শি জিনপিং ২০৩৫ সালের মধ্যে তার দেশের গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা সর্বোচ্চ অবস্থার চেয়ে ৭-১০% কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
হতে সংগৃহিত
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে মার্কিন প্রেসিডেন্টের জলবায়ুবিরোধী কড়া কড়া কথার পাল্টায় পরদিন চীনের নেতৃত্বে কয়েকটি দেশ জলবায়ু পরিবর্তন রোধে তাদের নতুন পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে।
বুধবার জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস আয়োজিত জলবায়ু বিষয়ক শীর্ষ সম্মেলনে লাইভ ভিডিও বার্তায় চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২০৩৫ সালের মধ্যে তার দেশের গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা সর্বোচ্চ অবস্থার চেয়ে ৭-১০% কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
চীন আগামী ১০ বছরের মধ্যে তাদের বায়ু ও সৌর বিদ্যুৎ সক্ষমতা ২০২০ সালের মাত্রার ছয়গুণ বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে, যা অভ্যন্তরীণ জ্বালানি ব্যবহারে অজৈব জ্বালানির ভাগ ৩০ শতাংশ ছাড়াতে সাহায্য করবে, বলেছেন শি।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স লিখেছে, এই লক্ষ্যমাত্রার মাধ্যমে চীন প্রথমবারের মতো গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ বৃদ্ধি সীমিত করে আনার বদলে কমানোর অঙ্গীকার করল, যদিও বিশ্বের সবচেয়ে বড় নিঃসরণকারী দেশের কাছে অনেকের প্রত্যাশা ছিল আরও বেশি।
শি বিশ্বের উন্নত দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় আরও জোরাল পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান। সরাসরি নাম না নিলেও তিনি জলবায়ু পরিবর্তনরোধে প্যারিস চুক্তির লক্ষ্যমাত্রা থেকে সরে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের কথাও উল্লেখ করেছেন।
“সবুজ ও কম-কার্বন সংশ্লিষ্ট জ্বালানি ব্যবস্থায় রূপান্তরই আমাদের সময়ের প্রবণতা। কিছু দেশ এই প্রবণতার বিপরীতে গেলেও, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সঠিক পথে থাকতে হবে, অবিচল বিশ্বাস, দৃঢ় কর্ম এবং অটল প্রচেষ্টা বজায় রাখতে হবে,” বলেছেন শি জিনপিং।
আগেরদিন মঙ্গলবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প তার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ভাষণে জলবায়ু পরিবর্তনকে ‘ঠগবাজি’ আখ্যা দিয়েছিলেন, বিজ্ঞানীদের বলেছিলেন ‘স্টুপিড’। জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে কার্বনমুক্ত বা কম কার্বন নিঃসরিত হয় এমন জ্বালানিতে সরে যাওয়ার চেষ্টা করা চীন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর কড়া সমালোচনাও করেছিলেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতায় ফেরার পর ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মতো তার দেশকে প্যারিস চুক্তি থেকে সরিয়ে নেন। ১০ বছর পুরনো ওই চুক্তিতে বৈশ্বিক তাপমাত্রা যেন প্রাক-শিল্পায়ন যুগের চেয়ে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস না বাড়ে তা নিশ্চিতে দেশগুলোকে পরিকল্পনা নিতে বলা হয়েছিল।
ঐতিহাসিকবাবে যুক্তরাষ্ট্রই বিশ্বের সর্বোচ্চ গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গতকারী। এখনকার বাৎসরিক নিঃসরণেও তাদের অবস্থান চীনের পরে।
বেলফার সেন্টারের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ইয়ান ব্রেমার, ট্রাম্প জলবায়ু পরিবর্তনকে অস্বীকার করে যে ভাষণ দিয়েছেন তাতে কার্বন-পরবর্তী জ্বালানি যুগের বাজার কার্যত চীনের হাতে চলে গেল।
“ট্রাম্প জীবাশ্ম জ্বালানি চাইছেন, যুক্তরাষ্ট্র এখনও বেশ শক্তিশালী পেট্রো-রাষ্ট্র। কিন্তু যদি আপনি ভবিষ্যতের কথা ভাবেন, তাহলে চীনকে বিশ্বের একমাত্র প্রভাবশালী ইলেক্ট্রো-স্টেট হওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার মাধ্যমে মেইক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইনের বিপরীতটাই হলো,” বলেছেন ব্রেমার।
