পাকিস্তান শাসিত অঞ্চলটিতে গত দুই বছরে এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো বড় ধরনের বিক্ষোভ দানা বাঁধল।
হতে সংগৃহিত
টানা চতুর্থ দিনের মতো শাটডাউনে থাকা পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরে আবার অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
সেখানে বিক্ষোভকারী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তিন পুলিশ কর্মকর্তাসহ অন্তত ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন কয়েক ডজন মানুষ।
বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে বৃহস্পতিবার একটি প্রতিনিধি দলকে আজাদ কাশ্মীরের রাজধানী মুজাফ্ফরবাদে পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার।
তারা আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধি—জম্মু কাশ্মীর জয়েন্ট আওয়ামী অ্যাকশন কমিটির (জেএএসি) নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন।
এই কমিটির নেতৃত্বে রয়েছেন শওকত নওয়াজ মির। ৩৮ দফা দাবি নিয়ে তাদের ডাকে গত ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয় অবরোধ কর্মসূচি।
অন্যদিকে আন্দোলন দমাতে কেন্দ্রীয় সরকার এলাকাটি কার্যত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। সেখানকার বাসিন্দারা ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সেবা থেকে বঞ্চিত।
গত দুই বছরে এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো এ ধরনের বিক্ষোভ দানা বাঁধল পাকিস্তান শাসিত এ কাশ্মীরে।
এবারের অস্থিরতার কারণ কী, সেই উত্তর খোঁজা হয়েছে আল জাজিরার বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে।

ছবি: রয়টার্স
ক্ষোভের নেপথ্যে কী
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক থেকে মুক্তির পর কাশ্মীর উপত্যকা নিয়ে একাধিকবার যুদ্ধে জড়িয়েছে ভারত ও পাকিস্তান। দুই দেশই এ উপত্যকার নির্দিষ্ট অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। এর উত্তরাঞ্চলে চীন শাসিত কিছু অঞ্চলও রয়েছে।
ভারতের দাবি, এ অঞ্চলের পুরোটাই তাদের। পাকিস্তানও পুরোটা নিজেদের দাবি করে, কেবল ‘সহযোগী’ চীনের নিয়ন্ত্রণে থাকা অংশ ছাড়া।
২০১৭ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, আজাদ কাশ্মীরের জনসংখ্যা ৪০ লাখের মতো। আধা-শায়ত্তশাসিত এ অঞ্চলে নিজেদের প্রধানমন্ত্রী ও একটি আইনসভাও রয়েছে।
বর্তমান অস্থিরতার গোড়াপত্তন ২০২৩ সালের মে মাসে, যখন বিদ্যুৎ বিল বেড়ে যাওয়ার প্রতিবাদে মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। একই সঙ্গে ব্যাপক মাত্রায় আটা চোরাচালানের অভিযোগ এবং আটার তীব্র সংকটের বিষয়টিও সামনে আসে।
বিচ্ছিন্ন এসব বিক্ষোভ ২০২৩ সালের অগাস্টের মধ্যে সংগঠিত আন্দোলনে রূপ নেয়। পরের মাসে শত শত আন্দোলনকারী মুজাফ্ফরবাদে জড়ো হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জেএএসি গঠন করেন, যেখানে সব জেলা থেকে প্রতিনিধি রাখা হয়।
এই আন্দোলন প্রথম সহিংস হয়ে ওঠে ২০২৪ সালের মে মাসে, যখন আন্দোলনকারীরা মুজাফ্ফরবাদ অভিমুখে পদযাত্রা শুরু করেন। এ পদযাত্রায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাধা দিলে সংঘর্ষ হয়; তাতে মৃত্যু হয় পুলিশ কর্মকর্তাসহ তিনজনের।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ তখন আটা ও বিদ্যুতের দাম কমানোসহ মূল চারটি দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দিলে কর্মসূচি স্থগিত করেন আন্দোলনকারীরা।
আটা ও বিদ্যুতের দাম কমাতে গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে কয়েকশ কোটি রুপি বরাদ্দ দিতে হয়।
