মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য হাতে গোনা যে কয়জন বেসামরিক ব্যক্তি বীর উত্তম খেতাব পেয়েছেন, তিনি তাদের একজন।
হতে সংগৃহিত
একাত্তরের আকাশযুদ্ধের অকুতোভয় যোদ্ধা, ঐতিহাসিক ‘অপরারেশন কিলো ফ্লাইটের’ সদস্য ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন আহমেদ বীর উত্তম আর নেই।
বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় গুলশানের বাসায় তার মৃত্যু হয় বলে তার ছেলে ক্যাপ্টেন তাপস আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন।
সাহাবুদ্দিন আহমেদ দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। তার বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর।
১৯৭১ সালে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন আহমেদ ছিলেন পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একজন বৈমানিক। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য হাতে গোনা যে কয়জন বেসামরিক ব্যক্তি বীর উত্তম খেতাব পেয়েছেন, তিনি তাদেরই একজন।
বিমানবাহিনী সদরদপ্তরের এক বার্তায় জানানো হয়েছে, বৃহস্পতিবার বিকাল পৌনে ৫টায় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ঘাঁটি বাশারে তার জানাজা হবে। সেখানে তার প্রতি জানানো হবে রাষ্ট্রীয় সম্মান। পরে ফরিদপুরে গ্রামের বাড়িতে তাকে দাফন করা হবে।
১৯৬৮ সালে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর প্রশিক্ষণের জন্য করাচিতে যেতে হয়েছিল সাহাবুদ্দিন আহমেদকে। পশ্চিম পাকিস্তানে বসে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের ওপর বৈষম্যমূলক আচরণ আরও ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলেন।
বাঁ থেকে ভারতীয় বিমানবাহিনীর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এইচ সি দেওয়ান, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সি এম সিংলা, এয়ার ভাইস মার্শাল সুলতান মাহমুদ বীর উত্তম, ভারতীয় বিমানবাহিনীর স্কোয়াড্রন লিডার সঞ্জয় কুমার চৌধুরী, ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন আহমেদ বীর উত্তম, ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম বীর উত্তম।
তখন পিআইএতে ৩০০ জন পাইলটের মধ্যে বাঙালি পাইলট ছিলেন মাত্র ৩০ জন। বঙ্গবন্ধু যখন ছয় দফা পেশ করলেন, তখন থেকেই ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন আহমেদের উপলব্ধি হয়েছিল, বাঙালি বৈমানিকদের নিয়ে আলাদা একটা সংগঠন গড়ে তোলা দরকার।
তিনি এবং তার সহকর্মীরা ‘ইস্ট পাকিস্তান এয়ারলাইন্স পাইলট অ্যাসোসিয়েশন’ নামে একটা সংগঠন গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধাচরণের কারণে সেটা তৎক্ষণাৎ সম্ভব হয়নি।
পরে আদালতের আশ্রয় নিয়ে তারা সেই সংগঠন গঠন করতে পেরেছিলেন। ইস্ট পাকিস্তান এয়ারলাইন্স পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ক্যাপ্টেন আলমগীর। ২৫ শে মার্চের পরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ক্যাপ্টেন আলমগীরসহ আরও তিনজন বাঙালি বৈমানিককে হত্যা করে।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকেই ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন আহমেদ যুদ্ধ করার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নেন। আর ২৫ শে মার্চের গণহত্যার সময় তিনি বুঝতে পারেন, মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। তখন তিনি ঢাকায়।
২৭ মার্চ কারফিউ উঠে যাওয়ার পর মা, বাবাসহ পরিবারের সদস্যদের ঢাকার বিক্রমপুরের রায়পাড়া গ্রামে রেখে আসেন সাহাবুদ্দিন। পরে এক ভগ্নিপতিকে সঙ্গে নিয়ে কুষ্টিয়া হয়ে ভারতের পথে পাড়ি জমান।
৩ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী বোমা ফেলে পুরো চুয়াডাঙা শহর ভস্মীভূত করে দেয়। ওই সময়ে ভারতীয় কিছু সাংবাদিকের সঙ্গে ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন কলকাতায় পাড়ি জমান।
তৎকালীন ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় এ খবর প্রকাশিত হলে তাকে সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসেন ভারতীয় বিমানবাহিনীর বৈমানিকরা।
