গবেষকরা বলছেন, এ আবিষ্কার নক্ষত্রকেন্দ্রিক বিভিন্ন গ্রহের পরিবার কীভাবে গঠিত হয়, সেই ধারণার মূল নকশাকেই বদলে দিচ্ছে।
সংগৃহীত
কয়েক দশক ধরে গ্রহ তৈরির প্রক্রিয়াকে শান্ত ও সুশৃঙ্খল বা পরিকল্পিত এক ঘটনা হিসেবে অনুমান করে এসেছেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু, আসলেই কি তাই?
আগে বিজ্ঞানীদের অনুমান ছিল, বিভিন্ন তরুণ তারা চারদিকে ধুলা ও গ্যাসে ভরা চ্যাপ্টা ও প্যানকেকের মতো মহাজাগতিক ডিস্ক দিয়ে ঘেরা, যেখানে ছোট ছোট বিভিন্ন কণা ধীরে ধীরে জড়ো হয়ে শেষ পর্যন্ত গ্রহে পরিণত হয়।
তবে নতুন গবেষণায় উঠে এসেছে, সত্যি ঘটনা হয়ত অনেক বেশি গোলমেলে ও অগোছালো। আর সেই জটিলতাই এতে আরও বেশি ভাবনার খোরাক জোগাচ্ছে।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের একটি আন্তর্জাতিক দল আবিষ্কার করেছে, গ্রহের জন্মস্থল বলে পরিচিত ঘূর্ণায়মান ‘প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্কে’র অনেকগুলোই আগের ধারণার মতো পুরো চ্যাপ্টা বা সমতল নয়।
এর বদলে, এসব ডিস্ক আসলে হালকা বাঁকানো বা ঢেউ খেলানো, যেগুলোর মধ্যে বাঁক বা কাত হয়ে থাকা অংশ ডিস্কের পুরো গঠন জুড়ে ধীরে ধীরে ঢেউয়ের মতো ছড়িয়ে পড়ে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিজ্ঞানভিত্তিক সাইট নোরিজ।
গবেষণাটি প্রকাশ পেয়েছে বিজ্ঞানভিত্তিক ‘অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল লেটার্স’-এ।
গবেষণায় বলা হয়েছে, বহুদিন ধরে প্রচলিত যেসব ধারণা ছিল যেমন– গ্রহ কীভাবে তৈরি হয় ও কীভাবে এরা নিজ নিজ কক্ষপথে স্থির থাকে তাতে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে এ নতুন ধারণা।
‘অ্যাটাকামা লার্জ মিলিমিটার/সাবমিলিমিটার অ্যারে’ বা অ্যালমা নামের এক শক্তিশালী মহাকাশ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র থেকে এ নতুন আবিষ্কারটি করেছেন গবেষকরা, যেটি বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী টেলিস্কোপ ও চিলির অ্যাটাকামা মরুভূমির উঁচু অঞ্চলে অবস্থিত।
‘এক্সোঅ্যালমা’ নামের প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে অনেক প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্কের মধ্যে থাকা কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস থেকে আসা দুর্বল বিভিন্ন রেডিও সিগন্যাল সাবধানে বিশ্লেষণ করেছেন গবেষকরা।
গ্যাসের গতির কারণে অর্থাৎ গ্যাস যখন সরতে থাকে তখন এর তরঙ্গদৈর্ঘ্যে ছোট ছোট পরিবর্তন আসে, যাকে ‘ডপলার শিফট’ বলা হয়। এই পরিবর্তন বিশ্লেষণ করে গ্যাস কীভাবে ডিস্কের মধ্যে চলছে ও পদার্থ কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছে তা গবেষকরা খতিয়ে দেখেছেন।
গবেষকরা বলছেন, এসব গ্যাস এমনভাবে চলছে, যা থেকে বোঝা যাচ্ছে এসব ডিস্ক পুরোপুরি সমতল বা সোজা নয়, বরং এগুলো একটু বাঁকানো। এ অপ্রত্যাশিত তথ্য অনেকটা চমকে দিয়েছে তাদের।
এসব বাঁক কেবল আধা ডিগ্রি থেকে দুই ডিগ্রি ছোট মনে হলেও এগুলোই বিজ্ঞানীদের গ্রহ তৈরির ধারণাকে পুরোপুরি বদলে দিতে পারে।
এ গবেষণার প্রধান গবেষক ও ‘কুইন মেরি ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডন’-এর অধ্যাপক ড. উইন্টার বলেছেন, ডিস্কে যেসব ছোট ছোট বাঁক আমরা দেখতে পেয়েছি তার সঙ্গে সৌরজগতের বিভিন্ন গ্রহের বাঁকের অনেকটাই মিল রয়েছে।
“আমাদের ফলাফল থেকে ইঙ্গিত মেলে, বিভিন্ন প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্ক একটু বাঁকানো বা ঢেউ খেলোনো। বিষয়টি আমাদের বোঝার ধরনে বড় পরিবর্তন আনবে এবং গ্রহ তৈরির প্রক্রিয়াতে আমাদের ধারণাতেও প্রভাব ফেলবে।”
গবেষণায় আরও বলা হচ্ছে, ডিস্কের বাঁক কতটা তা হয়ত নির্ভর করে তরুণ তারা কতটা পদার্থ শোষণ করছে তার ওপর। এর থেকে ইঙ্গিত মেলে, তারার ভেতরের এলাকা ও বাইরের গ্রহ তৈরির অঞ্চলের মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে।
ডিস্কের মধ্যে এসব বাঁক ঠিক কী কারণে হয় তা এখনও বিজ্ঞানীরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন। হতে পারে এর পেছনে লুকিয়ে থাকা কোনো সঙ্গী তারার মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কাজ করছে বা গ্যাস-ধুলোর ভেতরের এলোমেলো প্রবাহ এই বিকৃতির কারণ।
গবেষকরা বলছেন, কারণ যাই হোক না কেন, এ আবিষ্কার নক্ষত্রকেন্দ্রিক বিভিন্ন গ্রহের পরিবার কীভাবে গঠিত হয়, সেই ধারণার মূল নকশাকেই বদলে দিচ্ছে। একেবারে পরিপাটি ও সোজাসুজি গঠনের বদলে বিভিন্ন গ্রহ হয়ত সামান্য বাঁকা ডিস্ক থেকে তৈরি হয়। ফলে এদের কক্ষপথও একটু কাত হয়ে থাকে যেমন আমাদের সৌরজগতের গ্রহগুলো একদম সোজা পথে ঘোরে না, বরং একটু কাত হয়ে ঘোরে তেমনই।
সংগৃহীত