ্যে ছিল ১১ জানুয়ারি গোলটেবিল বৈঠক, ১৫ জানুয়ারি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সামনে সমাবেশ, ৩১ জানুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয় ঘেরাও ইত্যাদি।
উদীচী তার জন্মলগ্ন থেকে সাম্যবাদ ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার এবং মেহনতী মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম থেকে সরে দাঁড়ায়নি। আর যেহেতু সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিশ্বের মানুষের সবচেয়ে বড় দুশমন, তাই দীর্ঘ ৫৭ বছর অধিকাংশ কাজে উদীচী সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সংগ্রামেই নিয়োজিত ছিল, আছে এবং থাকবে। উদীচী মানেই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা, উদীচী মানেই সাম্প্রদায়িকতা বিরোধিতা, উদীচী মানেই মেহনতী মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম, উদীচী মানেই বিশ্বমানবতার সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে নিয়োজিত একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন।