এক বছর পেরিয়ে গেলেও সেগুলোর কোনোটিই এখনো চালু হয়নি।
সংগৃহীত
গেল বছর জুলাই আন্দোলনের সময় ভাঙচুর ও লুটপাটের শিকার হয়েছিল পাঁচটি সিনেপ্লেক্স। এক বছর পরও সেগুলো চালু করা সম্ভব হয়নি।
নারায়ণগঞ্জের গুলশান সিনেপ্লেক্স, সিরাজগঞ্জের রুটস সিনেক্লাব, রাজশাহীর স্টার সিনেপ্লেক্স, নাটোরের আনন্দ সিনেপ্লেক্স এবং চট্টগ্রামের সিলভার স্ক্রিন তখন হামলার শিকার হয়েছিল।
এর মধ্যে রাজশাহীর স্টার সিনেপ্লেক্স, নাটোরের আনন্দ সিনেপ্লেক্স বাদে বাকি তিনটি সংস্কারের পর সিনেমা প্রদর্শনের প্রস্তুত।
কিন্তু সংস্কার হওয়া তিনটি সিনেপ্লেক্সের মালিকরা বলছেন, সংস্কার শেষ হলেও ভালো সিনেমার অভাব, চলচ্চিত্র ব্যবসায় মন্দা আর নিরাপত্তা সংকট ঘুরে দাঁড়াতে দিচ্ছে না তাদের।
নারায়ণগঞ্জের গুলশান সিনেপ্লেক্স
নারায়ণগঞ্জের গুলশান সিনেপ্লেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রইছ উদ্দীন আহমেদ শাহীন গ্লিটজকে বলেন, “গত বছরের অগাস্ট থেকে আমাদের হল বন্ধ আছে। আপাতত চালু করার পরিকল্পনা নেই। নানা কারণ আছে এটা চালু করতে না পারার। প্রধান কারণ, চালানোর মত ভালো সিনেমা নাই। সিনেমার ব্যবসা ভালো না। ঈদ ছাড়া তো ভালো সিনেমা আসে না। সারা বছর লসে হল চালাতে চাই না।”
জুনে কোরবানির ঈদকে ঘিরে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে ছয়টি সিনেমা। তারপর তিন মাসের বেশি সময়ে মুক্তি পেয়েছে ‘আলী’, ‘উড়াল’ ও ‘জলরঙ’ নামের তিনটি সিনেমা। এর মধ্যে ‘জলরঙ’ ওটিটিতে মুক্তি দেওয়ার কয়েক মাস পর হলে মুক্তি দেওয়া হয়। পরে অন্য সিনেমাগুলোও দুই মাসের মধ্যে ওটিটিতে চলে এসেছে।
সিনেপ্লেক্সগুলোতে চলছে হলিউডের কিছু সিনেমা, নেই কোনো বাংলা সিনেমা। আর বেশ কিছু সিঙ্গেল স্ক্রিনে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সেখানে চলছে নব্বই দশকের ‘কাটপিস’ সিনেমা বা শাকিব খানের পুরনো ব্যবসাসফল সিনেমা।
চট্টগ্রামের সিলভার স্ক্রিন সিনেপ্লেক্স
সিনেমার অভাবের কথা বললেন চট্টগ্রামের সিলভার স্ক্রিন সিনেপ্লেক্স পরিচালক ফারুক আহমেদও।
তিনি বলেন, “সংস্কার কাজ আগেই শেষ হয়েছে। চালু করার ইচ্ছে আছে। কিন্তু কনটেন্ট পাচ্ছি না। বছরের দুই ঈদে চার-পাঁচটা সিনেমা মুক্তি পেলেও সেগুলো দুই সপ্তাহের বেশি চলে না। কর্মীদের বেতন, ভাড়া, ট্যাক্স এসব খরচ সামলানো যায় না। হলিউডের কিছু সিনেমা আনা গেলেও উপমহাদেশের কোনো সিনেমা আসছে না।
“সিনেমা থাকলে এক মাসে ভালো গেল, এক মাসে খারাপ গেল। তাহলে লাভ-লস সামঞ্জস্য করে চলা যায়। কিন্তু দুই ঈদে দুইটা, তিনটা সিনেমা ব্যবসা করে তো সারাবছর হল চালানো যায় না।”
সিনেমা না থাকায় ‘হল বন্ধ রাখাই’ ভালো মনে করছেন তিনি।
২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট সিরাজগঞ্জের রুটস সিনেক্লাব হামলায় ধ্বংস হয়ে যায়। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার সামিনা ইসলাম নী’র দাবি, প্রায় দুই কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছিল।
তিনি গ্লিটজকে বলেন, “আমরা অনেকটা সময় নিয়ে সংস্কার করেছি। কিন্তু নতুন ভালো কোনো সিনেমা নেই। হল চালু করতে কর্মী নিতে হয়, তাদের দায়িত্ব নিতে হয়। সিনেমা না থাকলে তো চালানো সম্ভব না। দুই ঈদের জন্য হল খুলে তো নিজেদের ক্ষতি করে লাভ নেই।”
নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কার কথাও বললেন এই হল মালিক।
“দেশের বাইরে থেকে কিছু সিনেমা আসলে আমরা সাহস পেতাম। কিন্তু সিনেমা আমদানি বন্ধ, নিজেদের সিনেমা নেই, যা মুক্তি পাচ্ছে তা চলছে না। এই সময়ে হল খুলে করব কী? নিরাপত্তার একটা ব্যাপার তো আছেই। মব তৈরি, যাকে খুশি তাকে হেনস্তা করা- এমন ঘটনা তো হচ্ছে। হল খুলব, আমাদের তো সেই নিরাপত্তাও নেই।”
গেল কয়েক বছর ধরেই রুটস সিনেক্লাবের এই মালিক চলচ্চিত্রের ‘বক্স অফিস সিস্টেম’ নিয়ে কাজ করছিলেন।
সিরাজগঞ্জের রুটস সিনেক্লাব
ভাঙচুরের পর সেই প্রকল্পও থেমে গেছে জানিয়ে সামিনা বলেন, “আমরা বুক বিডি শো নামে একটা প্ল্যাটফর্ম চালু করতে চেয়েছিলাম। যেটার কাজ আমাদের প্রায় শেষ প্রান্তে ছিল। কিন্তু হল ভাঙচুরে আমাদের সেটার কার্যক্রম থেকে অনেকটা পিছিয়ে দেওয়া হয়। আমরা হলের সেন্ট্রাল সার্ভার নিয়ে কাজ করছিলাম। সব কিছু বন্ধ হয়ে গেছে।”
‘বুক বিডি শো’র কর্মকাণ্ড জানতে চাইলে তিনি বলেন,” আমাদের সিনেমার জন্য একটা প্ল্যাটফর্ম। যা প্রযোজক ও হলমালিকদের জন্য স্বচ্ছ শো ও দর্শক তথ্য সরবরাহ করতে পারবে। সিনেমার প্রযোজকও আমাদের সার্ভার ব্যবহার করে দেখতে পারবেন তার সিনেমার কয়টা শো চলছে, কয়জন দর্শক আছে। অগাস্টে এই বক্স অফিস সিস্টেম চালু করার ইচ্ছে আমাদের ছিল। কিন্তু আমরা সেটা দেশের পরিস্থিতি বিবেচনায় করে উঠতে পারিনি।”
স্টার সিনেপ্লেক্সের রাজশাহী শাখা।
রাজশাহীর হাইটেক পার্কে অবস্থিত স্টার সিনেপ্লেক্সের শাখায়ও ভাঙচুর চালানো হয় গেল বছর। ১৭২ আসনের সেই প্রেক্ষাগৃহের কার্যক্রম কবে শুরু হবে তা অনিশ্চিত।
স্টার সিনেপ্লেক্সের মিডিয়া অ্যান্ড মার্কেটিং বিভাগের সিনিয়র ম্যানেজার মেসবাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “একটা ভেঙে ফেলা জিনিস নতুন করে শুরু করতে তো সময় লাগে। জায়গাটা সরকারি প্রজেক্টের আওতায় ছিল, আমরা ভাড়া নিয়ে চালাচ্ছিলাম। এখন সরকারি জায়গায় প্রজেক্ট শুরু করতে সময় লাগবে। চালু করতে হলে প্রক্রিয়াও পেরোতে হবে।”
