বর্তমান পরিস্থিতিকে ‘স্থানীয় প্রাদুর্ভাব’ হিসেবে চিহ্নিত করে স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ প্রবণতা চলতে পারে।

Published : 31 Jul 2025, 08:58 AM
জুন ও জুলাই দুই মাসে চট্টগ্রামে ৯৮৪ জন চিকুনগুনিয়ার রোগী শনাক্ত হয়েছে, যা এ জেলায় সারা বছরে শনাক্ত ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে গেছে।
চট্টগ্রাম জেলায় জানুয়ারি থেকে বুধবার পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে ৮৬৫ জন। তাদের মধ্যে ৮ জন মারা গেছেন। চলতি মাসেই মারা গেছেন ছয় জন।
বুধবার চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত এক দিনে জেলায় ১০৯ জন চিকুনগুনিয়া রোগী শনাক্ত হয়েছে, যা এবছরের সর্বোচ্চ। শেষ ৫ দিনে শনাক্ত হয়েছে ৩১৫ জন চিকুনগুনিয়া রোগী।
চিকিৎসকরা বলছেন, এ বছর মশার ঘনত্ব বেশি থাকা, প্রলম্বিত বৃষ্টি, বৃষ্টির বিরতিতে অতিরিক্ত তাপমাত্রা, মশা নিধনে কার্যকর উদ্যোগ না থাকা এবং পরিচ্ছন্নতার অভাবে চিকুনগুনিয়ার সংক্রমণ বাড়ছে।
বর্তমান পরিস্থিতিকে ‘স্থানীয় প্রাদুর্ভাব’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। ডেঙ্গুর তুলনায় চিকুনগুনিয়ার সংক্রমণ এবার বেশিই থাকবে এবং তা অন্তত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এর ‘র্যাপিড রেসপন্স টিম’ ১২ থেকে ১৮ জুলাই নগরীর চট্টেশ্বরী রোড, ও আর নিজাম রোড, আগ্রাবাদ, পাহাড়তলী, হালিশহর ও ঝাউতলা এলাকার ১২৮টি বাড়ি পরিদর্শন করে ৬২টি বাড়িতে এইডিস মশার লার্ভা পায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত ব্রুটো ইনডেক্স (বিআই) হল একটি কীটতাত্ত্বিক সূচক, যা মশার লার্ভা এবং পিউপা, বিশেষ করে এইডিস মশার ঘনত্ব পরিমাপে ব্যবহার করা হয়।
ব্রুটো ইনডেক্স ২০ এর বেশি হলে একটি এলাকাকে ‘উচ্চ ঝুঁকির’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জরিপ চালানো বাড়িগুলোতে গড় ব্রুটো ইনডেক্স পাওয়া গেছে ৭৫ দশমিক ২৯।
প্রাপ্ত লার্ভা নমুনায় প্রজাতিভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৬৫ শতাংশই ছিল এডিস ইজিপ্টাই, ৩২ দশমিক ৬৪ শতাংশ এইডিস এলবোপিকটাস এবং ২ দশমিক ৮৬ শতাংশ নমুনায় উভয় প্রজাতির মিশ্র উপস্থিতি পাওয়া যায়।
এইডিস ইজিপ্টাই ও এইডিস এলবোপিকটাস এই দুই প্রজাতির মশাই ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের বাহক।
চট্টগ্রামের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ তৌহিদুল আনোয়ার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যে সংখ্যায় চিকুনগুনিয়া রোগী বর্তমানে শনাক্ত হচ্ছে, সেটাকে স্থানীয় বা আঞ্চলিক আউটব্রেক বলা যেতে পারে। বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়গনস্টিক সেন্টারগুলো থেকে আমরা শনাক্তের যে তথ্য পাচ্ছি তাতে জানা যাচ্ছে, নগরীর পাশাপাশি বিভিন্ন উপজেলাতেও চিকুনগুনিয়া ছড়িয়ে পড়েছে।
ডেঙ্গুর চেয়েও চিকুনগুনিয়ার রোগী বেশি হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া একই ধরনের মশার মাধ্যমে বিস্তার লাভ করে। চট্টগ্রামে এইডিস মশার ঘনত্ব অনেক বেশি। তাই চিকুনগুনিয়া বাড়ছে।
“চিকুনগুনিয়ার বাড়তে থাকলে ডেঙ্গু রোগী কমবে। এটাই সাধারণ প্রবণতা। বৃষ্টি একেবারে থেমে যাওয়ার ১৪দিন পর পর্যন্ত এইডিস মশার বংশ বৃদ্ধির সময়। আবহাওয়ার যে পূর্বাভাস দেখা যাচ্ছে, তাতে ধারণা করছি সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চিকুনগুনিয়ার সংক্রমণ থাকতে পারে।”
