‘প্ল্যানেটারি হেল্থ ডায়েট’-এর মাধ্যমে বিশ্বের সকল মানুষের জন্য পুষ্টি নিশ্চিত করা সম্ভব হতে পারে।
হতে সংগৃহিত
২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের সকল মানুষকে পুষ্টিকর ও ন্যায্যভাবে খাদ্য সরবরাহ করা সম্ভব— তাও আবার পরিবেশ রক্ষা করেই।
এমনই আশাব্যঞ্জক বিশ্লেষণ উঠে এসেছে ২০২৫ সালের ‘ইট-ল্যানসেট কমিশন’য়ের ( ইট–ল্যানসেট কমিশন অন হেলদি ডায়েটস ফ্রম সাসটেইনেবল ফুড সিস্টেমস) নতুন প্রতিবেদনে।
এই কমিশনের মতে, যদি বিশ্ব একযোগে ‘প্ল্যানেটারি হেল্থ ডায়েট’ বা ‘পৃথিবীর স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যাভ্যাস’ গ্রহণ করে, তবে মানুষ যেমন সুস্থ থাকবে, তেমনি পৃথিবীও টিকে থাকবে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায়।
কী এই প্ল্যানেটারি হেল্থ ডায়েট?
কমিশনের সহ-সভাপতি ও যুক্তরাষ্ট্রের ‘হার্ভার্ড টি. এইচ. চ্যান স্কুল অব পাবলিক হেল্থ’ এবং ‘হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল’-এর অধ্যাপক ডা. ওয়াল্টার উইলেট সিএনএন ডটকম-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা বলেন, “মানুষ ও পৃথিবীর জন্য উপকারী খাদ্যাভ্যাস মূলত- ফল, শাকসবজি, বাদাম, ডাল ও গোটা শস্যকে কেন্দ্র করে। এর সঙ্গে পরিমিত পরিমাণে মাংস ও দুগ্ধজাত খাবার রাখা যেতে পারে। তবে চিনি, লবণ ও স্যাচুরেইটেড ফ্যাট যতটা সম্ভব কমাতে হবে।”
তার মতে, “প্রতিদিন একবার দুগ্ধজাত খাবার, যেমন- দুধ বা দই, আর একবার প্রাণিজ প্রোটিন, যেমন- মাছ, মুরগি, ডিম বা মাংস খাওয়াই যথেষ্ট। তবে লাল মাংস (গরু, ভেড়া) সপ্তাহে একবার চার আউন্সের বেশি হওয়া উচিত নয়।”
“এই খাদ্যাভ্যাস মাংস ও দুধ সম্পূর্ণ বাদ দিতে বলছে না,” বলেন ডা. উইলেট। “এটি আসলে ভূমধ্যসাগরীয় খাদ্যাভ্যাসের মতোই, যেখানে মিতাচারই মূল কথা।”
খাদ্য নয়, পুরো ব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার
এই উদ্যোগ কেবল খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। জার্মানির ‘পটসডাম ইন্সটিটিউট ফর ক্লাইমেট ইমপ্যাক্ট রিসার্চ’ এবং ‘ইউনিভার্সিটি অব পটসডাম’-এর অধ্যাপক জোহান রকস্ট্রোম, যিনি কমিশনের সহ-সভাপতি, বলেন- “শুধু কী খাচ্ছি তা নয়, কীভাবে খাদ্য উৎপাদন ও বণ্টন করছি, তা নিয়েও ভাবতে হবে। খাদ্য অপচয় কমাতে হবে, কৃষিজমি, পানি ও প্রাকৃতিক সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। সবকিছু একসঙ্গে করতে হবে, আলাদাভাবে নয়।”
তিনি আরও বলেন, “এমনভাবে খাদ্য উৎপাদন করতে হবে যা স্বাস্থ্যকর, সাশ্রয়ী এবং সবার নাগালের মধ্যে থাকে। এটিই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।”
পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি পুষ্টি নিশ্চিত
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩০ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ আসে খাদ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও পরিবহনের মাধ্যমে।
যদি ‘প্ল্যানেটারি হেল্থ ডায়েট’ কার্যকর হয়, তবে এই নিঃসরণ অর্ধেকেরও বেশি কমানো সম্ভব।
খাদ্য ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটলে—
- গরু ও অন্যান্য পশুপালন ২৬ শতাংশ পর্যন্ত কমবে।