আর্থিক সংকটে সংস্কার করা যায়নি নাটোরের আনন্দ সিনেপ্লেক্স।
এর মালিক আনিসুর রহমান বলেন, “গত বছরের অগাস্টে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট হয়েছিল। হল এখনো সেই অবস্থাতেই আছে। আমরা মামলা করেছিলাম, কোনো অগ্রগতি নেই। আর্থিক সংকটে হল সংস্কার করাও সম্ভব নয়। সমিতিসহ সবাই জানে, কিন্তু কোনো সাহায্য পাইনি। আমাদের সেই আর্থিক অবস্থা নেই এটা সংস্কার করে চালু করার।”
নাটোরের আনন্দ সিনেপ্লেক্স।
আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও সিনেমা না থাকায় বন্ধ রয়েছে বেশকিছু সিঙ্গেল স্ক্রিন। ঈদের পর এক মাস চলেছে মধুমিতা সিনেমা হল।
দুই মাস ধরে হলটি বন্ধ জানিয়ে প্রেক্ষাগৃহটির কর্ণধার ইফতেখার আহমেদ নওশাদ বলেন, “ঈদের সময় শাকিব খানের ‘তাণ্ডব’ ভালো চলেছে, তারপর ‘উৎসব’। শেষে কিছুদিন ‘বরবাদ’ চালানো হয়। দর্শক সংখ্যা ছিল একেবারেই কম। তাই দুই মাস ধরে বন্ধ রেখেছি। হলের কাজ চলছে। ভালো সিনেমা এলে চালাব, না হয় বন্ধ থাকবে।”
বগুড়ার মধুবন সিনেপ্লেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রোকনুজ্জামান ইউনূস বলেন, “‘জ্বীন-৩’ সিনেমা চলছে, কিন্তু দর্শক নেই। এর আগে ‘উড়াল’ চালিয়েছিলাম সেখানেও দর্শক নেই। ঈদের পর আর ব্যবসা করতে পারিনি।”
চলচ্চিত্র নেই, হল বন্ধ সামগ্রিক এই সংকট সমাধানে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন কি না প্রশ্নে চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির উপদেষ্টা সুদীপ্ত কুমার দাস বলেছেন, সংকট নিরসনে তারা সম্প্রতি তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
“সেই বৈঠকে প্রযোজক, ব্যাংকের কর্মকর্তা, শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি সবাই ছিলেন। হল সংস্কারের জন্য এক হাজার কোটি টাকার যে ঋণ প্রকল্প ছিল সেটার সময়সীমা বাড়ানোর অনুরোধ জানাই। শিল্প মন্ত্রণালয়ের জয়েন্ট সেক্রেটারির কাছে চলচ্চিত্রকে ‘রুগ্ন শিল্প’ হিসেবে ঘোষণা করার প্রস্তাবও পাঠানো হয়েছে। কারণ হলগুলোর অবস্থা ভালো নয়, সংস্কার নেই, সিনেমা নেই। বছরে দুই ঈদের সিনেমা দিয়ে ব্যবসা টিকছে না।
“আমাদের হলের যে বৈদ্যুতিক বিল এটা বাণিজ্যিক হারে নেওয়া হয়, সেটা যদি শিল্পের হারে নেওয়া হয় তাহলে আমাদের কিছুটা সাশ্রয় হয়। এসব নিয়ে আলোচনা হয়েছে।”
এই উপদেষ্টা বলেন, বৈঠকে বিদেশি সিনেমা আমদানি এবং দেশীয় প্রোডাকশন বাড়ানোর উপায় নিয়েও আলোচনা হয়েছে। তবে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে আরেকটি বৈঠক ডাকা হবে। সেই বৈঠকের তারিখ এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
সংগৃহীত
