“স্পিডটা বেড়েছে, আগে গতি কম ছিল; তবে বিদ্যুতের সমস্যার জন্য অনেক সময় জটিলতায় পড়তে হয়,” বলেন এক স্কুল শিক্ষক।
হতে সংগ্রহিত
মেঘনার কোলঘেঁষা চর পোড়াগাছায় এখন বর্ষার থৈ থৈ জল; উপকূলীয় এ জনপদে জলপথ মাড়িয়েই যেতে হয় স্বাস্থ্য কেন্দ্রে।
লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার এ পোড়াগাছায় রয়েছে একটি দ্বিতল কমিউনিটি ক্লিনিক। নিচতলা ফাঁকা রেখেই বানানো এ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নিম্নভাগ ডুবে আছে আশ্বিনেও। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে দেখা গেল, দোতলার কয়েকটি কক্ষে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হচ্ছে।
প্রতিদিন পোড়াগাছা গ্রামের প্রায় একশ মানুষ স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসেন এই আব্দুল মালেক কমিউনিটি ক্লিনিকে। সাধারণ জ্বর, সর্দি-কাশি, পোড়া-কাটার রোগীরা এলে সাধ্যমত সেবা দেন কমিউনিটি হেলথকেয়ার প্রোভাইডার নাছিমা আক্তার।
কমিউনিটি ক্লিনিকের যে পরিধি, সে অনুযায়ী তিনি ওষুধ দিয়ে দেন। প্রয়োজন মনে করলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ উচ্চতর পর্যায়ে রেফার করেন।
নাছিমাকে প্রতিদিনের কাজ শেষে জাতীয় কমিউনিটি হেলথ ইনফরমেশন সিস্টেম অব বাংলাদেশে তথ্য দিতে হয়, এজন্য আছে সরকারি ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোনও।
দ্বিতল এ ক্লিনিকের নিচের অংশ এখনো ডুবে রয়েছে।
আলাপচারিতায় নাছিমা জানালেন, আগে সরকারি মোবাইলে পাওয়া ডেটা ব্যবহার করে তথ্য ইনপুট দিতে হতো; ধীরগতি ও নেটওয়ার্ক দুর্বলতার কারণে বিড়ম্বনা ছিল নিত্যসঙ্গী। তবে গত মে মাসে ব্রডব্যান্ড সংযোগ আসায় সেই বিড়ম্বনা কেটে গেছে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের ডিজিটাল সংযোগ স্থাপন প্রকল্পের আওতায় এ ব্রডব্যান্ড সংযোগ মিলেছে বলে জানান নাছিমা।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মে মাসে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা যুক্ত হয়েছে। এখন আমি প্রতিদিনেরটা প্রতিদিন, তৎক্ষণাৎ করতে পারি। আগে এমবি দেওয়া হলেও অনেক সময় ইন্টারনেট খুব ধীরগতিতে কাজ করত। এখন সেটা থেকে মুক্ত পাওয়া গেছে।
“আগে সরকারি যে ফোন, সে ফোনে মাসে ১৫ জিবি ইন্টারনেট দেওয়া হত, ওইটা দিতে কাজ করতাম। রিমোট এলাকায় হওয়া সব দিকে পিছিয়ে, ইন্টারনেটের গতিও তেমন।”
কমিউনিটি ক্লিনিকের চিকিৎসার বিষয়ে নাছিমা বলেন, “প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র হিসাবে কমিউনিটি ক্লিনিকে আমাদের যে সার্ভিসগুলো দেওয়া হয়, আমরা সেটা দিই। মা ও শিশু থাকলে কাউন্সেলিং করি, স্বাস্থ্য শিক্ষার ব্যাপারে বলি, আবার যদি কোনো জটিল রোগী হয়—উচ্চতর পর্যায়ে রেফার করি।
“যেমন, আমাদের ইউনিয়ন সাব-সেন্টার আছে সেখানে, আরেকটু জটিল হলে থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠাই। আরেকটু জটিল হলে জেলা পর্যায়ে পাঠাই সেবার জন্য। যেগুলো আমাদের আয়ত্বের মধ্যে আছে, সেগুলোর চিকিৎসা দিই, বাকিটা রেফার করি।”
কী ধরনের সেবার জন্য মানুষ কমিউনিটি ক্লিনিকে আসে, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “গ্রামের হতদরিদ্র মানুষদের জন্য এই কমিউনিটি ক্লিনিক। এখানে গ্রামীণ মানুষরা সাধারণ জ্বর, সর্দি-কাশি, পোড়া, কাটা, মা আসে, নবজাতক আসে, প্রসব পরবর্তী মা আসে, গর্ভবতী মা আসে, নবজাতক শিশু আসে টিকা দেওয়ার জন্য, প্রত্যেক মাসে একবার ইপিআই কর্মসূচি হয়।”
নিজের এলাকার পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে নাছিমা বলেন, “চরাঞ্চল, এখানে নদী ভাঙা হতদরিদ্র মানুষ বেশি, বর্ষাকাল আসলে একদম পানি থাকে। অনেক বাড়ি থেকে রোগীরা আসতেও কষ্ট হয়।”
নাছিমার আবদুল মালেক কমিউনিটি ক্লিনিকের মতো রামগতি উপজেলার ১৩২টি প্রতিষ্ঠানে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ দিয়েছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তর। কমিউনিটি ক্লিনিক ছাড়াও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়, উপজেলা ভূমি অফিসসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা পেয়েছে এ সংযোগ।
আবদুল মালেক কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে আলেকজান্ডার পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ‘আইসিটিডি ডিজিটাল ল্যাব’ এবং প্রধান শিক্ষকের কার্যালয়ে পৌঁছেছে দুটি ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ।
