লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়িতে করে মরদেহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে নেওয়ার পর গাড়িটি তা ঘিরে ঘরেন সহপাঠীরা।
হতে সংগৃহিত
কফিনবন্দি হয়ে পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী জুবায়েদ হোসাইনকে যখন ক্যাম্পাসে এলেন, তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে তখন হাজারো শিক্ষার্থী। ছিলেন শিক্ষক, পরিবারের সদস্যরাও। তাকে শেষ বিদায় জানানো হয় সেখানেই।
পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় ছুরিকাঘাতে নিহত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জুবায়েদ হোসাইনের মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নেওয়া হয় সোমবার দুপুরে।
লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়িতে করে মরদেহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে নেওয়ার পর গাড়িটি ঘিরে ঘরেন সহপাঠীরা।
বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য তৈরি করা প্যান্ডেলেই বাদ জোহর জানাজা সম্পন্ন হয়েছে। এরপর দাফনের জন্য জুবায়েদের মরদেহ কুমিল্লায় তার গ্রামের বাড়িতে নেওয়া হবে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক রইছ উদদীন বলেন, “জুবায়েদের এই পরিণতি আমরা কেউ কল্পনা করতে পারিনা। তাকে সামনে নিয়ে তার জানাজার নামাজের পূর্বে কথা বলব এটা আমরা ভাবিনি। তাকে তো আমি অনার্স এবং মাস্টার্স ডিগ্রি দিয়ে সমাবর্তনে গাউন পরিয়ে দেওয়ার কথা, আজ কেন তার এমন হল। আমরা বিগত ফ্যাসীবাদী আমলে লাশ সিঁড়িতে পড়ে থাকতে দেখেছ। তার থেকে মুক্তির জন্যেই তো আমরা আন্দোলন করেছি। তবে জুলাই গণহত্যার পরে আজ কেন তার লাশ ঘন্টার পর ঘন্টা সিঁড়িতে পড়ে থাকে?”
জুবায়েদ হত্যার ঘটনায় একদিনের শোক ঘোষণা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সেই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে।
রইছ উদদীন বলেন, “আমাদের সন্তানের অনাকাঙ্ক্ষিত এই মৃত্যুতে আমরা শোক ঘোষণা করেছি। আগামীকাল শোক সভা হবে, আর এর পরের দিন আমরা প্রতিবাদ শোভযাত্রা করবো। আমরা প্রশাসনকে বলে দিতে চাই আমাদের এই কর্মসূচিই শেষ না।”
জুবায়েদের হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় না আনা পর্যন্ত হাল না ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছেন এই অধ্যাপক।
তিনি বলেন, “আমাদের শিক্ষার্থীর জীবনের নিরাপত্তার স্বার্থে যা করার কথা আমরা শিক্ষকরা তা করে যাব। দ্রুত বিচারের অগ্রগতি না দেখলে প্রয়োজনে পুরো ঢাকা ব্লকেট কর্মসূচি আমি ঘোষণা করবো।”
উপাচার্য অধ্যাপক মো. রেজাউল করিম বলেন, “আমরা আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীকে স্পষ্ট ভাষায় বলেছি খুনিদের যেন দ্রুত আইনের আওতায় আনা হয়। জুবায়েদের মত একটি ছেলের শত্রু থাকতে পারে তা আমার জানা ছিল না। আমরা তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর বেদনা জ্ঞাপন করছি।”
জুবায়েদ হোসাইনের বাবা মো. মোবারক হোসেন বলেন, “আমার ছেলে মরে গেছে। একটা ছুরির আঘাতে আমার সকল আশা ভরসা শেষ করে দিছে। আমার ছেলে ছোট বেলা থেকেই একদম শান্ত-শিষ্ট ছিল; পান, বিড়ি, সিগারেট এসব থেকে দূরে ছিল।
আমি আমার ছেলেকে দিয়েছিলাম, আমার ছেলে এই ভার্সিটিতে লেখাপড়া করে অনেক বড় হবে; কিন্তু আমার ছেলে আজ লাশ। এই শোক আমি কিভাবে সইব!
“আমি কাল সারারাত থানায় কাটিয়েও কোনো মামলা করতে পারিনি। আমি প্রকৃত খুনির বিচার চাই। আমার ছেলেকে যে মারছে আমি তার বিচার চাই।”
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে বিচার দাবি করে মোবারক হোসেন বলেন, “আর কোনো পরিবারকে যেন এরকম কাঁদতে না হয়।”
জুবায়েদের জানাজা শেষে সংক্ষিপ্ত এক সংবাদ সম্মেলনে তাঁক হত্যার তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে লালবাগ জোনের ডিসি বলেন, “ইনসাফের প্রশ্নে কোন ছাড় দেওয়া হবে না। আপনাদের চোখে অনেকেই অপরাধী; আমরা ভিন্নভাবে দেখি। আমাদের চোখে যারা অপরাধী তাদেরকে ধরার চেষ্টা করতেছি এবং খুব দ্রুতই আপনারা সুসংবাদ পাবেব।
“সকালে তদন্ত দলের সাথে আমার কথা হয়েছিল তারা আমাকে আগামীকাল সকাল দশটার মধ্যে আপডেট দিবেন। আমি এখানে আসার আগে ও পরে দুটি সুসংবাদ পেয়েছি। সব সুসংবাদ তদন্তের স্বার্থে আমরা আপনাদেরকে দিতে পারতেছি না।”
নিহত জুবায়েদ হোসাইন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ছিলেন। এছাড়া কুমিল্লা জেলা ছাত্র কল্যাণ সংসদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন।
বছর খানেক ধরে জুবায়েদ পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় ওই ছাত্রীকে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান পড়াতেন। রোববার বিকাল পৌনে ৫টার দিকে ওই ছাত্রীর বাসার নিচে ছুরিকাঘাতের শিকার হন জুবায়েদ। এ অবস্থাতেই ওই বাসার তিনতলা পর্যন্ত উঠতেই তার মৃত্যু হয়।
পুলিশ ওই বাসায় ওই ছাত্রী ও তার পরিবারের সদস্যদের প্রায় ৫ ঘণ্টা ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এরপর রাত ১১টায় ওই ছাত্রীকে হেফাজতে নেয় পুলিশ।
জুবায়েদ হোসাইনকে তার ছাত্রী ‘পছন্দ করতেন’ জানিয়ে পুলিশ বলছে, সেই ক্ষোভে ওই ছাত্রীর ‘প্রেমিক’ তার বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে জুবায়েদকে হত্যা করে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে মেয়েটি দাবি করেছে, এই খুনের বিষয়ে তিনি কিছুই জানতেন না।
