বিসিবি পরিচালক ইফতেখার রহমান নিশ্চিত করেছেন, সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে বোর্ড সভাপতি একক সিদ্ধান্তে নির্বাচনের ভোটারদের নাম জমা দেওয়ার সময় দ্বিতীয় দফায় বাড়িয়েছেন।
হতে সংগৃহিত
সংবাদ সম্মেলনের ততক্ষণে ৩৬ মিনিট পেরিয়ে গেছে। প্রশ্নোত্তর পর্বের নানা পথ পেরিয়ে এক পর্যায়ে একজন সংবাদকর্মী বললেন, “আন্দোলনে এত লোক প্রাণ দিয়েছে কোনো স্বৈরাচার তৈরি করার জন্য নয়। এই যে একক ক্ষমতা বা ঈশ্বরতুল্য ক্ষমতা তৈরি করেছেন, এই ক্ষমতার অপব্যবহার তো হচ্ছে। আমরা আশা করব, ভবিষ্যতে এটা খর্ব করে আপনারা গনতান্ত্রিক সভাপতি করবেন। এরকম একনায়ক প্রেসিডেন্ট না বানানো উত্তম। কারণ এত লোক প্রাণ দিয়েছে স্বৈরাচার হটানোর জন্য…।”
কথাগুলো বলা হয় ইফতেখার রহমানকে উদ্দেশ্য। বিসিবি নির্বাচনের আগে তুমুল আলোচিত সঙ্কট প্রসঙ্গে এই বিসিবি পরিচালকই বলেছেন, ‘সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে’ বিসিবি সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল এককভাবেই সিদ্ধান্তটি নিয়েছেন।
যে সিদ্ধান্ত ঘিরে সঙ্কট, সেটি হলো বিসিবি নির্বাচনের কাউন্সিলর বা ভোটারদের নাম জমা দেওয়ার সময় দ্বিতীয় দফায় বাড়ানো। অভিযোগ উঠেছে, পছন্দের কাউন্সিলরদের নাম না পেয়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিসিবি সভাপতি আমিনুল। দ্বিতীয় দফা সময় বাড়ানোর ক্ষেত্রে অন্য বোর্ড পরিচালকদের কোনো মতামতও নেননি বিসিবি সভাপতি।
সংবাদ সম্মেলনে বিসিবি পরিচালক ইফতোর স্বীকার করেন, আমিনুল একক সিদ্ধান্তেই সময় বাড়িয়েছেন।
“আমি আগের দিনও বলেছি যে, প্রেসিডেন্ট সাহেব নিজের ক্ষমতাবলে… একটা তো জানেন যে আছে (ক্ষমতা)… এই ক্ষমতাবলে করেছেন (সময় বাড়ানো)…”।
“এটা উনাকে জিজ্ঞেস করতে হবে। আমি ক্রিকেট বোর্ডের মুখপাত্র হিসেবে ও মিডিয়া কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে বলতে পারি, উনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে এটা অনুমোদন করে বাড়িয়ে দিয়েছেন।”
ইফতেখারের মতে, বোর্ড পরিচালকদের কাছে বোর্ড সভাপতি বলেছেন, সময় কম থাকায় তিনি একাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
“উনার ব্যাখ্যা ছিল, যেহেতু সময় স্বল্পতা ছিল… এটা উনার ব্যক্তিগত ব্যাখ্যা, যেটি আমি কেবল আপনাদের জানাচ্ছি, সময়ের কমতির কারণে আমাদের প্রতিক্রিয়ার আগেই তিনি এটা দিয়ে দিয়েছেন (অনুমোদন)। যেহেতু উনার ক্ষমতা আছে, উনি করে দিয়েছেন। তবে উনার কথা ছিল সময়ের স্বল্পতার কারণে সভা করতে পারেননি।”
দ্বিতীয় দফা সময় বাড়াতে বলে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর পাঠানো সেই চিঠিতে নজিরবিহীনভাবে স্বাক্ষর করেছেন বিসিবি সভাপতি নিজেই। প্রশ্নও তাই স্বাভাবিকভাবেই উঠল, “এতটাই সময় কম ছিল যে চিঠিতে বোর্ডের প্রধান নির্বাহী স্বাক্ষর করতে পারেননি?”
