অগ্নিকাণ্ডে ১২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়ে থাকতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন রপ্তানিকারকরা।
হতে সংগৃহিত
ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দেশের রপ্তানিকারকরা যেমন শঙ্কিত, বিদেশি ক্রেতারাও উদ্বিগ্ন বলে জানিয়েছে এক্সপোর্টার্স অ্যাসোশিয়েশন অব বাংলাদেশ-ইএবি।
সোমবার রাজধানীর একটি হোটেলে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে সংগঠনটির সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম এ বিষয়ে কথা বলেন, যিনি বিকেএমইএ’রও সভাপতি।
হাতেম বলেন, “বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আমাদের ব্যবসায়ী সমাজ ও রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য এক বড় সতর্কবার্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
“আমরা শঙ্কিত। এবং আমাদের বৈদেশিক ক্রেতারাও উদ্বিগ্ন।”
হাতেম বলেন, “এ ধরনের ঘটনা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে কার্গো ভিলেজের নিরাপত্তা ব্যবস্থা যথেষ্ট কার্যকর নয় এবং এটি নিরাপত্তার দিক থেকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
“একইভাবে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।”
খাতভিত্তিক সংগঠনগুলোর এপেক্স বডি বিকেএমইএ, বিজিএমইএ, বিটিএমএ, বিজিপিএমইএ, লেদার অ্যান্ড লেদার গুডস, ফুট অ্যান্ড ভেজিটেবলস, ঔষধ শিল্প, জুয়েলারি এক্সপোটার্স, সুয়িং থ্রেড, ফ্রোজেন ফুডস, প্লাস্টিক গুডস, সিল্ক গুডস, হস্তশিল্প, ক্রাফট অ্যান্ড গিফ্টওয়্যার ইত্যাদি অ্যাসোসিয়েশনসহ সংশ্লিষ্ট সকল সংগঠন মিলে যৌথভাবে এ সংবাদ সম্মেলন করে।
গত শনিবারের ওই অগ্নিকাণ্ডে ১২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়ে থাকতে পারে বলে সংগঠনগুলোর প্রাথমিক ধারণা বলে তুলে ধরা হয়।
হাতেম বলেন, “এই অগ্নিকাণ্ডে রপ্তানিকারকদের ক্ষতির পরিমাণ এখনই নির্ধারণ করা কঠিন। সরাসরি ক্ষতি হয়েছে আগুনে পুড়ে যাওয়া পণ্যে, তবে এটি কেবল সরাসরি ক্ষতি নয়, পুড়ে যাওয়া কাঁচামাল থেকে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি হবে না, তাতে আরও বড় ক্ষতি হবে।
“অগ্নিকাণ্ডের কারণে সামনের কয়েকদিন আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম ব্যাহত হবে, বাজারে অবস্থান হারানোর আশঙ্কা রয়েছে, ক্রেতাদের আস্থা কমবে এবং আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।”
তিনি বলেন, “আমরা আমাদের সদস্যদের কাছে জরুরি বার্তা পাঠিয়ে ক্ষতির পরিমাণ জানার চেষ্টা করছি, তবে এখনও পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায়নি। একটি স্বচ্ছ ও পূর্ণাঙ্গ তদন্তের মাধ্যমে সামগ্রিক ক্ষতির সঠিক চিত্র পাওয়া সম্ভব হবে।
“তবুও প্রাথমিকভাবে আমাদের ধারণা-সব মিলিয়ে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার বা বারো হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।”
এক্সপোর্টার্স অ্যাসোশিয়েশন অব বাংলাদেশ-ইএবির সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম
ওষধ শিল্পের ‘২০০ কোটি টাকার’ কাঁচামাল ভষ্মীভূত
বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতির মহাসচিব জাকির হোসেন বলেন, “আমরা ৩২ কোম্পানিকে চিঠি দিয়েছিলাম, কার কী ক্ষতি হয়েছে জানতে। দেখলাম, তাদের ২০০ কোটি মূল্যের কাঁচামাল ‘ভষ্মীভূত’ হয়েছে।”