কিন্তু সেই শান্তি বেশি সময় টেকেনি। চলতি বছরের অগাস্টে ফের লকডাউনের ঘোষণা আসে জেএএসির তরফে। আর এবার কেবল অর্থনীতি নয়, অন্যান্য বিষয়েও নানা অভিযোগ সামনে আনা তারা।
এখন অসন্তোষ কী নিয়ে, দাবিই বা কী
৩৮ দফার মধ্যে বিনামূল্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে শুরু করে অবকাঠামো উন্নয়নে বড় বড় প্রকল্প হাতে নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। প্রাদেশিক আইনসভার কাঠামোতে পরিবর্তন আনার কথাও বলছেন আন্দোলনকারীরা।
আরেকটি দাবি এবারের তালিকাতেও প্রাধান্য পেয়েছে— ক্ষমতাসীনদের বিশেষ সুবিধা বাতিল করা।
২০২৪ সালের মে মাসের আন্দোলনের পর এ দাবির বিষয়ে বিচারিক কমিশন গঠনের কথা বলেছিল কেন্দ্রীয় সরকার।
বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, মন্ত্রীদের মতো সরকারের কিছু জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা দুটি সরকারি গাড়ি, নিরাপত্তারক্ষীসহ ব্যক্তিগত কর্মকর্তা এবং অফুরন্ত জ্বালানি পেয়ে থাকেন।
নতুন দাবির মধ্যে রয়েছে, সেখানকার আইনসভায় শরণার্থীদের জন্য সংরক্ষিত ১২টি আসন বাতিল করা।
জেএএসি বলছে, ১৯৪৭ সালের পর ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর থেকে আসা শরণার্থী ও তাদের উত্তরসূরিরা শক্তিশালী রাজনৈতিক ব্লক হয়ে উঠেছে, যারা উন্নয়ন তহবিলের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে।
২০২৩ ও ২০২৪ সালে যেসব আন্দোলনকারীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, সেগুলো প্রত্যাহারের দাবিও রয়েছে ৩৮ দফায়। কর অব্যাহতি ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর দাবিও এবার তালিকায় যোগ করেছেন আন্দোলনকারীরা।

ছবি: রয়টার্স
সরকার কী করছে?
স্থানীয় প্রশাসন অঞ্চলটিকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনীর সদস্য চেয়েছে স্থানীয় প্রশাসন, যা আন্দোলকারীদের মধ্যে বাড়তি ক্ষোভ তৈরি করেছে।
শওকত নওয়াজ মির সম্প্রতি সংবাদকর্মীদের বলেন, “স্থানীয় পুলিশ যেখানে রয়েছে, সেখানে বাইরে থেকে আধা সামরিক বাহিনী আনার কোনো প্রয়োজন নেই “
আজাদ কাশ্মীরের অর্থমন্ত্রী আবদুল মজিদ খান কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ নিয়ে বলছেন, “গেল বছর যখন বিক্ষোভে নামল, তখন আন্দোলনকারীদের দাবিদাওয়া ছিল বিদ্যুৎ ও আটার দাম নিয়ে এবং আমরা সেগুলো মেনে নিলাম।
“আন্দোলনকারীদের এটা বোঝা উচিৎ, সব কিছু রাতারাতি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়; কিছু দাবি বাস্তবায়নে সময় প্রয়োজন।”
প্রায় সব দাবির মীমাংসা হয়ে গেছে মন্তব্য করে আবদুল মজিদ বলেন, দুটি দাবি নিয়ে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। এর একটি শরণার্থীদের ১২টি আসন বাতিল করা এবং সরকারি কর্মীদের বিশেষ সুবিধা বাতিল করা।
এই দুটি দাবির পেছনে আন্দোলনকারীরা যেসব কারণ তুলে ধরছেন, সেগুলো ভিত্তিহনি বলেও মনে করেন এ অর্থমন্ত্রী।
সামনে কী ঘটতে পারে
কেন্দ্রীয় সরকার ও জেএএসির প্রতিনিধিদের বৃহস্পতিবারের বৈঠক শেষ হয় কোনো ধরনের মীমাংসা ছাড়াই। শুক্রবার তাদের মধ্যে দ্বিতীয় দফা বৈঠক হওয়ার কথা।
দুই পক্ষই প্রকাশ্যে সংলাপের প্রতি আস্থা থাকার কথা বলছে। কিন্তু এক পক্ষের প্রতিশ্রুতি এবং আরেক পক্ষের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অভিযোগে সেই আস্থায় ফাঁটল ধরেছে।
একদিকে জেএএসি তাদের কর্মসূচিতে অটল রয়েছে; অন্যদিকে সরকার বলছে, আন্দোলনকারীদের সব দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। তবে সাংবিধানিক ও নির্বাচনি ব্যবস্থায় রাতারাতি পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়, এ বার্তাও আন্দোলনকারীদের দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার।