অগ্নিকাণ্ডের পর প্রথম আন্তর্জাতিক কার্গো ফ্লাইট মঙ্গলবার শাহজালালে নামবে প্রায় চারশ টন আমদানি পণ্য নিয়ে। আপাতত রপ্তানি কমপ্লেক্সের পাশের একটি উন্মুক্ত স্থান সেসব পণ্য রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
কর্মদিবসে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের ৮ নম্বর ফটক এলাকায় থাকে ব্যবসায়ী আর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের ছোটাছুটি, লাইন ধরে থাকে ট্রাক আর কাভার্ড ভ্যানের ভিড়। এই কর্মতৎপরতার কেন্দ্রে যে আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সে, গত শনিবার সেখানে আগুন লাগার পর দৃশ্যপট বদলে গেছে।
আগুন লাগার পর থেকে শাহজালালে নতুন করে কোন কার্গো ফ্লাইট নামেনি। তবে কাজ না থাকলেও অনেক ব্যবসায়ী কার্গো কমপ্লেক্সের সামনে আসছেন, তাদের আলোচনায় ক্ষয়ক্ষতি আর ক্ষতিপূরণের বিষয়টাই এখন মুখ্য।
অগ্নিকাণ্ডের পর পণ্য ছাড় ও অন্যান্য ব্যবস্থাপনা স্বাভাবিক হয়নি দুই দিনেও। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) রোববার সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিকল্প উপায়ে পণ্য খালাসের কথা বলেছিল; তবে সোমবারও তা পুরোপুরি শুরু করা যায়নি।
আগের চালানে আসা অক্ষত কিছু মালামাল সোমবার ব্যবসায়ীদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। ৯ নম্বর ফটক দিয়ে সেসব মালামাল বুঝে নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
বিমান বন্দরে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্বে থাকা বিমানের কার্গো শাখার একজন কর্মকর্তা বলছেন, “জরুরি ভিত্তিতে কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের বিকল্প ব্যবস্থাপনা চালু করা হয়েছে। তবে ডিজিটাল সিস্টেম বন্ধ থাকায় সীমিত পরিসরে কাজ চলছে। এখন পর্যন্ত কোনো নতুন কার্গো ফ্লাইট অবতরণ করেনি।”
মঙ্গলবার একটি ফ্লাইট নামার কথা রয়েছে জানিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, “মঙ্গলবার থেকে ফ্রেইটার ফ্লাইট নামা শুরু হবে। ক্যাথে প্যাসেফিক এয়ারলাইন্সের একটি ফ্রেইটার ফ্লাইট হংকং থেকে মঙ্গলবার ঢাকায় নামার কথা রয়েছে। এটি হবে আগুনের ঘটনার পর প্রথম আন্তর্জাতিক কার্গো ফ্লাইট।
“প্রথম কার্গো ফ্লাইটে আসবে প্রায় চারশ টন আমদানি পণ্য। সেসব রাখার স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে রপ্তানি কমপ্লেক্সের পাশের একটি উন্মুক্ত স্থানে। পণ্য খালাসের পর তা বের হবে নয় নম্বর গেট দিয়ে।”
এদিকে উন্মুক্ত স্থানে পণ্য রাখলে তা বৃষ্টিতে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেজন্য পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ এর সহায়তায় দ্রুত একটি শেড নির্মাণের চিন্তা করছে কর্তৃপক্ষ।
বিমানের কার্গা শাখার আরেক কর্মকর্তা বলছেন, ম্যানুয়ালি পণ্য ছাড় করতে গিয়ে বিমানের কর্মীরা কাস্টমসের সঙ্গে সমন্বয় করতে পারছেন না।
“সার্ভার ফিরে না আসা পর্যন্ত এভাবেই করতে হবে। আপাতত আমদানি পণ্য খালাসের প্রক্রিয়া সচল রাখতে রপ্তানি কার্গো ভবনেই দাপ্তরিক কাজ চালাবে আমদানির লোকজন। সেজন্য রপ্তানি ভবনে আসবাবপত্র ও অফিসের সরঞ্জাম বসানো হচ্ছে। নতুন ভবন না পাওয়া পর্যন্ত এখানেই চলবে কাজ।”
সবকিছু স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টা আমদানি পণ্য খালাস কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিমান কর্তৃপক্ষ।
সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি খায়রুল আলম ভুইয়া মিঠু বলেন, “জরুরি অবস্থা বিবেচনায় এখন ২৪ ঘণ্টাই আমদানি মালামাল খালাস করা যাবে। তবে এ ব্যবস্থা কতদিন থাকবে তা জানানো হয়নি। আজ কিছু ব্যবসায়ী পুরনো চালানের মালামাল খালাস করতে পেরেছেন।”
শনিবার দুপুরে শাহজালালের আমদানি কার্গো ভিলেজে আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট, পুলিশ, আনসার, র্যাব, এপিবিএন, বিমান বাহিনী, নৌবাহিনীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় রাত ৯টার দিকে তা নিয়ন্ত্রণে আসে। ২৭ ঘণ্টা পর রোববার বিকালে আগুন পুরোপুরি নেভানো সম্ভব হয়।