তবে অনেক পর্যবেক্ষকের প্রত্যাশা ছিল, যুক্তরাষ্ট্র দৃশ্যপট থেকে সরে যাওয়ায় চীন ২০৩৫ সালের মধ্যে নিঃসরণের মাত্রা সর্বোচ্চ অবস্থার চেয়ে অন্তত ৩০ শতাংশ কমাবে, যা ২০৬০ সালের মধ্যে নেট-জিরো নিঃসরণে পৌঁছানোর যে লক্ষ্যমাত্রা তারা আগে ঠিক করেছিল তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।
সেরকম কোনো ঘোষণা না আসায় তারা হতাশ।
“বেইজিংয়ের এই অঙ্গীকার সাবধানী পদক্ষেপের প্রতিফলন, যার সঙ্গে তাদের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক রীতির যোগ রয়েছে, যেখানে স্থির এবং অনুমানযোগ্য সিদ্ধান্ত গ্রহণকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, একইসঙ্গে বড় আর্থিক বাস্তবতা লুকানো থাকে,” বলেছেন এশিয়া সোসাইটির চায়না ক্লাইমেট হাবের পরিচালক লি শুয়ো।
কার্বনমুক্ত প্রযুক্তিতে চীনের আধিপত্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের পিছু হটায় সামনের দিনে বেইজিংকে বিশ্বমঞ্চে আরও সক্রিয় হওয়ার সুযোগ করে দিতে পারে, ধারণা তার।
চীনের অঙ্গীকার ছাড়াও বুধবারের জলবায়ু সম্মেলন মোটাদাগে ছাপ ফেলার মতো কোনো অর্জনই নেই, অথচ এ বছর ব্রাজিলে হতে যাওয়া কপ৩০ সম্মেলনের আগে জলবায়ু পরিবর্তনরোধে বড় বড় অঙ্গীকারের জন্য শিল্পোন্নত দেশগুলোর ওপর ব্যাপক চাপ রয়েছে।
ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইস ইনাসিও লুলা দ্য সিলভা সতর্ক করে বলেছেন, নভেম্বরের জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনের আগে দেশগুলোর প্রতিশ্রুতিই বিশ্বকে দেখাবে, ‘বিজ্ঞান যা দেখাচ্ছে তাতে আমরা বিশ্বাস করি কি না’।
ব্রাজিল ২০৩৫ সালের মধ্যে নিঃসরণ ৫৯-৬৭% কমানো এবং বন উজাড় প্রতিরোধে প্রচেষ্টা বাড়ানোর অঙ্গীকার করেছে।
“সমাজ তার নেতাদের বিশ্বাস করা বন্ধ করতে যাচ্ছে, আমরা সবাই হেরে যাবো কারণ প্রত্যাখ্যানবাদই হয়তো বাস্তবে জিতে যাচ্ছে,” বলেছেন তিনি।
জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সাইডলাইনে এ জলবায়ু সম্মেলন আয়োজন করা গুতেরেস অবশ্য বলছেন, ধীরে হলেও জ্বালানি রূপান্তরে বিশ্বের অগ্রগতি হচ্ছে।
“প্যারিস চুক্তিই পার্থক্য সৃষ্টি করেছে,” পূর্বাভাসে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ার কথা থাকলে ২০১৫ সালে হওয়ার চুক্তির কারণে নেওয়া পদক্ষেপে তা ২ দশমিক ৬ ডিগ্রিতে আছে জানিয়ে বলেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব।
তবে এই অগ্রগতিও প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম। বিশ্বের তাপমাত্রা এরই মধ্যে প্রাক-শিল্পায়ন যুগের চেয়ে ১ দশমিক ২ ডিগ্রি বেড়ে গেছে।
“এখন আমাদের ২০৩৫ সালের জন্য নতুন পরিকল্পনা প্রয়োজন, যা অনেক দূর এগিয়ে নেবে এবং অনেক দ্রুত বাস্তবায়িত হবে,” বলেছেন গুতেরেস।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখন পর্যন্ত তাদের জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে চুক্তিতে পৌঁছাতে পারেনি, আপাতত তারা অস্থায়ী লক্ষ্যমাত্রা ধরে খসড়া করছে, যা পরে বদলাতেও পারে।
সম্মেলনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লিয়েন বলেছেন, তাদের জোট ২০৩০ সালের মধ্যে নিঃসরণ ৫৫% শতাংশ কমানোর লক্ষ্যমাত্র অর্জনের পথেই রয়েছে। ২০৩৫ সালের ক্ষেত্রে তাদের লক্ষ্যমাত্রা হতে পারে ৬৬ থেকে ৭২ শতাংশের মধ্যে।
২০২৬ সালে জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন আয়োজনের পরিকল্পনা করা অস্ট্রেলিয়া ২০৩৫ সালের মধ্যে গ্রিনহাউজ গ্যাসের নিঃসরণ ২০০৫ সালের তুলনায় ৬২ থেকে ৭০ শতাংশ কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
৩৯ সদস্যবিশিষ্ট অ্যালায়েন্স অব স্মল আইল্যান্ড স্টেটসের প্রতিনিধিত্ব করা দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ দেশ পালাউ ২০৩৫ সালের মধ্যে তাদের নিঃসরণের মাত্রা ২০১৫-র চেয়ে ৪৪% কমানোর ঘোষণা দিয়েছে।
“যাদের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি, সক্ষমতাও বেশি, তাদের আরও করতে হবে,” শিল্পোন্নত দেশগুলোর প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন পালাউ’র প্রেসিডেন্ট সুরাঞ্জেল উইপস।
