“কচু চাষ পাহাড়ের জন্য না। পাহাড়ে না করে সেটা সমতলে করতে হবে। পাহাড়ে ফলজ, বনজ, ওষুধি গাছ লাগানো উচিত ছিল।”
হতে সংগৃহিত
মাটিক্ষয়ের মত বিপদ হতে পারে জেনেও সমতলে চাষের উপযোগী লাভজনক কচুর মুখি চাষ দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে পাহাড়ে। তাতে ‘টপ সয়েল’ ক্ষয়ে গিয়ে সেই মাটি ভরাট করে ফেলছে পাহাড়ের ঝিরি ও নালা; কমে যাচ্ছে পাহাড়ে পানির সংস্থান।
কচুর মুখি চাষের জন্য যেভাবে পাহাড় নিড়ানো হয়; তাতে ‘বাস্তুতন্ত্র’ হুমকির মুখে পড়ে বলে মনে করছেন পরিবেশবাদীরা। কারণ, তাতে বিস্তীর্ণ এলাকা ফাঁকা হয়ে যায়; আবাস হারায় প্রাণীকূল। ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়।
খাগড়াছড়ির বিভাগীয় বনকর্মকর্তা মো. ফরিদ মিঞা বলছিলেন, “কচু চাষ পাহাড়ের জন্য না। পাহাড়ে না করে সেটা সমতলে করতে হবে। পাহাড়ে ফলজ, বনজ, ওষুধি গাছ লাগানো উচিত ছিল। কচু মূলত সমতল ভূমিতে চাষাবাদের ফসল। আমরা জোর করে পাহাড় আবাদ করছি।”
‘ধাপ পদ্ধতি’ পাহাড়ে প্রচলিত বা সনাতন চাষের বিকল্প হলেও তা এখনও জনপ্রিয় হয়নি। কৃষকরাও কচুর মুখি চাষে মাটিক্ষয়ের ব্যাপারে সচেতন নন। বরং রোগবালাই কম হওয়া এবং স্বল্প সময়ের আবাদে ভালো দাম পাওয়ায় কচুর মুখি চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
খাগড়াছড়িতে সবচেয়ে বেশি কচুর মুখি চাষ হয় মাটিরাঙা উপজেলায়। এ উপজেলার গোমতি এলাকার শামসুদ্দিন মিঞা চলতি মৌসুমে নিজের তিন একর জমিতে কচুর মুখি চাষ করেছেন।
সেই অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বললেন, “ভালো ফলন হয়েছে। বাজারে দাম ভালো। মৌসুমের শুরুতেই তুলতে পারলে দাম ভালো পেতাম।”
শামসুদ্দিনের ভাষ্য, পাহাড়ের ঢালে কচুর মুখির চাষ যে পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, এ বিষয়ে কিছু জানতেন না তিনি। তবে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছেন, পাহাড়ের মাটি বর্ষায় কিছুটা ক্ষয়ে যায়।
বান্দরবান মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব পাহাড় ২৬ শতাংশ খাড়া, সেখানে এক হেক্টর জমি কর্ষণ করলে বছরে ৫৮.০৮ টন মাটিক্ষয় হয়। এসব মাটি বৃষ্টিতে ধুয়ে ছড়া, ঝিরি হয়ে নদীতে পরে।
অপরদিকে পাহাড়ের যেসব স্থানে কচুর মুখি চাষ হচ্ছে, সেখানে কোথাও কোথাও পাহাড় ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত খাড়া। ফলে সেখানে মাটিক্ষয়ের পরিমাণ আরও বেশি।
তবে সাধারণ কৃষকদের মধ্যে এ ব্যাপারে কোনো ধারণা নেই। ফলে এ নিয়ে আলোচনাও কম।
