“এ বছরের শেষ নাগাদ মোটামুটি সবার মাঝে সম্ভব না হলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নাগরিককে দেওয়া সম্ভব হবে,” বলছেন ইসি সচিব।
হতে সংগ্রহিত
নয় বছর আগে যখন নাগরিকদের হাতে স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়, তখন সোয়া বছরের মধ্যে সব নাগরিককে এ কার্ড দেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছিল।
সেই সময় শেষ হওয়ার পর আরও পৌনে আট বছর কেটে গেছে, তবু সে লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি ইসি। কবে নাগাদ সবার হাতে এ স্মার্ট কার্ড তুলে দেওয়া সম্ভব হবে, তাও সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারছে না সাংবিধানিক সংস্থাটি।
এর মধ্যে দীর্ঘ সময় ‘ব্ল্যাংক’ কার্ডের সরবরাহ না থাকায় স্মার্ট কার্ড বিতরণে ধীর গতি এসেছে। এখন এ কাজে গতি আনতে ২ কোটি ৩৬ লাখের বেশি ‘ব্ল্যাংক’ কার্ড কেনার প্রক্রিয়া শুরু করতে যাচ্ছে ইসি।
চলতি মাসে এসব কার্ডের গুণগত মান যাচাইয়ে প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশনে ফ্রান্সে গেছেন একজন নির্বাচন কমিশনার এবং প্রকল্প পরিচালক। সব ঠিক থাকলে অক্টোবর থেকে প্রতি মাসে নির্ধারিত পরিমাণ কার্ড আসতে শুরু করবে।
তাতে স্মার্ট কার্ড মুদ্রণ ও বিতরণ কাজে গতি আসবে বলে আশা করছেন নির্বাচন কমিশন সচিব আখতার আহমেদ।

কবে নাগাদ সব নাগরিকের হাতে স্মার্ট কার্ড পৌঁছানো যাবে– এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বুধবার বলেন, “সবার হাতে কবে নাগাদ দেওয়া সম্ভব হবে- এখন বলা মুশকিল, টু আর্লি ফর মি। আমরা চেষ্টা করছি, একটা সিগনিফিক্যান্ট নম্বরকে যেন দিতে পারি।”
জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ ও ইসির জনসংযোগ শাখার কর্মকর্তারা জানান, মধ্য সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮ কোটি ৮৭ লাখ ১৩ হাজার ৬৩টি স্মার্ট কার্ড মুদ্রণ হয়েছে। এর বেশির ভাগই উপজেলা বা থানা পর্যায়ে বিতরণ হয়েছে।
স্মার্ট কার্ডে ধীর গতি
ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও এনআইডি (লেমিনেটেড) দেওয়ার কাজ শুরু হয় ২০০৮ সালে। আট বছর বাদে ২০১৬ সালের অক্টোবরে উন্নতমানের এনআইডি বা স্মার্ট কার্ড বিতরণ শুরু করে তৎকালীন ইসি। তখন ৯ কোটি ভোটার বিবেচনায় পরের বছর নাগাদ সবার হাতে এ কার্ড তুলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল ইসি।

লেমিনেটেড এনআইডি।
সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, দীর্ঘ সময় পর কেবল পৌনে ৯ লাখ কার্ড মুদ্রণ সম্ভব হয়েছে, যার মধ্যে গত জুলাই পর্যন্ত ১৬ শতাংশ বিতরণ করা সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে ভোটার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ কোটি ৬৩ লাখের মতো। তাতে বর্তমানে স্মার্ট কার্ডের ঘাটতি প্রায় পৌনে চার কোটি।
রোজার আগে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। আগামী ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত যাদের বয়স ১৮ হবে, তাদের যুক্ত করে ভোটের জন্য চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে ৩০ নভেম্বর। তাতে অন্তত আরো ১৫ লাখ ভোটার যুক্ত হবে।
এছাড়া ভোটারযোগ্যদের তালিকাভুক্ত করতে তথ্য সংগ্রহের পর প্রতিবছর ২ জানুয়ারি খসড়া প্রকাশ করা হয়। দাবি আপত্তি নিষ্পত্তি শেষে ২ মার্চ চূড়ান্ত হয় ভোটার তালিকা। তাতেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভোটার বাড়বে।

ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকা সব ভোটারকে কবে নাগাদ স্মার্ট কার্ড দেওয়া সম্ভব হবে তার ধারণা দিতে পারেননি খোদ ইসি সচিব আখতার আহমেদও।
তিনি বলেন, স্মার্ট কার্ড মুদ্রণ ও বিতরণের বিষয়টি ‘প্রকিউরমেন্ট অ্যান্ড সাপ্লাই চেইনের’ ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।
“আমার ধারণা, এ বছরের শেষ নাগাদ মোটামুটি সবার মাঝে সম্ভব না হলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নাগরিককে দেওয়া সম্ভব হবে। অনেকের কাছে স্মার্ট এনআইডি কার্ড আছে। নতুন ভোটার নিয়ে শতভাগ কাভার করা এখন সম্ভব হবে না; সব মিলিয়ে ৮০ শতাংশ কাভার করা যাবে।”
স্মার্ট কার্ডের যাত্রা ও অগ্রগতি
>> ২০০৭-২০০৮ সালে ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও এনআইডি দেওয়া হয়। সে সময় ৮ কোটি ১০ লাখের বেশি ভোটার হয়।
>> ২০১১ সালে তৎকালীন নির্বাচন কমিশন উন্নতমানের জাতীয় পরিচয়পত্র দিতে বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় একটি প্রকল্প হাতে নেয়।
>> আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম ফর এনহেন্সিং অ্যাকসেস টু সার্ভিস (আইডিইএ) প্রকল্পের অধীনে স্মার্ট কার্ড দেওয়া হয় পাঁচ বছরের মাথায়।
>> সে সময় ফরাসি প্রযুক্তিপণ্য কোম্পানি অবার্থুর টেকনোলজির সঙ্গে প্রায় ১০ কোটি কার্ড সরবরাহের চুক্তি করে ইসি। কিন্তু প্রকল্পের মেয়াদ কয়েক দফা বাড়ালেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কার্ড সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয় কোম্পানিটি। ফলে ঝুলে যায় স্মার্ট কার্ড বিতরণ।
>> এরপর ২০১৮ সালে এসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পরিচালিত কোম্পানি বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির (বিএমটিএফ) কাছ থেকে এ কার্ড সংগ্রহ শুরু করে ইসি।
>> পরে অবার্থুর টেকনোলজির কাছ থেকে আরও কার্ড সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়া হলেও দরদামের ঝামেলায় গত নির্বাচন কমিশন এ নিয়ে আর এগোয়নি। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সেই কমিশন বিদায় নেয়।
>> গত বছর নভেম্বরে দায়িত্ব নেওয়া বর্তমান নির্বাচন কমিশন ফের ওই ফরাসি কোম্পানি থেকেই সহায়তা নিচ্ছে।
নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ ৩০ জানুয়ারি কমিশন সভার পর স্মার্ট কার্ডের জন্য ‘ব্ল্যাংক কার্ড’ কেনার সিদ্ধান্তের কথা জানান।
তিনি বলেন, এনআইডির ব্ল্যাংক কার্ড সরবরাহ কিছুদিন আটকে ছিল। তিন কোটি কার্ড কেনার জন্য সেনাবাহিনীর সঙ্গে চুক্তি হয়। কিন্তু ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে সেনাবাহিনী তা দিতে পারছে না বলে জানায়। এ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়।

“আগের কমিশনে এটা নিয়ে একটা উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বানের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। যাই হোক সেনাবাহিনী পরে ১৭২ টাকা করে দিতে রাজি হয়।
“৪০৬ কোটি টাকায় যতগুলো কার্ড হয়, সেগুলো তাদের কাছ থেকে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ ব্যাপারে এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কার্ড প্রকিউর করার।”
জুলাই পর্যন্ত বিতরণ হয়নি ১৬%
গত জুলাই পর্যন্ত ৮ কোটি ৭০ লাখ ৮৮ হাজার ২৯৭টি স্মার্ট কার্ডের মুদ্রণ শেষ হয়। এসময়ের মধ্যে কার্ড বিতরণ করা হয় ৭ কোটি ২৭ লাখ ৯৪ হাজার ১৪৪টি; তার মানে বিতরণের হার ৮৩.৫৯%। বিতরণ না হওয়া কার্ডের সংখ্যা ১ কোটি ৪২ লাখ ৯৪ হাজার ১৫৩টি, যার হার ১৬.৪১%।

ইসি কর্মকর্তারা জানান, দাম বাড়ায় বিএমটিএফের কাছ থেকে এখন কম কার্ড মিলবে; ৩ কোটির বদলে পাওয়া যাবে ২ কোটি ৩৬ লাখ ৩৪ হাজার। এ সংক্রান্ত প্রকল্পের মেয়াদ আগামী নভেম্বরে শেষ হওয়ার কথা ছিল। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে খরচ না বাড়িয়ে এর মেয়াদ এক বছর বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে। চলমান ধাপে যে পরিমাণ কার্ড কেনা হচ্ছে তা পর্যাপ্ত না হওয়ায় বাকিগুলো রাজস্ব খাত থেকে কেনার উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে।
বর্তমান ইসি ১৬ বছর বয়সীদেরও এনআইডি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। তবে স্মার্ট কার্ড পাচ্ছেন কেবল ভোটাররা (১৮ বছর ও তার বেশি বয়সী); আর কমবয়সী নাগরিকরা নিবন্ধিত হলে তারা পাচ্ছেন লেমিনেটেড কার্ড।
ইসি সচিব আখতার আহমেদ বুধবার বলেন, “ফ্রান্স থেকে দুই কোটি ৩৬ হাজারের বেশি ব্ল্যাংক কার্ড আনা হবে, যা স্মার্ট কার্ড তৈরির কাজে ব্যবহৃত হবে।
“…আন্ডার এইজড যারা আছেন তাদের প্লাস্টিক কার্ড দিই আমরা। সাপ্লাই লাইন ঠিক না করে কম বয়সীদের স্মার্ট কার্ড দেওয়া সম্ভব হবে না। ভোটারদের স্মার্ট কার্ড পাওয়ার অগ্রাধিকার বেশি।”
দীর্ঘ সময় ধরে ‘ব্ল্যাংক কার্ডের’ সরবরাহ না থাকায় স্মার্ট কার্ড বিতরণে ধীর গতি হয়েছে বলে স্বীকার করেন আখতার।
তার কথায়, “আপনারা জানেন, আমরা দীর্ঘ সময় ধরে ব্ল্যাংক কার্ড সীমাবদ্ধতায় আছি। আশা করি, সামনে কাভার হয়ে যাবে।”