‘তোমার হল শুরু আমার হল সারা’- বিষয়টা মোটেও সত্যি না।
হতে সংগৃহিত
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবনের গতি ধীরে আসে, শরীরেও নানান পরিবর্তন দেখা দেয়। তবে সুখ, মানসিক শান্তি, ও শারীরিক সুস্থতা কি সত্যিই বয়সের সঙ্গে হারিয়ে যায়?
কানাডায় করা এক গবেষণা বলছে- না, বরং সঠিক যত্ন ও মানসিক ইতিবাচকতা থাকলে জীবনের পরবর্তী সময়েও ফিরে পাওয়া যায় পূর্ণ সুস্থতা ও আনন্দ।
বয়স বাড়লেও সম্ভব সুখী ও সুস্থ থাকা
সাধারণভাবে ভাবা হয়, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের শক্তি, মনোযোগ ও আনন্দ কমে যায়।
তবে কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফ্যাক্টর–ইনউইন্টাশ ফ্যাকাল্টি অব সোশ্যাল ওয়ার্ক’ এবং ‘ইন্সটিটিউট অব লাইফ কোর্স অ্যান্ড এইজিং’–এর গবেষক ডা. ম্যাবেল হো এবং ডা. এসমি ফুলার–থমসন এর নতুন এক গবেষণা এই ধারণাকে বদলে দিয়েছে।
সিএনএন ডটকম-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে গবেষণার বরাত দিয়ে জানানো হয়, যেসব বয়স্ক ব্যক্তি প্রথমে সুস্থতা ও সুখের দিক থেকে পিছিয়ে ছিলেন, তাদের মধ্যে প্রতি চারজনের একজন মাত্র তিন বছরের মধ্যেই আগের চেয়ে অনেক ভালো অবস্থায় ফিরে গেছেন।
অর্থাৎ, ৬০ বছরের পরও মানুষ শারীরিক ও মানসিকভাবে পুনরায় ভালো হতে পারেন, যদি তারা ইতিবাচক মানসিকতা ধরে রাখেন এবং জীবনযাপনে কিছু পরিবর্তন আনেন।
এই গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে পিএলওএস ওয়ান নামের আন্তর্জাতিক গবেষণা সাময়িকীতে।
যেভাবে করা হয়েছিল গবেষণা
গবেষণাটি ছিল ‘কানাডিয়ান লংগিটিউডিনাল স্টাডি অন এইজিং’–এর তথ্য বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে।
এখানে ৮ হাজারেরও বেশি বয়স্ক মানুষের জীবনযাপন, মানসিক অবস্থা ও শারীরিক পরিবর্তনের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল।
গবেষকরা বলছেন, ‘অপটিমাল ওয়েল–বিইং’ বা সর্বোত্তম সুস্থতা বলতে বোঝানো হয়েছে এমন একটি অবস্থাকে, যেখানে একজন মানুষ সামাজিকভাবে সংযুক্ত, বয়স সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণাসম্পন্ন, শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ, সুখী ও জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট এবং দৈনন্দিন কাজ করতে পারেন বিনা বাধায়।
ইতিবাচক মনোভাবই বড় প্রভাব ফেলে
ডা. ম্যাবেল হো, যিনি টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফ্যাক্টর–ইনউইন্টাশ ফ্যাকাল্টি অব সোশ্যাল ওয়ার্ক’ থেকে ডক্টরেট সম্পন্ন করেছেন, তিনি বলেন, “যেসব মানুষের শুরুতেই মানসিক ও আবেগিক শক্তি বেশি ছিল, তারা গবেষণার শেষে প্রায় পাঁচগুণ বেশি সম্ভাবনা পেয়েছেন সর্বোত্তম সুস্থতায় পৌঁছানোর।”
অর্থাৎ, মানসিক স্থিতি ও ইতিবাচক চিন্তাভাবনা শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।
তিনি আরও বলেন, সুস্থতা ফিরিয়ে আনার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে— সহায়ক সম্পর্ক ও সামাজিক যোগাযোগ, আর্থিক নিরাপত্তা, নিয়মিত শরীরচর্চা, ধূমপান ত্যাগ এবং ভালো ঘুম।
বয়স হলেও পরিবর্তন সম্ভব