খাগড়াছড়ির আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্রের আশপাশের বেশ কয়েকটি পাহাড়ে কচুর মুখি চাষ হয়েছে। গত বছরও এসব পাহাড় ছিল বিভিন্ন প্রজাতির গাছ-পালা, লতাগুল্মে ভরা। সেসব পাহাড়ে বিভিন্ন বন্যপ্রাণীরও বসবাস ছিল।

চলতি বছরের শুরুতে পাহাড়গুলো ন্যাড়া করে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কচুর মুখি চাষ হয়েছে। এর আগের বছরগুলোতে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙা, মানিকছড়ি, রামগড়সহ বিভিন্ন উপজেলাতে নিয়মিত এ চাষাবাদ হচ্ছিল।
পাহাড়ি জেলা খাগড়াছড়িতে কয়েক দশক ধরে কুচর মুখি চাষ হলেও এর পরিবেশগত বিপর্যয় নিয়ে আলোচনা ছিল কম। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঘন ঘন বন্যা, শুষ্ক মৌসুমে ঝিরিতে পানির প্রবাহ কমে যাওয়া, আশঙ্কাজনকভাবে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা কমে আসাসহ বিভিন্ন পরিবেশগত বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটছে। এজন্য অপরিকল্পিত চাষাবাসকে দায়ী করছেন পরিবেশবিদরা।
‘টপ সয়েল’ ও মাটিক্ষয়
বান্দরবান মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. মাহবুবুল ইসলাম বলেন, “পাহাড়ে মাটি আগলা করে চাষাবাদ করার নিয়ম নেই। নিয়ম হল মাটি যত কম নাড়াচাড়া চাষাবাদ করা যায়। কচু, আদা, হলুদের ক্ষেত্রে কোনো অবস্থাতেই খাড়াভাবে চাষাবাদ করা যাবে না। সামান্য খাড়া বা মৃদু ঢালে করা যাবে।”
সেক্ষেত্রে যেখানে বীজ রোপণ হবে শুধু সেই অংশটায় কোপানো যাবে। সাধারণত কৃষকরা পুরো পাহাড় কুপিয়ে নালার মত করে ফেলেন। বর্ষায় বৃষ্টি হলে ওই মাটিগুলো ধুয়ে চলে যায়।
পাহাড়ের উপরের দিকে মাটিকে ‘টপ সয়েল’ বলা হয়। এর স্তর বেশ পাতলা। ‘টপ সয়েল’ এর নিচে পাথর, মাটি, কঙ্কর থাকে। মাটি এভাবে কোপালে সব ধুয়ে চলে যায়। ফসলের জন্য মাটিতে যে পুষ্টি উপাদান থাকে সেটা থাকে ‘টপ সয়েলে’। এখন সেই ‘টপ সয়েল’ যদি ধুয়ে চলে যায়, মাটির পুষ্টি উপাদান থাকে না।

মাহবুবুল ইসলাম বলেন, দুই-চার বছরের এই ক্ষতি দৃশ্যমান হয়। তবে ১০ থেকে ১৫ বছর পর এসব জমিতে আর চাষাবাদ করা যাবে না।
“চাষাবাদের কোনো পরিবেশই থাকবে না। পাহাড়ে মাটিগুলো কোথায় যাচ্ছে? এসব মাটি ঝিরি-ঝরনায় যাচ্ছে। সেখানে সেগুলো জমা হচ্ছে। যেখানে পানি থাকার কথা সেখানে মাটি গিয়ে পড়ছে। ঝিরিতে যেখানে পানি থাকার কথা, সেখানে যদি মাটি জমা হয়, তাহলে ঝিরি তো ভরাট হয়ে যাবে।”
এক গবেষণায় দেখা গেছে, এক ইঞ্চি ‘টপ সয়েল’ জমা হতে ৩০০ বছর সময় লাগে। এটা প্রাকৃতিকভাবেই হয়। মানুষ ইচ্ছে করলেই ‘টপ সয়েল’ তৈরি করতে পারে না। কিন্ত মানুষ এভাবে চাষবাদ করে ‘সব শেষ করে দিচ্ছে’ বলে প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার ভাষ্য।
তিনি বলেন, “আগে পাহাড়ে এত পানি সংকট ছিল না। ঘন ঘন বন্যা হচ্ছে। ১০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি হলে এখন পাহাড়ে বন্যা সৃষ্টি হয়। কচু চাষ করতে হবে সেটা মৃদু ঢালে বা সমতল ভূমিতে। এভাবে মাটি কুপিয়ে চাষাবাদ করা যাবে না।
“আমরা গবেষণা করেছি ২৬ শতাংশ খাড়া পাহাড় নিয়ে। কিন্তু কৃষক যে পাহাড়ে চাষাবাদ করে সেটা ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ খাড়া, এসব পাহাড়ে ভূমি ক্ষয়ের পরিমাণ আরো বেশি।”
চলতি মৌসুমে (২০২৫-২৬ অর্থবছর) খাগড়াছড়িতে ৮১০ হেক্টর জমিতে কচুর মুখি চাষ হয়েছে। যা গত অর্থবছরের তুলনায় ৫৫ হেক্টর বেশি।
গবেষণা বলছে, প্রতি হেক্টরে (এক হেক্টর সমান ২৪৭ শতক) ৫৮.০৮ টন মাটিক্ষয় হয়। সে হিসাবে চলতি মৌসুমে খাগড়াছড়িতে মাটিক্ষয়ের পরিমাণ দাঁড়াবে ৪৭ হাজার ৪৪ টন।

খাগড়াছড়ির বিভাগীয় বনকর্মকর্তা মো. ফরিদ মিঞা বলেন, “টপ সয়েল হল মাটির সবচেয়ে মূল্যবান স্তর। গাছপালা টপ সয়েলের উপর ভিত্তি করে বড় হয়। যদি গাছপালা কেটে ন্যাড়া করে দেওয়া হয় তাহলে মাটিতে তাপ বিকিরণ বেড়ে যাবে। সূর্যের আলো সরাসরি মাটির উপরে পড়লে তাপ বিকিরণ হয়। সেটি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।
“কচুসহ অন্যান্য কন্দ জাতীয় ফসল রোপণের আগে আগুন লাগিয়ে ঝোপঝাড় পরিষ্কার করা হয়। এতে সেসব এলাকায় বন্যপ্রাণী বা বায়োডাইভারসিটি ছিল সব পুড়ে ছাই হয়ে যায়। মাটি কর্ষণ করার কারণে কেঁচো বা যেসব অনুজীব ছিল সেগুলো নষ্ট হয়ে যায়। এভাবে চাষাবাদ করার কারণে এখানকার বায়োডাইভারসিটি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।”
খাগড়াছড়ি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. বাছিরুল আলম বলেন, “আমরা কচু চাষ করার জন্য কাউকে নিষেধ করছি না। পাহাড়ে না করে সমতল ভূমিতে করার পরামর্শ দিচ্ছি। পাহাড়ে ঢালে আম, পেয়ারা এসব চাষ করলে এসব গাছ মাটি ধরতে রাখতে পারে। মাটির ছয় ইঞ্চি পর্যন্ত টপ সয়েল থাকে। কচু উত্তোলন করার পর পুরো মাটিটা ধুয়ে চলে যায়।”
‘সেভ দ্যা বায়োডাইভারসিটি কনজারভেশন সোসাইটি’র সংগঠক সাথোয়াই মারমা বলেন, “সম্প্রতি রামগড়ে একটি পাহাড়ে কচুর আবাদ করেছে। আমি সেখানটায় গেছি। পাহাড়ের নিচে পুরো ছড়ায় এখন মাটিভর্তি। কচু ক্ষেতের ‘টপ সয়েল’ ধুয়ে ছড়ায় পড়ছে।
“এটা একেবারেই দৃশ্যমান। কচু চাষের কারণে ভয়ঙ্কর একটি দুর্যোগ নেমে আসতে পারে। কচু চাষ করে কৃষক হয়ত অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে। কিন্তু সেটা আমাদের জীববৈচিত্র্য ও প্রকৃতির জন্য ক্ষতির বড় কারণ।”
টেরেস বা ধাপ পদ্ধতিতে চাষাবাদ
