এক বছর ধরে বিলের টাকা না পেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন আটটি ড্রেজার ও তিনটি বেকু মেশিনের মালিকসহ দুই শতাধিক শ্রমিক।

Published : 31 Jul 2025, 10:15 AM
সিরাজগঞ্জে ভাঙন রোধে সাবেক সংসদ সদস্যের মৌখিক নির্দেশে যমুনা নদীর শাখা বা খাল ভরাট করে বিপাকে পড়েছেন শ্রমিক ও ড্রেজার-ভেকু মেশিনের মালিকরা।
গত বছরের মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত কাজিপুর উপজেলার প্রত্যন্ত চরাঞ্চলের তেকানি খেয়া ঘাট সংলগ্ন এলাকায় যমুনা নদীর খাল ভরাট করে মাটির বাঁধ নির্মাণের এ কাজ হয়। কোনো সরকারি প্রকল্প গ্রহণ না করেই এ নির্মাণ কাজের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তৎকালীন স্থানীয় সংসদ সদস্য প্রকৌশলী তানভীর শাকিল জয়।
ভরাটের কাজ চলাকালে চারটি পিআইসি কমিটির মাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের ৮৬ লাখ টাকা বিলও দিয়েছিলেন। কিন্তু ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে সরকার পতনের পর তিনি আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় আটকে যায় শ্রমিকদের মজুরির বাকি তিন কোটি টাকা।
ফলে এক বছর ধরে বিলের টাকা না পেয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন আটটি ড্রেজার ও তিনটি বেকু মেশিনের মালিকসহ দুই শতাধিক শ্রমিক।
সম্প্রতি সরেজমিনে কাজিপুর উপজেলার প্রত্যন্ত চরাঞ্চলের নাটুয়ারপাড়া, তেকানি ও নিশিন্তপুর ইউনিয়নের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০২০ সাল থেকে বর্ষায় যমুনার শাখা নদীর ভাঙনের কবলে পড়ে ইউনিয়নগুলোর বাসিন্দারা।
এতে হাজারখানেক বসতবাড়ি, চারটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তেকানি উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিকসহ প্রায় দেড়শ একর জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়।
তখন ক্ষতিগ্রস্তরা তেকানী ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে বহমান যমুনার শাখা নদী বন্ধ করার জন্য মাঝখান দিয়ে ৪০ মিটার প্রস্থ ও ৩ হাজার ৫০০ মিটার দৈর্ঘ্যের মাটির বাঁধ নির্মাণের দাবি করেন।
তখন জনগণের দাবির মুখে কোনো সরকারি প্রকল্প গ্রহণ না করেই বাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন সিরাজগঞ্জ-১ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য তানভীর শাকিল জয়।
তার মৌখিক নির্দেশে ২০২৪ সালের ১৯ মার্চ থেকে তেকানি খেয়া ঘাট থেকে পশ্চিম-উত্তর দিকে তেকানি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং একই ঘাটের পশ্চিম দিকে তেকানি চর পর্যন্ত তিন হাজার ৫০০ মিটার মাটির বাঁধ নির্মাণ বা খাল ভরাটের কাজ শুরু করেন দুই শতাধিক শ্রমিক।

আটটি ড্রেজার ও তিনটি ভেকু মেশিন ব্যবহার করে এই কাজ চলমান অবস্থায় সরকারি বিধিমতে প্রকল্প বাস্তবায়নে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানদের সভাপতি করে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট পৃথক চারটি পিআইসি কমিটি গঠন করেন তানভীর শাকিল জয়।
উপজেলা ত্রাণ ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে ওই চারটি পিআইসি কমিটি প্রকৌশলীদের পরামর্শে বাঁধ নির্মাণ করতে থাকে।
এর মধ্যে ২০২৪ সালের ২৫ মার্চ সংসদ সদস্যর বরাদ্দ থেকে ৩৬ লাখ এবং জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শাখা থেকে ৫০ লাখ মোট ৮৬ লাখ টাকা সংশ্লিষ্টদের বিল দেওয়া হয়।
পরে জুনের শেষ দিকে ভরাট কাজ শেষে পিআইসি কমিটির হিসাবে নির্মাণ ব্যয় দাঁড়ায় তিন কোটি ৯৮ লাখ টাকা। কিন্তু সে টাকা পরিশোধের আগেই আত্মগোপনে চলে যান সংসদ সদস্য, প্রকল্পের সভাপতি ও সদস্যসচিবরা।
