চার ধরনের ধ্যানে অনিদ্রার সমস্যা মিটে যেতে পারে।
সংগৃহিত
রাতে শুয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সময় গুনছেন? গরম দুধ বা আরামদায়ক বালিশ- সব চেষ্টাই চলেছে- তবুও ঘুমের দেখা মিলছে না?
ঘুম না আসা বা মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যাওয়া ব্যস্ত জীবনের নিত্য সমস্যা। ঘুমের অভাব শুধু মনোযোগ কমায় না, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও মানসিক স্থিতিশীলতার ওপরেও বিরূপ প্রভাব ফেলে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নিয়মিত ঘুমের সমস্যা বা অনিদ্রার কার্যকর সমাধান হতে পারে ‘গাইডেড মেডিটেইশন’ বা নির্দেশিত ধ্যান।
যুক্তরাষ্ট্রের মানসিক স্বাস্থ্য ও ধ্যান বিষয়ক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘কাম’-এর একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে- নিয়মিত ‘গাইডেড মেডিটেইশন’ অনুশীলনে ঘুমের মান উন্নত হয় এবং মানসিক চাপ ও উদ্বেগ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে।
নির্দেশিত ধ্যান যেভাবে কাজ করে
ঘুমিয়ে পড়া মানে কোনো সুইচ ‘অন’ বা ‘অফ’ করা নয়; বরং এটি ধীরে ধীরে আলোর উজ্জ্বলতা কমিয়ে দেওয়া মতো একটি প্রক্রিয়া।
সারাদিনের ব্যস্ততা, চিন্তা, মানসিক চাপ সবকিছু থেকে মস্তিষ্ককে ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন করতে হয়। এই জায়গাতেই ‘নির্দেশিত ধ্যান’ কাজ করে।
এটি মূলত একটি ধীর, প্রশান্ত ‘সাউন্ড সেশন’ বা ‘ভয়েস রেকর্ডিং’ যা শ্বাস-প্রশ্বাস, কল্পনা, ও মৃদু সুরের সংমিশ্রণে মন ও শরীরকে শান্ত করে গভীর ঘুমের দিকে নিয়ে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের ধ্যান বিশেষজ্ঞ ওরেন জে সোফার, যিনি ‘কাম অ্যাপ’য়ের প্রশিক্ষক হিসেবেও কাজ করেন, তিনি বলেন, “ধ্যান মস্তিষ্ককে পুনরায় প্রোগ্রাম করতে সাহায্য করে। এটি মনোযোগকে বর্তমানের দিকে ফিরিয়ে আনে এবং শ্বাসের ছন্দের মাধ্যমে শরীরকে বিশ্রামের বার্তা দেয়।”
যে কারণে নির্দেশিত ধ্যান ঘুমের জন্য কার্যকর
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত নির্দেশিত ধ্যান অনুশীলন ঘুমের মান উন্নত করে এবং অনিদ্রার লক্ষণ হ্রাস করে। বিশেষ করে যাদের ঘুম না আসার মূল কারণ মানসিক চাপ বা উদ্বেগ, তাদের জন্য এটি প্রাকৃতিক ঘুমের এক নিরাপদ উপায়।
মানসিক কোলাহল কমায়: রাতে বিছানায় শোয়ার পর মস্তিষ্কে নানান চিন্তা ভিড় করে, যেমন- দিনের কাজ, আগামী দিনের ভাবনা, অপূর্ণতা ইত্যাদি।
ধ্যানের সময় প্রশান্ত কণ্ঠস্বর ও গল্প মনকে নিরপেক্ষ কিছুর দিকে মনোযোগ দিতে সাহায্য করে, ফলে অতিরিক্ত চিন্তার ধারা ভেঙে যায়।
শরীরকে বিশ্রামের অবস্থায় নিয়ে যায়: ধ্যানে শ্বাস-প্রশ্বাসের অনুশীলন ধীরে ধীরে হৃদস্পন্দন কমায়, রক্তচাপ স্থিতিশীল করে এবং ‘রেস্ট অ্যান্ড ডাইজেস্ট’ বা বিশ্রাম-প্রক্রিয়া সক্রিয় করে।