এই প্রশ্নে কিছু না বলে স্রেফ হাসি দিয়েই উত্তর দেন ইফতেখার।
প্রশ্নবিদ্ধভাবে দ্বিতীয় দফা সময় বাড়িয়েই শেষ হয়নি বিতর্ক। সেই সময়ের পরও কাউন্সিলরদের নাম জমা নেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় দফা বাড়ানোর পর শেষ সময় ছিল সোমবার সন্ধ্যা ৬টায়। কিন্তু এরপরও নাম জমা পড়েছে। ইফতেখার নিজেই নিশ্জিত করেছেন, রাত ৯টায় একটি ক্লাবের কাউন্সিলর হিসেবে এসেছে সাবেক সভাপতি ফারুক আহমেদের নাম।
প্রশ্নের মুখে ইফতেখার নিশ্চিত করলেন, সন্ধ্যা ৬টার পর আর সময় বাড়ানো হয়নি।
“(সময়) বাড়ানো যেত… বাড়ানো যেত, যদি আমরা সময় বাড়াতাম। সেটা তো করা হয়নি। লেটস বি ভরি ক্লিয়ার, (সময়) এক্সটেনশন করা হয়নি।”
বিসিবির এই পরিচালক জানান, দেরিতে আসা নামগুলোর পাশে ‘নোট’ হিসেবে সময় উল্লেখ করে জমা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সময় শেষ হয়ে যাওয়ার পরও কেন নাম গ্রহণ করা হলো, এটা নিয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্নে ইফতেখার ঠিকমতো কিছু বলতেই পারছিলেন না।
একপর্যায়ে তিনি বললেন, পরে আসা নামগুলির ব্যাপারে সিদ্ধান্তের ভার তারা নির্বাচন কমিশনের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন।
“আমরা কিন্তু এটা (সময়ের পরে নাম দেওয়া) এন্ডোর্স করিনি। এটা বোর্ডে আলোচনা করা হয়েছে। যারা যারা যে সময়ে দিয়েছে (নাম), আমরা শুধু ফরোয়ার্ড করে দিয়েছি।”
“পরিস্কারভাবেই লেখা আছে, সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত আমরা গ্রহণ করব। ৬টার পরে আসা নামের লিগালিটি কী হবে… পরে দিতেই পারে… বা এখনও কেউ যদি দেয়, সিদ্ধান্ত হয়েছে যে আমর সবকটিই পাঠিয়ে দেব নির্বাচন কমিশনে এবং জানিয়ে দেব, এগুলো পরে এসেছে। লিগাল বাইন্ডিং হিসেবে উনারা সিদ্ধান্ত নেবেন।”
মজার ব্যাপার হলো, এতকিছুর পরও সোমবার খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হয়নি। নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপেই তাই অগ্রাহ্য হয়েছে তফসিল।
এত লুকোচুরি, ধোয়াশাঁ আর সংশয়ের পর নির্বাচন ঘিরে ষড়যন্ত্র আর পর্দার আড়ালের খেলাকেই উসকে দিচ্ছে কি না, এমন প্রশ্ন হলো। ইফতেখার তা উড়িয়ে দিতে চাইলেন।
“আপনারা হয়তো চিন্তা করছেন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। তবে আমি আপনাকে পরিস্কার করতে পারি, এখানে কোনো ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নেই। প্রক্রিয়ার সময়ের উদ্ভুত সমস্যার কারণেই এটা দেরি হয়েছে।”
সাবেক জাতীয় অধিনায়ক ও বিসিবি নির্বাচনের কাউন্সিলর তামিম ইকবালসহ কয়েকজন সাবেক বিসিবি পরিচালক ও সংগঠক গত শনিবার অভিযোগ করেছেন, বিসিবি নির্বাচনে ক্রীড়া উপদেষ্টা ও সরকার সরাসরি হস্তক্ষেপ করছে। বর্তমান বিসিবি সভাপতি আমিনুল যে ক্রীড়া উপদেষ্টার ঘনিষ্ঠ, সেটাও মোটামুটি প্রকাশ্যই। আমিনুল নিজেই কিছুদিন আগে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ক্রীড়া উপদেষ্টা চাইলে তিনি আবার বোর্ডে নির্বাচন করবেন।
ইফতেখার কি সরকারের হস্তক্ষেপ দেখতে পাচ্ছেন? সরাসরি এই প্রশ্ন তিনি এড়িয়ে গেলেন, “আমি আমার ক্লাবেরটা বলতে পারব। জেলা থেকে যারা এসেছেন, তাদেরকে জিজ্ঞেস কররে সদুত্তর পাবেন।”
যার দিকে এত অভিযোগের তির, যার সিদ্ধান্ত ঘিরে এমন সঙ্কট, সেই বিসিবি সভাপতি আমিনুলের কোনো বক্তব্যই এই বিষয়ে পাওয়া যাচ্ছে না। গত কিছুদিনে যতবার তিনি সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়েছেন, প্রতিবারই বলেছেন নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা বলবেন না।
এমনকি সোমবার বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের সভা শেষেও তিনি সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হননি। বোর্ডের প্রতিনিধি হয়ে আসা ইফতেখার প্রায় ৪৫ মিনিটের সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নের পর প্রশ্নে জর্জরিত হয়ে বারবার প্রকাশ করলেন অসহায়ত্ব।
“উনার (বোর্ড সভাপতি) সিদ্ধান্ত উনাকেই জিজ্ঞেস করতে হবে। আপনারা যোগাযোগ করে জিজ্ঞেস করে নিয়েন।”
“উনি যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এসবের দায় উনার ওপরই বর্তায়। আমি কেবল মুখপাত্র হিসেবে বলতে পারি বোর্ডে কী আলোচনা হয়েছে। কিছু প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই, আমি উত্তর দিতে চাচ্ছিও না।”
“আমি কেবল নিজের বিভাগ নিয়ে বলতে হবে। এসব নিয়ে তো প্রেসিডেন্ট বলতে পারবেন। আমি বলতে পারব না।”
“সবাই দোষে-গুণে মানুষ। উনার কাজের ফল উনিই… (ভোগ করবেন)।”