১২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি: ইএবি
ঘটনার দিন রাতে বেসামরিক বিমান চলাচল উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেছিলেন, এক ঘণ্টার মধ্যে তিনি ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ হাতে পাবেন।
তবে সেই বিবরণ এখনো প্রস্তুত হয়নি বলে বিমানের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। ঘটনা তদন্তে কাজ করছে আন্তঃমন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন সংস্থার অন্তত চারটি তদন্ত কমিটি।
তবে ব্যবসায়ীরা নিজেদের ক্ষতির হিসাব কষা শুরু করেছেন। সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ইমরান হোসাইন বলছেন, “আমাদের এজেন্ট এসোসিয়েশন থেকে সবাইকে একটা ফরম দিয়েছি, কার কার কত মালামাল ছিল, কী ক্ষতি হয়েছে সে হিসাব দেওয়ার জন্য। ব্যবসায়ীরা সবাই ক্ষয়ক্ষতির হিসাব দিয়ে ফর্ম ফিলাপ করছেন।”
সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি খায়রুল আলম ভুঁইয়া মিঠু বলছেন, তাদের সংগঠনের সদস্য সংখ্যা দুই হাজার। এর মধ্যে এক হাজার নয়শ জনই শাহজালাল বিমানবন্দরকেন্দ্রিক।
সোমবার রাজধানীর একটি হোটেলে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে এক্সপোর্টার্স অ্যাসোশিয়েশন অব বাংলাদেশ-ইএবির সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাব্য একটি হিসাব তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “এই অগ্নিকাণ্ডে রপ্তানিকারকদের ক্ষতির পরিমাণ এখনই নির্ধারণ করা কঠিন। সরাসরি ক্ষতি হয়েছে আগুনে পুড়ে যাওয়া পণ্যে, তবে এটি কেবল সরাসরি ক্ষতি নয়, পুড়ে যাওয়া কাঁচামাল থেকে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি হবে না, তাতে আরও বড় ক্ষতি হবে।
“অগ্নিকাণ্ডের কারণে সামনের কয়েকদিন আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম ব্যাহত হবে, বাজারে অবস্থান হারানোর আশঙ্কা রয়েছে, ক্রেতাদের আস্থা কমবে এবং আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো ক্ষতিগ্রস্তহতে পারে।”
তিনি বলেন, “আমরা আমাদের সদস্যদের কাছে জরুরি বার্তা পাঠিয়ে ক্ষতির পরিমাণ জানার চেষ্টা করছি, তবে এখনও পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায়নি। একটি স্বচ্ছ ও পূর্ণাঙ্গ তদন্তের মাধ্যমে সামগ্রিক ক্ষতির সঠিক চিত্র পাওয়া সম্ভব হবে।
“তবুও প্রাথমিকভাবে আমাদের ধারণা-সব মিলিয়ে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার বা বারো হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।”
বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতির মহাসচিব জাকির হোসেন সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, “আমরা ৩২ কোম্পানিকে চিঠি দিয়েছিলাম, কার কী ক্ষতি হয়েছে জানতে। দেখলাম, তাদের ২০০ কোটি মূল্যের কাঁচামাল ‘ভষ্মীভূত’ হয়েছে।”
তিনি বলেন, “সাপ্লাই চেইনে ইমেডিয়েট ঘাটতি হবে না। তবে আগামী তিন থেকে ছয় মাসে ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার কোটি টাকার ফিনিশড গুডস তৈরি ও সাপ্লাইয়ে সংকট দেখা যেতে পারে।”
আরো একটি তদন্ত কমিটি
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো ভিলেজে আগুনের ঘটনা তদন্তে এবার পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর।
ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া কর্মকর্তা শাহজাহান শিকদার সোমবার এক বার্তায় জানিয়েছেন, কমিটিকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
এর আগে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় ও শাহজালালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্বে থাকা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
এছাড়া দেশে কয়েক দিনের মধ্যে বড় ধরনের কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে একটি ‘কোর কমিটি’ গঠন করেছে সরকার। স্বরাষ্ট্র সচিবকে প্রধান করে গঠিত সাত সদস্যের এ কমিটিকে ৫ নভেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
সংগৃহিত