শরীরের টান টানভাব কমায়: অনেক সময় নিজের অজান্তেই কাঁধ, ঘাড় বা চোয়ালে চাপ ধরে রাখা হয়। ‘গাইডেড মেডিটেইশন’য়ে ধীরে ধীরে শরীরের প্রতিটি অংশে মনোযোগ দেওয়া হয়, যা টান দূর করে আরাম দেয়।
ঘুমের রুটিন তৈরি করে: প্রতিদিন একই সময়ে ধ্যান করলে মস্তিষ্ক বুঝে নেয় যে ঘুমের সময় এসে গেছে। এটি ঘুমের প্রাকৃতিক ছন্দ বা ‘বায়োলজিক্যাল ক্লক’কে স্থিতিশীল করে।
যেভাবে শুরু করবেন
ওরেন জে সোফার বলেন, “নির্দেশিত ধ্যান বা ‘গাইডেড মেডিটেইশন’ শুরু করার জন্য কোনো জটিল প্রস্তুতি প্রয়োজন নেই। শুধু একটি শান্ত পরিবেশ ও মনোযোগের সামান্য ইচ্ছাই যথেষ্ট।”
সময় নির্বাচন: ধ্যানের সবচেয়ে ভালো সময় হল ঘুমের ঠিক আগে। ধ্যানের পর আর ফোন দেখা বা কোনো কাজ শুরু করা যাবে না।
পরিবেশ তৈরি: আলো কমিয়ে দিন, মোবাইলের নোটিফিকেশন বন্ধ এবং ঘরটিকে আরামদায়ক রাখতে হবে।
দৈর্ঘ্য বেছে নেওয়া: যাদের ঘুম আসতে সময় লাগে না, তারা ১০ থেকে ১৫ মিনিটের সেশন নিতে পারেন। অন্যরা চাইলে ৩০ থেকে ৪০ মিনিটের দীর্ঘ ধ্যান করতে পারেন।
ধরনের মধ্যে পছন্দ করা: কেউ শ্বাসের ওপর মনোযোগ দিতে পছন্দ করেন, কেউ কল্পনা-নির্ভর ধ্যান করেন। আবার কেউ কৃতজ্ঞতার ধ্যান করেন। নিজের জন্য সবচেয়ে মানানসইটি বেছে নিতে হবে।
নিয়মিততা বজায় রাখা: নিয়মিত অনুশীলনে মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে এই অভ্যাসের সঙ্গে মানিয়ে নেয়, ফলে সময়ের সঙ্গে ঘুম আরও গভীর হয়।
জনপ্রিয় ‘গাইডেড মেডিটেইশন’ যা আজ রাতেই চেষ্টা করতে পারেন
স্লিপ স্টোরি (ঘুমের গল্প): ঘুমের গল্প বা ‘স্লিপ স্টোরি’ হল- ধীর ও প্রশান্ত বর্ণনার মাধ্যমে তৈরি এক ধরনের মেডিটেইশন। এটি মূলত গল্পের ছলে মনকে দিনের চিন্তা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
এই ধরনের নানান রকম গল্প অনলাইন থেকে পাওয়া সম্ভব।
মাইন্ডফুলনেস মেডিটেইশন (সচেতন ধ্যান): এই ধ্যানের মূল উদ্দেশ্য হল- বর্তমান মুহূর্তে মনোযোগ ফিরিয়ে আনা। শ্বাস-প্রশ্বাসের ছন্দ ও শরীরের অনুভূতি উপলব্ধি করে মনকে শান্ত করা হয়।
এই ধ্যান শরীরের প্রতিটি অংশে মনোযোগ এনে বলে, ‘এই মুহূর্তে আমি ঠিক আছি’- এই মৃদু বার্তা-ই ঘুমকে সহজ করে তোলে।
গাইডেড ইমেজারি (কল্পনাভিত্তিক ধ্যান): এ ধরনের ধ্যানে কণ্ঠস্বর কল্পনার এক শান্ত জগতে নিয়ে যায়। যেমন- তুষার-ঢাকা কুটির বা নদীর ধারে শান্ত বনভূমি।
এই দৃশ্যমান কল্পনা মস্তিষ্ককে বাস্তব উদ্বেগ থেকে দূরে সরিয়ে নিরাপত্তার অনুভূতি দেয়।
এভাবে মনকে কল্পনার মাধ্যমে শিথিল করা হয়। যেন সমস্ত টান, চাপ ও চিন্তা ধীরে ধীরে গলে যাচ্ছে।
ডিপ স্লিপ মেডিটেইশন (গভীর ঘুমের ধ্যান): এটি সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী এবং ধীর গতির সেশন, যেখানে নীরবতার পর্যায় বেশি থাকে।
ফলে শুধু ঘুমিয়ে পড়া নয় বরং গভীর ও টানা ঘুম বজায় রাখতে সাহায্য করে। এভাবে শরীরের ছন্দ ধীরে এনে মস্তিষ্ককে নিস্তব্ধতার দিকে নিয়ে যাওয়া হয়।
