চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর ‘জুলাই সনদ’ বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এই সনদ কেবল দলগুলোর স্বাক্ষরের আনুষ্ঠানিকতা নয়—এটি গণতন্ত্র, জাতীয় ঐক্য ও সংসদকেন্দ্রিক রাজনীতির প্রতিশ্রুতি।
সংগৃহিত
এখন সময়টা পরিবর্তনের, দিনবদলের। এই পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষায় চব্বিশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান হয়েছে। এতে ফ্যাসিস্ট সরকারের শুধু পতনই হয়নি, তারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। সেই পরিবর্তনের জন-আকাঙ্ক্ষা থেকেই ‘জুলাই সনদ’। জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় রাজনৈতিক দলগুলো মিলে এই সনদে স্বাক্ষর করেছে। এটা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে একটা নতুন অধ্যায় বিনির্মাণ করেছে।
এই সনদ শুধু একটি স্বাক্ষরের আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটি দেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার প্রতীক, যেখানে জনগণের আশা, প্রান্তিক মানুষের কল্যাণ এবং জাতীয় সংসদকে কেন্দ্র করে নতুন রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলার আশাবাদ রয়েছে।
আমরা যারা রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত, তারা এই সনদে স্বাক্ষর করেছি এই প্রত্যাশায় যে, বাংলাদেশ এক উদার গণতান্ত্রিক দেশ হবে, জনকল্যাণের দেশ হবে, সুশাসনের দেশ হবে, জবাবদিহির দেশ হবে, ন্যায়বিচার প্রাপ্তির দেশ হবে এবং সর্বোপরি জাতীয় সংসদই হবে সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রস্থল।
এটা ঠিক, গণতন্ত্রের পথ কেবল স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে শুরু হয় না, এটি একটি নিরন্তর প্রক্রিয়া। যেখানে ভিন্নমত থাকবে, ভিন্ন চিন্তা থাকবে, ভিন্ন ভাবনা থাকবে; যেখানে মুক্তবুদ্ধির চর্চা থাকবে, যেখানে জনমানুষের তথা প্রান্তিক মানুষের কল্যাণ নিয়ে পরিকল্পনা থাকবে, যেখানে সব মানুষের, সব শ্রেণির অংশগ্রহণ থাকবে।
জুলাই সনদ স্বাক্ষর যেমন একটি অনন্য ঘটনা, তেমনি এটি রাষ্ট্রকাঠামোর পরিবর্তন, মূলনীতির সংশোধন এবং একই সঙ্গে আমাদের রাজনীতিকে আরও স্বচ্ছ করা, জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া, গণতান্ত্রিক যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে, সেগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আরও উন্নত ও শক্তিশালী করা, তাদেরকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চলতে দেওয়া এবং গণতান্ত্রিক কৃষ্টি অর্থাৎ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি পুরোটা আমাদের সমাজের মধ্যে নিয়ে আসতে সক্ষম হবে।
জুলাই সনদের পর এখন আমাদের যাত্রাপথ—নির্বাচন। একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত হবে সত্যিকার অর্থে নির্বাচিত একটি সংসদ, যে সংসদ জন-আকাঙ্ক্ষা পূরণে একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচিত সরকারকে দিকনির্দেশনা দেবে।
আওয়ামী লীগ ১৫ বছরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামোর প্রতিটি স্তরে যে ময়লা-আবর্জনা তৈরি করে গেছে, যে জঞ্জাল সৃষ্টি করে গেছে, সবকিছু ধ্বংস করে গেছে, এক বছরের মধ্যে সেগুলোর সব ঠিক করে ফেলা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। তাই রাষ্ট্র বিনির্মাণে রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে একটা অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের দিকে যেতে হবে। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে সংসদ গঠিত হবে, সেই সংসদের দায়িত্ব হবে সংসদীয় ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা। সেই দিকে আমাদের নজর দিতে হবে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ঊনবিংশতম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর প্রকাশনা।