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস (বিআইটিআইডি) এর ক্লিনিক্যাল ট্রপিক্যাল মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. মামুনুর রশীদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার ভাইরাস ভিন্ন। কিন্তু বাহক একই- এইডিস মশা। এবার বৃষ্টিপাত ও আর্দ্রতার কারণে এইডিস মশার সংখ্যা বেড়েছে।
“২০২৩ সালের এই সময়ে দেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ অনেক বেশি ছিল। গতবছরও ডেঙ্গু রোগী বেশি ছিল। এবার চিকুনগুনিয়া রোগী ডেঙ্গুর চেয়ে বেশি। এটা দুই ধরনের ভাইরাসের মধ্যে ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স (পরিবেশগত ভারসাম্য) হয়ে থাকতে পারে। তবে সেটা নিশ্চিত হতে হলে গবেষণা প্রয়োজন।”
বর্তমানে চিকুনগুনিয়া সংক্রমণের পরিস্থিতি তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমাদের হাসপাতালে প্রতিদিন জ্বর নিয়ে যত রোগী আসে, তারমধ্যে ৪০ শতাংশই চিকুনগুনিয়ার রোগী। চেম্বারে প্রতিদিন অর্ধেকের বেশি রোগী আসছে জ্বর নিয়ে। জ্বরে আক্রান্ত রোগীর মধ্যে ৫০ শতাংশই চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত।
“ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুর হার তুলনামূলক বেশি। সে তুলনায় চিকুনগুনিয়ায় মৃত্যুর হার খুবই কম। চিকুনগুনিয়া রোগীর জ্বর চলে গেলেও জয়েন্ট ব্যথা ও ফোলা দু-তিন মাস পর্যন্ত থাকতে পারে। কিন্তু আক্রান্ত ব্যক্তির অন্য কোনো রোগ থাকলে সেক্ষেত্রে প্রভাব পড়ার আশঙ্কা থাকে।”
চট্টগ্রামে চিকুনগুনিয়া রোগীর সংখ্যা লাফিলে বাড়লেও এখন পর্যন্ত সরকারি হাসপাতালে শনাক্তকরণ পরীক্ষা শুরু হয়নি। তাতে রোগীদের চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে।
সোমবার জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ে নগরীর ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালের রোগ নির্ণয় কেন্দ্রগুলোর প্রতিনিধিদের সাথে এক সভায় চিকুনগুনিয়া নির্ণয়ে আরটিপিসিআর পরীক্ষার ফি সর্বোচ্চ সাড়ে চার হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়।
ডা. মামুনুর রশীদ বলেন, “বেসরকারি পর্যায়ে আরটিপিসিআর পরীক্ষার খরচ অনেক বেশি। সরকারি পর্যায়ে পরীক্ষা চালু করা গেলে খুব ভালো হত।”
চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণে করণীয় নির্ধারণে স্বাস্থ্য বিভাগের উদ্যোগে বৃহস্পতিবার সভা আহ্বান করা হয়েছে।
ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. তৌহিদুল আনোয়ার বলেন, মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশন, স্বাস্থ্য বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সমন্বয়ে উদ্যোগ প্রয়োজন। পাশাপাশি মশার ওষুধ ছিটানোতে আরো কার্যকর উদ্যোগ লাগবে।
“দেশের গড় তাপমাত্রা বাড়ছে। বৃষ্টি থামলেই রোদ উঠছে এবং অতিরিক্ত গরম পড়ছে। যা মশার বৃদ্ধির জন্য অতি অনুকূল। নগরায়ন হলেও চট্টগ্রামে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নেই। শহরের পাশাপাশি উপজেলাগুলোতেও মশাবাহিত রোগ বাড়ছে। এসব বিষয়ে সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকলে এসব রোগ দিন দিন বাড়বে।”
নগরীর মশা নিয়ন্ত্রণে ২৪ জুলাই থেকে ২৬ দিনব্যাপী ক্রাশ প্রোগ্রাম শুরু করেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন।