“আম্মা সবসবময় বলতেন, ‘লাখের মধ্যে একটা মানুষ ছিল তোর বাবা। এমন মানুষ আর কখনো আসবে না’।”
হতে সংগৃহিত
বাংলা চলচ্চিত্রের অ্যাকশন হিরো জসিম পৃথিবী মায়া ছেড়েছেন দুই যুগেরও বেশি সময় আগে। মাত্র ৪৮ বছর বয়সে চলে যাওয়া এই নায়কের মৃত্যুদিনে এবারও পরিবার তাকে স্মরণ করেছে নীরবে।
জসিমকে নিয়ে ছোট ছেলে এ কে রাহুলের কাছে বাবার স্মৃতি অনেকটাই ‘আবছা’; তবে মায়ের কাছ থেকে শোনা গল্পে জেনেছেন, জসিম ছিলেন ‘উদার, হাসিখুশি এবং অপরূপ মানবিক গুণের’ একজন মানুষ।
রাহুল গ্লিটজকে বলেন, “আম্মা সবসবময় বলতেন, ‘লাখের মধ্যে একটা মানুষ ছিল তোর বাবা। এমন মানুষ আর কখনো আসবে না’।”
নায়ক জসিম
১৯৯৮ সালের ৮ অক্টোবর মারা যান জসিম। বুধবার এই অভিনেতার ২৭তম মৃত্যুবার্ষিকীতে জসিমের ছোট ছেলে সংগীতশিল্পী এ কে রাহুল বাবাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন গ্লিটজের সঙ্গে।
শৈশবে বাবাকে হারানো তিন ছেলে এ কে সামী, এ কে রাতুল এবং এ কে রাহুলকে একা বড় করেছেন তাদের মা নাসরিন।
তিন ছেলে বাবার পথ ধরে অভিনয়ে আসেননি। তারা নিজেদের খুঁজে পেয়েছেন গানের জগতে। তবে এর মধ্যে পরিবারে নেমে আসে আরেকটি শোক। দুই মাস আগে চলে গেছেন জসিমের মেজ ছেলে এ কে রাতুল। বাবার কবরেই শায়িত হয়েছেন তিনি।
রাহুল বলেন, “২৭ বছর আগে বাবাকে হারালাম, দুই মাস আগে ভাইকে হারালাম। বাবার জন্মবার্ষিকী বা মৃত্যুদিন আমরা পারিবারিকভাবে নিজেদের মধ্যে রাখি। তবে ভালো লাগে, বাবার প্রতি মানুষের ভালোবাসা ২৭ বছর পরেও একটুও কমেনি। এটা ভেবেই আবেগে ভেসে যাই। আমাদের মনে করিয়ে দেয়, বাবা কত বড় মাপের মানুষ ছিলেন।”
ছেলেরা বাবার অনেক গল্প শুনেছেন মায়ের মুখে।
সেসব স্মৃতির হাতড়ে রাহুল বলেন, “বাবা যখন চলে যায় আমি তখন অনেক ছোট ছিলাম। সব স্মৃতি তো ধারণ করতে পারিনি। তবে মায়ের কাছ থেকে অনেক গল্প শুনি। বাবা অনেক খেতে পছন্দ করতেন। আম্মা বাবাকে সতর্ক করে বলতেন, ‘তুমি একটু মাংস কম খাও’। তাই বাবা নাকি খাটের নিচে খাবার এনে লুকিয়ে রাখত। বাবা খুব মজার মানুষ ছিল। সবাইকে খুব হাসাতে পারতেন।”
জসিমের ‘পরোপকারী’ স্বভাবের কথাও রাহুল বললেন গ্লিটজের কাছে।
“রাস্তায় কাউকে যদি দেখত যে চলতে পারছে না, বাবা কিছু টাকা দিয়ে বলতেন ‘এটা বিক্রি কর, বা ছোটখাটো ব্যবসা শুরু কর’। একবার একজনকে ফলের দোকান করে দিয়েছিল, যেন তার পরিবারটা ভালোভাবে চলতে পারে। আম্মা সবসবময় বলে, ‘লাখের মধ্যে একটা মানুষ ছিল তোর বাবা। এমন মানুষ আর কখনো আসবে না’।”
নায়ক জসিম
শৈশবের কিছু স্মৃতি এখনো রাহুলের কাছে মূর্ত।
রাহুলের ভাষ্য, “বাবা যখন শুটিং শেষ করে বাসায় আসত আমি গাড়ির শব্দ শুনলেই কাপড় চোপড় নিয়ে নিচে দৌড় দিতাম। সেইসব স্মৃতি মনে পড়ে।”
বাবাকে শেষবার দেখার কষ্টের স্মৃতিও ভোলেননি রাহুল।
এ সংগীতশিল্পী বলেন, “বাবা যেদিন চলে যায় সেই স্মৃতিটা আমি কোনোভাবেই ভুলতে পারি না। ড্রয়িংরুমে বাবাকে শেষবারের মত শুইয়ে রাখল। আমরা পাশে বসে ছিলাম। চোখ বন্ধ করলে এখনো সে দৃশ্য দেখি।”
বাবার মৃত্যুর পর এফডিসিতে গেলে সহকর্মীদের আবেগ ছুঁয়ে যায় রাহুলের।
“বাবার সহকর্মী যারা ছিলেন জ্যাম্বস গ্রুপের, বেশিরভাগই তো এখন আর বেঁচে নেই। তবে এফডিসিতে গেলে বাবার কলিগ, নায়ক-নায়িকা বা সহকারী হিসেবে যারা কাজ করেছেন, তাদের সঙ্গে যখন দেখা হয় এত বছর পরও আমাদের জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন। তাদের ইমোশনের জায়গাটা এত বড়। বাবার উদারতার গল্পও করেন আমাদের সঙ্গে। কেউ বলেন, বাবা শুটিং সেটে সবাইকে জুতা পরতে বলতেন, কিনে দিতেন। অনেকে বলেন ‘আপনার বাবার জন্যই আমি জুতা পরে এসেছি’, এসব এসব শুনলে ভালো লাগে।”
জসিম অভিনীত ‘জিদ্দী’ সিনেমা রাহুলের প্রিয়। এই সিনেমা দেখার একটা মজার ঘটনা গ্লিটজের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন রাহুল।
তিনি বলেন, “বাবার অভিনয় করা সব থেকে পছন্দের সিনেমা হচ্ছে জিদ্দি। ওইটা অনেকবার দেখেছি। বাবার সঙ্গেও দেখেছি। সেই সিনেমায় চুন্নু (ফাইট ডিরেক্টর আতিকুর রহমান চুন্নু) আংকেলের একটা দৃশ্য আছে। বাবা উনার হাত কেটে দেয় সিনেমায়। ওই দৃশ্যটা বারবার দেখতে চাইতাম। উনি (চুন্নু) যখন বাসায় আসত, দেখতাম উনার হাত ঠিক আছে। আমি এটা মিলাতে চাইতাম। কেন সিনেমায় হাত কাটা হল, আর কাটা হাত কীভাবে জোড়া লেগে গেল!”
বাবার সব সিনেমা দেখা হয়েছে কী না প্রশ্নে আর্কাইভ নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন জসিমের ছোট ছেলে।
“বাবা তো অনেক সিনেমা করেছেন, সব দেখা সম্ভব না বা সব সিনেমা সংরক্ষণে নেই। বাবার সব সিনেমার আর্কাইভ নেই। এটা নিয়ে আফসোস করি। আর্কাইভিং জিনিসটা বাংলাদেশে খুব অভাব।”
নায়ক জসিমের তিন ছেলে এ কে সামী, প্রয়াত এ কে রাতুল এবং এ কে রাহুল
বাবার কোন গুণটি আপনারা তিন ভাই পেয়েছেন প্রশ্নে রাহুল বলেন, “কাজের প্রতি বাবার প্যাশন। বাবা সবসময় বিশ্বাস করতেন, যেটা করব শতভাগ সততার সঙ্গে করব, নিজের শতভাগ দিয়ে চেষ্টা করব।
“বাবা সিনেমায় যেমন দিনরাত প্যাশন দিয়ে কাজ করে গেছেন, আমরা মিউজিকে সেই প্যাশন দিয়েই কাজ করছি। আমরা যদি এটা ছেড়ে দিতাম তাহলে হয়ত বাবা খুব বেশি খুশি হতেন না। আমি মনে করি, আমার কাজ দিয়ে বাবাকে যদি এভাবে প্রাউড রাখতে পারি তাহলে সেটাই যথেষ্ট। পরিবার কখনো আমাদের কাছ থেকে তেমন চাওয়া পাওয়া রাখেনি।”
১৯৫০ সালের ১৪ অগাস্ট ঢাকার নবাবগঞ্জের বক্সনগর গ্রামে জন্ম জসিমের। তার পুরো নাম আবুল খায়ের জসিম উদ্দিন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের দুই নম্বর সেক্টরে মেজর হায়দারের নেতৃত্বে যুদ্ধ করেছেন।
১৯৭২ সালে ‘দেবর’ সিনেমা দিয়ে ঢাকার চলচ্চিত্রে ফাইটিং নির্দেশক ও অভিনেতা হিসেবে অভিষেক ঘটার পর খলচরিত্রে ৭০টির মত সিনেমায় অভিনয় করেন জসিম। পরে নায়ক হয়েও করেন আরও শতাধিক সিনেমা।
নায়ক জসিম
কাজ শুরুর পর পরিচালকদের নজরে পড়তে জসিমের সময় লাগেনি। পরের বছরই ১৯৭৩ সালে জহিরুল হকের ‘রংবাজ’ সিনেমায় নিজেকে তুলে ধরেছিলেন এই অভিনেতা। এর কারণ ছিল জসিমের অ্যাকশন দৃশ্যের নতুনত্ব।
ঢাকাই সিনেমার চেনাজানা-পরিচিতির পরও জনপ্রিয়তার দেখা পেতে জসিমের সময় লেগে যায় কয়েক বছর। ১৯৭৬ সালে দেওয়ান নজরুল পরিচালিত ‘দোস্ত দুশমন’ দিয়ে জসিম পান দর্শকপ্রিয়তা।
ভারতের ‘শোলে’র বাংলাদেশি সংস্করণের এই সিনেমায় খলনায়ক হিসেবে জসিমের অভিনয় সবার প্রশংসা কুড়ায়। আর নায়ক হিসেবে জসিম প্রথম হাজির হন সুভাষ দত্তের ‘সবুজ সাথী’ সিনেমায় ১৯৮২ সালে।
‘আসামী হাজির’, ‘কুরবানি’, ‘মাস্তান রাজা’, ‘কালিয়া’, ‘বাংলার নায়ক’, ‘রাজ দুলারী’, ‘মোকাবেলা’, ‘ওমর শরীফ’, ‘মহেশখালীর বাঁকে’, ‘বারুদ’, ‘বাহাদুর’, ‘এক মুঠো ভাত’, ‘গাদ্দার’, ‘দুই রংবাজ’সহ অসংখ্য সিনেমায় অভিনয় করেছেন জসিম।