তিনি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে ছুটির দিনগুলোতে কাস্টম হাউজের শুল্কায়ন বন্ধ রাখার সমালোচনা করেন।
জাকির বলেন, “২৪ ঘণ্টাই চালু রাখতে হবে। স্বল্প পরিসরে হলেও। আমরা এর জন্য বাড়তি টাকা দিতে হলে তাও দিতে প্রস্তুত।”
নয়ত ফের ভয়াবহ এমন আগুনে জনস্বাস্থ্যের গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের সরবরাহে ঘাটতি দেখা যেতে পারে বলেও তিনি সতর্ক করেন।
নিজের কোম্পানির ক্ষতির তথ্য তুলে ধরে ঔষধ শিল্প সমিতির মহাসচিব বলেন, “আমার একটা নারকোটিক আইটেম পুড়ে গেছে। এখন আবার এটার আমদানির অনুমতি নেওয়া, নারকোটিক্স অ্যান্ড ড্রাগস থেকে পাস করাইয়া বিদেশ থেকে আনা তিন থেকে চার মাস সময়ের ব্যাপার। অনেক লম্বা সময়।”
তিনি বলেন, “সাপ্লাই চেইনে ইমেডিয়েট ঘাটতি হবে না। তবে আগামী তিন থেকে ছয় মাসে ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার কোটি টাকার ফিনিশড গুডস তৈরি ও সাপ্লাইয়ে সংকট দেখা যেতে পারে।”
‘সরকারি দপ্তরগুলো দায় এড়াতে পারে না’
ইএবি সভাপতি হাতেম বলেন, “এই অগ্নিকাণ্ডের দায় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (সিএএবি), কাস্টম হাউস এবং বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস-কেউই এড়াতে পারে না।
“কারণ, সিএএবি এই কার্গো ভিলেজের মালিক, কাস্টমস কর্তৃপক্ষ আমদানিকৃত পণ্যের তত্ত্বাবধায়ক, আর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস হলো হ্যান্ডলিং এজেন্ট।”
এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট কেউ ‘যথাযথ মনোযোগ দেয়নি’ বলে অভিযোগ করেন হাতেম।
তার ভাষ্য, “বর্তমান গুদাম ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত দুর্বল এবং এখনো ম্যানুয়ালি পরিচালিত হয়। এছাড়া কাস্টমস ছাড়পত্র প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার কারণে প্রচুর পণ্য জমে থাকে, ফলে সীমিত স্থানের সংকট আরও তীব্র আকার ধারণ করে।
“কেমিকেল ও ওষুধের কাঁচামালের মত স্পর্শকাতর পণ্যের গুদাম আলাদা, অধিক সুরক্ষিত এবং নিরাপদ দূরত্বে স্থাপন করা উচিত ছিল। এই ঘটনায় শুধু আর্থিক ক্ষতিই হয়নি; দেশের ভাবমূর্তিও মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ হয়েছে।”
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের দ্রুত তদন্তের মাধ্যমে শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানান।
ইএবির ৬ দাবি
ইএবি সভাপতি বলেন, “এ ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত ও ক্ষতির নিরূপণ শেষে দ্রুত ছয়টি পদক্ষেপ বাস্তবায়নের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।”
১. অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত পণ্যের বিপরীতে করা বীমা দাবি দ্রুত নিষ্পত্তির প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া।
২. যেসব পণ্যের বীমা করা ছিল না, সেগুলোর ক্ষেত্রে সরকারি বিশেষ তহবিল গঠন করে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ ও সহায়তা দেওয়া।
৩. ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে কার্গো ভিলেজের আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ।
৪. ঔষধ শিল্পের জন্য আধুনিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আলাদা গুদামের ব্যবস্থা করা।
৫. নিরাপদ দূরত্বে রাসায়নিক গুদাম স্থাপন।
৬. কার্গো ভিলেজের গুদাম ব্যবস্থাপনাকে সম্পূর্ণ অটোমেটেড ও আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর করা।