আলেকজান্ডার পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে রয়েছে ‘আইসিটিডি ডিজিটাল ল্যাব’।
ডিজিটাল ল্যাবে গিয়ে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা এখন কেবল পাঠ্যবইয়ে সীমাবদ্ধ নেই। মাল্টিমিডিয়া কনটেন্ট, ভিডিও টিউটোরিয়াল এবং ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে জটিল বিষয়গুলো সহজে বোঝার সুযোগ তৈরি হয়েছে তাদের সামনে।
মোবাইল ইন্টারনেটের ধীরগতি ও নেটওয়ার্ক দুর্বলতার বিপরীতে এখন দ্রুতগতিতে কাজ সারতে পারার কথা বলেছেন বিদ্যালয়টির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। তবে বিদ্যুৎ বিভ্রাট হলে আগের যন্ত্রণাময় অভিজ্ঞতায় পড়ার কথা বলছেন তারা।
বিদ্যালয়ের ‘আইসিটিডি ডিজিটাল ল্যাবে’ মডেমের বদলে এখন ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ পাওয়ায় কাজ সহজ হয়েছে বলে জানালেন তথ্যপ্রযুক্তির শিক্ষক মোরশেদ আলম।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মডেমের পরিবর্তন করে যখন ব্রডব্যান্ড আসল, তখন স্বাভাবিকভাবে গতি বেশি হবেই। এডুকেশনাল ভিডিও দেখা এবং ডিজিটাল ল্যাবে প্র্যাকটিক্যালের ক্ষেত্রে এখন বেশ সুবিধাই হয়েছে।
“স্পিডটা বেড়েছে। আগে গতি কম ছিল। তবে বিদ্যুতের সমস্যার জন্য অনেক সময় জটিলতায় পড়তে হয়।”
বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক রিয়াজ উদ্দিন বলেন, বিদ্যুতের সমস্যা মোকালোয় বিদ্যালয়ের নতুন ভবনের ছাদে সোলার প্যানেল বসানো হয়েছে। ২০২০ সালে ভবন বুঝিয়ে দিলেও ব্যাটারি, সংযোগসহ অন্যান্য ব্যবস্থা করে দেয়নি বাস্তবায়নকারী শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর।
আলেকজান্ডার পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ডিজিটাল ল্যাবে কথা হয় সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী আয়েশা আলম তানুশার সঙ্গে।
তার কথায়, “ইন্টারনেটের স্পিডটা ভালোই। আমরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে এডুকেশনাল ভিডিও দেখতে পারি, ডকুমেন্ট তৈরি করা শিখিয়েছে।”
রামগতির মতো নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়াতেও ২৫টি সরকারি প্রতিষ্ঠানে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ দিয়েছে আইসিটি অধিদপ্তর। তার মধ্যে রয়েছে সুখচর মফিজিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আর আব্দুল মোতালেব (এএম) উচ্চ বিদ্যালয়।
হাতিয়ায় ব্রডব্যান্ড সংযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে বেতার তরঙ্গ ব্যবহার করেছে ডিজিটাল সংযোগ স্থাপন প্রকল্পের (ইডিসি) সহযোগী আইএসপি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান কেএস নেটওয়ার্ক। বেতার তরঙ্গের মাধ্যমে ইডিসি প্রকল্প এবং এর বাইরে হাতিয়ায় শতাধিক সংযোগ দেওয়ার কথা জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
প্রতিষ্ঠানের হেড অব মার্কেটিং ফিরোজ ইফতেখার বলেন, “রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির মাধ্যমে আমরা হাই ক্যাপাসিটির স্পেকট্রাম ডেটা পাস করছি। সেটা নিয়ে আমরা এন্ড ইউজার কানেক্টিভিটিগুলোকে সচল করছি, যা বেশ উচ্চ গতি সম্পন্ন।
“ইডিসি প্রকল্প থেকে নির্ধারিত ব্যান্ডউইথ এখানে দেওয়া হয়েছে, আমরা সেটা শতভাগ নিশ্চিত করতেছি। তার উপরে আমাদের এখানে ব্যান্ডউইথের যে প্রসেস, সে অনুযায়ী ৫০ থেকে ১০০ মেগাবাইট স্পিড তারা পাচ্ছে।”
ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ পাওয়ায় ইন্টারনেট ব্যবহারের অভিজ্ঞতা পাল্টে যাওয়ার কথা বলেছেন সুখচর মফিজিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং আব্দুল মোতালেব (এএম) উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। প্রতিষ্ঠানের আইসিটিডি ল্যাবে আগের মডেমের জায়গায় এসেছে ব্রডব্যান্ড সংযোগ।
আব্দুল মোতালেব (এএম) উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী রাবেয়া খাতুনের কথায়, “ইন্টারভিত্তিক কাজের জন্য আমাদের যেখানে ইন্টারনেট থাকে বা দোকানে যেতে হত, এখন বিদ্যালয়ে আমাদের সেই সুবিধাটা চলে আসছে।
“আমরা বিদ্যালয় থেকে ইন্টারনেট ভিত্তিক কাজটা করে নিতে পারতেছি। ই-বুক, ই-লার্নিংয়ের সুবিধা এখন সহজ হয়েছে।”
সুখচর মফিজিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফারহানা ইয়াসমিন বলেছেন, “পাঠ সংশ্লিষ্ট অনেক কিছুই আছে। ওদেরকে দেখালে ওরা খুব উৎসাহিত হয়, আনন্দ পায়।
“আমি মনে করি, ওখান থেকে বাচ্চাদের অনেক কিছু জানার আছে।”