সমস্ত কর্মকাণ্ডকে সংসদকেন্দ্রিক করতে হবে। এটা না করলে সংসদীয় গণতন্ত্র কার্যকর হবে না—এ কথাগুলো আমাদের বুঝতে হবে। পৃথিবীর যেসব দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র সফল হয়েছে, সব কটিতে কিন্তু সংসদ হচ্ছে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। আমাদের এখানেও গণতান্ত্রিক এই ব্যবস্থাটাকে নিশ্চিত করতে হবে।
আমি অনেক সময় ভাবি, কত প্রাণের বিসর্জন, কত কষ্ট, কত অত্যাচার, কত নির্মমতাকে জয় করে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা এই জায়গায় এসেছি। এখনো আমাদের একটা বিশাল জনগোষ্ঠীর নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মত অবস্থা, দিন আনে দিন খায় মানুষজন, দুই বেলা ভালোভাবে খেতেও পায় না বহু মানুষ। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার এখন সময় এসেছে, সুযোগ এসেছে পরিবর্তনের। সে জন্য আমি সবাইকে বলি, এখন আমাদের রাস্তা থেকে উঠে চলে আসতে হবে সংসদে। ৫০ বছর তো আমরা রাস্তায় চলছি। এগুলোকে ঠিক করে এই জাতীয় সনদের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে যেন আমরা একটা রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিণত করতে পারি, সেই চেষ্টাই আমাদের করতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এই নির্বাচনে সবাই যেন অংশগ্রহণ করতে পারে, সে জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে অনেক দায়িত্বশীল হতে হবে।
আমি তাদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাব, আসুন, আমরা সবাই যেভাবে আমাদের মধ্যে ছোটখাটো যেসব ভিন্নতা রয়েছে, যে দূরত্ব রয়েছে, সেগুলো দূর করে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছি, একইভাবে দূরত্ব দূরে সরিয়ে আগামী নির্বাচনকে একটা সত্যিকার অর্থেই অর্থপূর্ণ নির্বাচনে পরিণত করি।
একটা অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন হোক, সকলের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হোক এবং সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যারা নির্বাচিত হবেন, তারাই আমাদের সংসদকে সত্যিকার অর্থে প্রাণবন্ত করে গড়ে তুলবেন, অর্থবহ করবেন এবং সেই সংসদ হবে আমাদের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। আমরা যেন সামনের দিকে যেতে পারি। গণতন্ত্রকে যদি আমরা সত্যিকার অর্থে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হই, তাহলে আমার ধারণা, আমার বিশ্বাস, কৃষক-শ্রমিকসহ আপামর মানুষের দাবিদাওয়া সেখানে পূরণ হবে, স্বীকৃত হবে।
আমাদের একটা কথা সব সময় মনে রাখতে হবে, জুলাই সনদ স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো যে অঙ্গীকার করেছে, তা বাস্তব রূপ দেওয়া বড় চ্যালেঞ্জ।ঐক্য ও সদিচ্ছার সমন্বয় করে আমাদের একটি স্থিতিশীল কল্যাণমুখী রাষ্ট্র বিনির্মাণে এগিয়ে যেতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
জাতীয় সনদে যে বিষয়গুলো এসেছে, সেগুলো নিঃসন্দেহে একটা স্বনির্ভর বাংলাদেশ, আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে নতুন করে আমাদেরকে প্রেরণা দেবে এবং এই সনদের মধ্য দিয়ে একটা ভিত্তি স্থাপিত হল। জুলাই সনদের সবচেয়ে বড় অর্জন হল জাতীয় ঐক্য—যতই ভিন্নমত থাকুক না কেন, এই ঐক্যের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার একটি সুসংহত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
আমি বিশ্বাস করি, যদি আমরা এই সনদের ভিত্তিতে আগামীর রাজনৈতিক পদক্ষেপগুলো নিতে পারি; বিশেষ করে নির্বাচন, নির্বাচন-উত্তর সংসদ গঠন এবং সেই সংসদে ঐক্যকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে পারি, তাহলে এই সনদের তাৎপর্য ও যথার্থতা নিশ্চিত হবে। এর মধ্য দিয়ে আমাদের দেশের জন্য যে কাঠামোগত ভিত্তিটা জরুরি, সেই ভিত্তি তৈরি হয়ে যাবে। এই ভিত্তিভূমি অর্থনীতির ভিত্তিকে শক্তিশালী করে দেশকে সামনের দিকে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে।