তৎকালীন সংসদ সদস্যর পক্ষ থেকে নির্মাণ কাজে জড়িত পিআইসি কমিটিগুলির দেখাশোনার দায়িত্ব পেয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুস সালাম বিএসসি।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাঁধটি সঠিকভাবে সম্পূর্ণ করতে সাবেক এমপি তানভীর শাকিল জয় আমাদের এখানে দেখাশুনা করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ৮৬ লাখ টাকাও আমার হাতে দিয়েছেন। আমরা ড্রেজার-বেকু মেশিনের মালিক ও শ্রমিকদের সেই টাকা দিয়েছি। কিন্তু এখনো তিন কোটি টাকা মজুরি বাকি রয়েছে।”
এ অবস্থায় পাওয়া টাকা না পেয়ে সংশ্লিষ্টরা মানবেতর জীবনযাপন করছে জানিয়ে সরকারি ব্যবস্থাপনায় এ টাকা পরিশোধের জন্য দাবি করেন তিনি।
ড্রেজার মালিক জাহিদুল ইসলাম কুড়ান বলেন, “সাবেক এমপির নির্দেশে আমরা আটজন মালিক আটটি ড্রেজার দিয়ে বালু ফেলেছি। কিন্তু এখনো মজুরির দুই কোটি ৬৫ লাখ টাকা পাইনি।
“ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অফিসে গিয়ে জেনেছি, তারা কিছু টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল। কিন্তু বাকি টাকা বরাদ্দের কোনো হদিস নেই। আমরা শ্রমজীবী মানুষ, এই টাকা না পেলে পথের ফকির হয়ে যাব।”
ভেকু মেশিনের মালিক মো. সোহেল বলেন, “তিনটি ভেকু দিয়ে বাঁধ নির্মাণে কাজ করেছি। বাঁধ নির্মাণও শেষ, তখনই আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে। এমপিও আত্মগোপনে চলে গেছেন। মজুরির কিছু টাকা পেয়েছি, অধিকাংশ টাকাই এখনো বাকি। টাকা না পেয়ে খুব কষ্টে আছি।”
এ নির্মাণকাজে জড়িত শ্রমিক ফারুক, জসিম, ময়দানসহ অনেকে বলেন, যাদের আশ্বাসে তারা কাজ করেছেন, তারা এখন পালিয়ে গেছে। পাওনা পারিশ্রমিকের জন্য তারা এখন কার কাছে যাবেন সে দিশা পাচ্ছেন না।
তাদের দাবি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতিনিধিরা সরেজমিন তদন্তপূর্বক বাঁধ নির্মাণের মজুরির টাকা পরিশোধ করবে।
ভরাট করা এলাকা পরিদর্শন করে এসে ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ সিরাজগঞ্জ জেলা শাখার সাবেক সভাপতি মুফতি মুহিবুল্লাহ বলেন, “এমপি জয় সরকারি প্রকল্প গ্রহণ না করেই চরাঞ্চলের তেকানি বাঁধ নির্মাণ করেছেন। যে কারণে ড্রেজার ও ভেকু মেশিনের মালিক ও শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরি না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
“তবে শ্রমিকরা তো কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত নয়। তারা শ্রম দিয়ে বাঁধটি নির্মাণ করেছেন। এতে এলাকার মানুষ ভাঙন থেকে রক্ষা পেয়েছে। তাই শ্রমিকদের প্রাপ্ত মজুরি দিতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।”
তৎকালীন সিরাজগঞ্জ জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা (বর্তমানে টাঙ্গাইলে কর্মরত) মো. আকতারুজ্জামান মঙ্গলবার বিকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ক্যানেল ভরাটে বাঁধ নির্মাণের সময় আমরা এলাকাটি পরিদর্শন করেছিলাম। ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বিশেষ বরাদ্দ পাওয়া ৫০ লাখ টাকাও পরিশোধ করা হয়েছে। অতিরিক্ত খরচের টাকা বরাদ্দ হয়নি, তাই সংশ্লিষ্টরাও পায়নি।”
এ বিষয়ে কাজিপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) আব্দুর রাজ্জাক মঙ্গলবার বিকালে বলেন, “অল্প দিন হলো আমি এখানে এসেছি। বাঁধ নির্মাণে জড়িত লোকজনরা আমাকে পাওনা টাকার বিষয়টি অবগত করেছে। এ বিষয়ে কী করা যায় সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।”
পাশাপাশি মন্ত্রণালয় থেকে কোনো মাধ্যমে বিশেষ কোনো বরাদ্দ আনা যায় কীনা সে বিষয়ে চেষ্টা করতে সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।