- জমির ১১ শতাংশ অংশ পুনরায় প্রাকৃতিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যাবে।
- শাকসবজির উৎপাদন ৪২ শতাংশ, ফলের ৬১ শতাংশ, ডালের ১৮৭ শতাংশ, বাদামের ১৭২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে।
ডা. উইলেট বলেন, “এভাবে অ্যামাজনের বনভূমি কাটার প্রবণতা থামাতে পারবো, যেখানে এখন প্রাণীখাদ্য উৎপাদনের জন্য অরণ্য ধ্বংস করা হচ্ছে।”
স্বাস্থ্যগত সুফল
২০১৯ সালে প্রকাশিত প্রথম ‘ইট-ল্যানসেট’ প্রতিবেদন বলেছিল, এই খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করলে বছরে ১ কোটি ১৬ লক্ষ অকালমৃত্যু রোধ করা সম্ভব।
২০২৫ সালের নতুন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ১ কোটি ৫০ লক্ষ।
শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই প্রাপ্তবয়স্কদের ৩১ শতাংশ অকালমৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে এই খাদ্যাভ্যাস গ্রহণের মাধ্যমে।
ডা. উইলেট বলেন, “এই পরিবর্তনের ফলে শুধু স্বাস্থ্য নয়, অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। প্রতিবছর প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন ডলার সাশ্রয় হবে— যা স্বাস্থ্য ব্যয়, পরিবেশ পুনরুদ্ধার ও জলবায়ু প্রভাব কমানোর ফল।”
বিরোধিতার ঝড়
তবে সবাই এই পরিকল্পনার পক্ষে নয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৯ সালের মতো এবারও মাংসশিল্পের কিছু অংশ ‘#ইয়েস টু মিট’ প্রচারণার মাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে।
জোহান রকস্ট্রোম বলেন, “এটি আবারও জলবায়ু-বিষয়ক বিজ্ঞান অস্বীকার ও ভ্রান্ত তথ্য প্রচারের একটি অংশ।”
ডা. উইলেটও বলেন, “মাংস ও দুগ্ধশিল্পের সঙ্গে যুক্ত কিছু গোষ্ঠী ভুল তথ্য ছড়াচ্ছে। তবে এই প্রতিবেদন সম্পূর্ণ বিজ্ঞানভিত্তিক এবং বিশ্বজুড়ে গবেষণার ওপর দাঁড়িয়ে আছে।”
টেকসই পরিবর্তনের রোডম্যাপ
বিশ্বের ধনী ৩০ শতাংশ জনগোষ্ঠী বর্তমানে খাদ্যজনিত পরিবেশ দূষণের ৭০ শতাংশের জন্য দায়ী।
যুক্তরাজ্যের ‘ল্যাঙ্কাস্টার’ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক পরিবেশবিদ্যার অধ্যাপক ক্রিস্টিনা হিকস বলেন, “যদি খাদ্য ব্যবস্থাকে টেকসই করতে চাই, তবে বৈষম্য দূর করতে হবে এবং সব দেশের মধ্যে পরিকল্পিত সহযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে।”
সুইডেনের ‘স্টকহোম রেজিলিয়েন্স সেন্টার’-এর পরিচালক লাইন গর্ডন বলেন, “সরকারগুলো চাইলে কৃষি ভর্তুকি মাংস ও দুগ্ধ থেকে সরিয়ে ফল, সবজি, ডাল ও শস্যে দিতে পারে। এতে পরিবেশবান্ধব খাবার আরও সাশ্রয়ী হবে।”
তিনি আরও যোগ করেন, “চিনি, লবণ ও স্যাচুরেইটেড ফ্যাটযুক্ত খাবারে কর আরোপ, শিশুদের প্রতি অস্বাস্থ্যকর খাবারের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ এবং সতর্কতামূলক লেবেল দেওয়া জরুরি।”
ঐতিহ্য ও বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধা
ডা. উইলেট বলেন, “এই ডায়েট কোনো একক পদ্ধতি নয়; এটি বিশ্বের নানান অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। স্থানীয় সংস্কৃতি বজায় রেখেই এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব।”
তিনি আরও বলেন, “আসলে মানুষকে কিছু কেড়ে নিতে বলছি না বরং এমনভাবে খেতে বলছি, যা তাদের শরীরের জন্যও ভালো এবং পৃথিবীর জন্যও সহনীয়।”