টেরেস বা সোপান পদ্ধতি বিশ্বব্যাপী একটি পুরনো চাষ পদ্ধতি। এতে পাহাড় বা ঢালু জমিকে সিঁড়ির মত করে কেটে ধাপের আকার দেওয়া হয়। তাতে প্রতিটি ধাপে পানি জমে থাকে এবং মাটি ধুয়ে যায় না। পাহাড়ে ঢালু অংশে কচু মুখি, আনারস, শাক-সবজি রোপণ করা যায়।
খাগড়াছড়িতে পাঁচ বছর ধরে বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে পাহাড়ে প্রাকৃতিক বন ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে ‘প্ল্যানটেনশন ফর নেচার’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।

সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সবুজ চাকমা বলেন, চীন, ভিয়েতনাম, নেপালসহ বিভিন্ন দেশে পাহাড় বেস্টিত এলাকাগুলো টেরেস বা সোপান পদ্ধতিতে চাষাবাদ হয়। উঁচু পাহাড়ে ধাপ তৈরি করে চাষাবাদ করা যায়। এতে মাটিতে আর্দ্রতার পরিমাণও ভালো থাকে।
“টেরেস পদ্ধতিতে বৃষ্টির পানি দিয়ে চাষাবাদ করা যায়। বছরের যে সময়ে কচু চাষ হয়, প্রায় পুরো সময়জুড়ে বৃষ্টি হয়। ফলে পানির সংকট হবে না। এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে মাটিক্ষয় কমবে।”
তিনি বলেন, “টেরেস পদ্ধতিতে আমাদের দেশে এখনো চাষাবাদ হয়নি। পাহাড়ের টেরেস পদ্ধতিতে চাষাবাদের জন্য সরকার বা কৃষি বিভাগ পরীক্ষামূলক প্রকল্প নিয়ে দেখতে পারে। যদি পাইলটিং প্রকল্প পদ্ধতি সফল হয় সেক্ষেত্রে কৃষকদের মাঝে এটি ছড়িয়ে দিতে পারে। সরকারের এটি নিয়ে কাজ করা দরকার।”
বান্দরবান মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. মাহবুবুল ইসলাম বলেন, “আমাদের দেশে টেরেস পদ্ধতিতে উদ্যোগ সরকারিভাবে নেওয়া প্রয়োজন। ভারতসহ বিভিন্ন দেশে কমিউনিটি ভিত্তিকভাবে টেরেস পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা হয়। টেরেস পদ্ধতিতে চাষাবাদ কিছুটা ব্যয়বহুল, সেক্ষেত্রে দাতারা যদি সহায়তা করে, কৃষকেরা এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ করতে পারবে।”

কৃষি বিভাগ যা বলছে
চলতি বছর কচুর মুখি সর্বোচ্চ চাষাবাদ হয়েছে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গায়। প্রায় ২২৮ হেক্টর জমিতে কচুর মুখি আবাদ হয়েছে।
এ ছাড়া রামগড়ে ১৪১ হেক্টর, সদরের ৮৫, গুইমারায় ৩৫, মানিকছড়িতে ৭৮, মহালছড়িতে ৮৫, দীঘিনালায় ২৫, পানছড়িতে ৪৮ ও লক্ষ্মীছড়িতে ৮৫ হেক্টর জমিতে কচুর চাষ হয়েছে।
মাটিরাঙার তাইন্দং এলাকার চাষি মো. কাশেম কচুর মুখি চাষের নেতিবাচক বিষয় সর্ম্পকে জানার পর ভবিষ্যতে আর চাষাবাদ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
তিনি বলেন, “আমি আগে জানতাম না। কচুর মুখি চাষে মাটিক্ষয় বেশি হচ্ছে। আমি সম্প্রতি অ্যাগ্রো-ইকোলজি বিষয়ক প্রশিক্ষণ নিয়ে বিষয়টি জানতে পেরেছি। আগামী মৌসুমে কচুর মুখি চাষ করব না।”