এরপর সিলেটের সাজিবাজারে একটি ‘ইলেকট্রিক্যাল প্ল্যান্ট’ উড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পড়ে তার ওপর। সেজন্য তাকে কলকাতা থেকে আগরতলা যেতে হয়েছিল। তবে তিতাস গ্যাসের এক ইঞ্জিনিয়ার সেই প্ল্যান্টের ইলেকট্রিক্যাল ইন্সটলেশন বন্ধ করে দেওয়ায় সেই অপারেশনের আর প্রয়োজন পড়েনি।
এরই মধ্যে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের (পিইএ) আরও কিছু বৈমানিক সীমান্ত পেরিয়ে আগরতলায় চলে যান এবং ভারত সরকারের কাছে কিছু বিমান চেয়ে প্রস্তাব দেন। তাদের বলা হয় বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে প্রস্তাব নিয়ে আসতে।
তখন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ ও গ্রুপ ক্যাপ্টেন এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারের অক্লান্ত পরিশ্রমে গঠিত হয় বাংলাদেশ বিমানবাহিনী।
ভারতের যোধপুরের মহারাজা তাদের একটা ড্যাকোটা প্লেন দিয়েছিলেন। আর ভারতীয় বিমানবাহিনী একটা অটার প্লেন ও একটি ফ্রেঞ্চ হেলিকপ্টার দেয়।
সেগুলোর কোনোটাই যুদ্ধ বিমান ছিল না। সবই ছিল সাধারণ বিমান। সেগুলোকে তখন সমর সাজে সজ্জিত করা হয়।
একাত্তরের ২৮ সেপ্টেম্বর ভারতীয় বিমান বাহিনীর এয়ার চিফ মার্শাল পি সি রায় এবং বাংলাদেশের এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার ভারতের দিমাপুরে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।
তখন সেখানে ছিলেন ৯ জন পাইলট। তার মধ্যে ৬ জনই ছিল বেসামরিক। আর তিনজন ছিলেন বিমানবাহিনীর। তারা হলেন এয়ার ভাইস মার্শাল সুলতান মাহমুদ বীর উত্তম, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম এবং ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম।
বাঁ থেকে এয়ার ভাইস মার্শাল সুলতান মাহমুদ বীর উত্তম, ভারতীয় বিমানবাহিনীর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রামাকৃষ্ণান, ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন আহমেদ বীর উত্তম, ভারতীয় বিমানবাহিনীর স্কোয়াড্রন লিডার সঞ্জয় কুমার চৌধুরী, ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম বীর উত্তম, ভারতীয় বিমানবাহিনীর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সি এম সিংলা।
শুরু হয় সামরিক প্রশিক্ষণ। তারা ২০০-২৫০ ফুটের উপরে প্লেন উড্ডয়ন করতে পারতেন না। কারণ বাংলাদেশের আকাশে এর চেয়ে বেশি উচ্চতায় উড়লে, পাকিস্তানি রেডারে ধরা পড়বে প্লেন।
সে সময় একটু মেঘ হলে নাগাল্যান্ডে আর কিছু দেখা যেত না। তাই ওই সময়ে প্রশিক্ষণ ফ্লাইট চালানো খুব বিপদজনক ছিল। এর মধ্যেই অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে তাদের প্রশিক্ষণ শেষ হয়।
৩ নভেম্বরে হেলিকাপ্টার নিয়ে ঢাকায় এবং অটার দিয়ে চট্টগ্রামে আক্রমণের পরিকল্পনা করা হল। এই দুই শহরে মূল নিশানা ছিল এভিয়েশন ফুয়েল ডিপো, সেখান থেকে বিমানের তেল সরবারহ করা হত। কিন্তু হঠাৎ করে আক্রমণের পরিকল্পনা স্থগিত করা হয়।
সেই আক্রমণ পরে ৩ ডিসেম্বর মধ্যরাতে পরিচালনা করা হয়। হেলিকাপ্টার নিয়ে ঢাকার নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর জ্বালানি ডিপোতে এবং অটার দিয়ে চট্টগ্রামে জ্বালানি তেলের আরেক ডিপোতে আক্রমণ করেন বাংলাদেশের বিমান সেনারা। সেই অভিযানের সাংকেতিক নাম ছিল ‘অপরেশন কিলো ফ্লাইট’।
ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন আহমেদ এবং তার সহযোদ্ধারা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তান বিমানবাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত করেছিলেন। তাদের আক্রমণের পর ভারতীয় বিমানবাহিনী বাংলাদেশের প্রধান প্রধান বিমানবন্দরগুলোতে আক্রমণ শুরু করে।
৫ ডিসেম্বর বাংলার আকাশ পুরোপুরি শত্রুমুক্ত হয়। সে সময় হেলিকাপ্টার দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর উপর ৫০টি আক্রমণ পরিচালনা করা হয়েছিল, যার ১২টিতে অংশ নিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন আহমেদ।
যুদ্ধ দিনের স্মৃতি স্মরণ করে ২০১৭ সালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেছিলেন, সে সময় তার কোনো মৃত্যু ভয় ছিল না। কারণ নিরীহ মানুষকে রক্ষা করা আর ‘দেশ মা’-কে বাঁচানোই ছিল তার মূল লক্ষ্য।