গবেষণার প্রধান সহলেখক ডা. এসমি ফুলার–থমসন, যিনি টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইন্সটিটিউট ফর লাইফ কোর্স অ্যান্ড এইজিং’–এর পরিচালক, বলেন, “আমাদের গবেষণা দেখায়, বয়স যতই বাড়ুক না কেন, মানুষ তার জীবনযাত্রা পরিবর্তন করে আবারও সর্বোত্তম সুস্থতা ফিরে পেতে পারেন।”
তিনি আরও যোগ করেন, এই গবেষণা শুধু চিকিৎসকদের জন্য নয় বরং বয়স্ক মানুষ, তাদের যত্নদাতা এবং নীতি-নির্ধারকদের জন্যও আশার বার্তা। কারণ এটি প্রমাণ করে যে, সঠিক সহায়তা ও জীবনযাপনের অভ্যাস গড়ে তুললে পুনরায় সুখ ও স্বাস্থ্যের পথে ফেরা সম্ভব।
একা নয়, সম্পর্কই রাখে প্রাণ
বয়স বাড়লে অনেক সময় একাকিত্ব সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যাশনাল জিউইশ হেল্থ, ডেনভার’–এর কার্ডিওভাসকুলার প্রতিরোধ ও সুস্থতা বিভাগের পরিচালক ডা. অ্যান্ড্রু ফ্রিম্যান বলেন, “মন–দেহের সংযোগকে প্রায়ই অবমূল্যায়ন করি। মানসিক অশান্তি শরীরেও প্রভাব ফেলে। তাই রোগের শুরু মন থেকেই।”
গবেষণায় দেখা গেছে, ৫০ বছর বা তার বেশি বয়সি যারা দীর্ঘসময় একাকী থাকেন, তাদের স্ট্রোকের ঝুঁকি ৫৬ শতাংশ বেশি।
অন্যদিকে, যারা নিয়মিত সামাজিক যোগাযোগে থাকেন ও চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখেন, তাদের মধ্যে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা অনেক ভালো থাকে। বিশেষত আলৎঝেইমার’স বা স্মৃতিভ্রংশের প্রাথমিক স্তরে।
জীবনযাপনের ছোট পরিবর্তনেই বড় ফল
বয়সে পৌঁছানোর পরেও শরীর ও মন সুস্থ রাখতে তিনটি জিনিস সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ- নিয়মিত ব্যায়াম, পর্যাপ্ত ঘুম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস।
এছাড়া ধূমপান বন্ধ করা, অবসাদ ও নিদ্রাহীনতা কমানো এবং বন্ধু বা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখা অত্যন্ত কার্যকর।
ডা. জয়েস ওয়েন–হসিয়াও, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইয়েল মেডিসিন’–এর কার্ডিওলজিস্ট, বলেন, “সুস্থ জীবনযাপন শুরু হতে পারে শুধু হাঁটা বাড়ানো দিয়েই।”
অর্থাৎ, জটিল ব্যায়াম নয় প্রতিদিন হাঁটা, কিছুটা সক্রিয় থাকা এবং সামাজিক সম্পর্ক রক্ষা করাই দীর্ঘায়ু ও সুখের মূল চাবিকাঠি।
গবেষণার সীমাবদ্ধতা
তবে গবেষকরা স্বীকার করেছেন, এই ফলাফল কানাডার মতো উন্নত দেশের প্রেক্ষাপটে পাওয়া গেছে, যেখানে সবাই সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার সুবিধা পান।
তাই এটি উন্নয়নশীল দেশের বয়স্ক জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে কতটা প্রযোজ্য হবে, তা জানতে আরও গবেষণা প্রয়োজন।
ডা. ম্যাবেল হো বলেন, “এই গবেষণা উচ্চ–আয়ের দেশে বসবাসরত মানুষের জীবনধারা ও স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার প্রেক্ষিতে করা। তাই নিম্ন ও মধ্য–আয়ের দেশে স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক সহায়তার পার্থক্য থাকায় ফলাফল এক রকম নাও হতে পারে।”
বয়স নয়, মানসিকতাই আসল
গবেষণার সারকথা হল- বয়স বাড়া মানেই অবনতি নয়। বরং এটি হতে পারে নতুন করে বেড়ে ওঠা ও পুনর্জীবনের সময়।
ডা. ম্যাবেল হো’র ভাষায়, “আমাদের গবেষণা দেখায়- বৃদ্ধ বয়সেও মানুষ সুস্থতা ফিরে পেতে পারেন। এটি বয়সজনিত পতনের গল্প নয়, বরং পুনরুদ্ধার ও উন্নতির গল্প।”
