সন্তানের স্মার্টফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার রুখতে অভিভাবকদেরই দায়িত্ব নিতে হবে।
হতে সংগৃহিত
বর্তমান সময়ে স্মার্টফোন শুধু প্রাপ্তবয়স্কদের নয়, শিশুদের হাতেও সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। স্কুলে যাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলা, কিংবা গেইম খেলা সবকিছুর সঙ্গেই এখন জড়িত একটি ছোট স্ক্রিন।
তবে সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, শিশুরা ক্রমেই কম বয়সেই স্মার্টফোন পাচ্ছে যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘ফেয়ারলি ডিকিনসন বিশ্ববিদ্যাল’য়ের যোগাযোগবিষয়ক অধ্যাপক কারা আলাইমো সিএনএন ডটকম-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেন, “শিশুরা এমন এক প্রযুক্তির জগতে প্রবেশ করছে, যার জন্য তারা মানসিকভাবে প্রস্তুত নয়।”
২০২৪ সালে প্রকাশিত এই বিশেষজ্ঞের বই ‘ওভার দ্য ইনফ্লুয়েন্স: হোয়াই সোশ্যাল মিডিয়া ইজ টক্সিক ফর উইমেন অ্যান্ড গার্লস — অ্যান্ড হাউ উই ক্যান টেক ইট ব্যাক’-এ তুলে ধরেছেন, কীভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তরুণ প্রজন্মের মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
ছোট বয়সে বড় যন্ত্র: জরিপে যা উঠে এসেছে
যুক্তরাষ্ট্রের পিউ রিসার্চ সেন্টার ২০২৪ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত এক জরিপে জানায়, ১১ থেকে ১২ বছর বয়সি শিশুদের বেশিরভাগেরই এখন নিজের স্মার্টফোন আছে।
তিন হাজারেরও বেশি শিশুর অভিভাবককে নিয়ে করা এই গবেষণায় দেখা যায়, শিশুকে ফোন দেওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হল- অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা।
তবে এও সত্য, ফোন হাতে পাওয়া মানেই শিশুরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও প্রবেশাধিকার পায়। আর এখানেই শুরু হয় বিপদের গল্প।
কারা আলাইমো বলেন, “অন্তত ১৬ বছর বয়সের আগে শিশুদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রবেশ করা উচিত নয়।”
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, দুই বছরের নিচের শিশুদের মধ্যেও ইউটিউব দেখা বেড়েছে আগের তুলনায়।
পিউ রিসার্চ সেন্টারের জ্যেষ্ঠ গবেষক কোলিন ম্যাকক্লেইন বলেন, “শিশুরা এখন অতি অল্প বয়স থেকেই স্ক্রিনের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। এটাই সবচেয়ে বিস্ময়কর তথ্য।”
নিয়ম আছে, তবে মানা হয় না
অভিভাবকদের ৮৬ শতাংশ জানিয়েছেন, তারা প্রতিদিন সন্তানদের ‘স্ক্রিন’ ব্যবহারের বিষয়ে নজর রাখেন। তবে বাস্তবে মাত্র ১৯ শতাংশ অভিভাবক নিয়ম সবসময় কার্যকর করতে পারেন।
আট থেকে ১২ বছর বয়সি শিশুদের ৪৭ শতাংশ অভিভাবক স্বীকার করেছেন যে, তারা আরও ভালোভাবে সন্তানদের ‘স্ক্রিন টাইম’ নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন।
অভিভাবকদের ৮০ শতাংশই মনে করেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিশুরা যে ক্ষতির মুখে পড়ছে, তা সুবিধার তুলনায় অনেক বেশি।
যোগাযোগ রাখার বিকল্প উপায়
অনেক অভিভাবক মনে করেন, সন্তানকে ফোন না দিলে জরুরি প্রয়োজনে যোগাযোগ রাখা কঠিন।
কারা আলাইমো বলেন, “মা হিসেবে চাই মেয়ে যদি কোথাও বিপদে পড়ে, যেন আমাকে ফোন করতে পারে। তবে এর জন্য স্মার্টফোনই একমাত্র উপায় নয়।”
তিনি পরামর্শ দেন—
সাধারণ ফোন ব্যবহার করা যায়, যেটি দিয়ে শুধু কথা বলা বা বার্তা পাঠানো সম্ভব। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রবেশ করা যায় না। এতে শিশুরা অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকি থেকে দূরে থাকবে।
স্মার্ট ঘড়িও বিকল্প হতে পারে, যেগুলোতে কল, মেসেজ ও অবস্থান জানার সুবিধা থাকে।
কারা আলাইমোর নিজের পরিবারে আছে একটি ‘পারিবারিক ডিভাইস’, যা শিশুরা প্রয়োজন মতো ব্যবহার করতে পারে, তবে সেটি তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়।
একসঙ্গে সিদ্ধান্ত
আরেকটি বড় সমস্যা হল সমবয়সীদের চাপ। এক শিশুর হাতে ফোন দেখলে অন্যরা সেটি চায়, আর অভিভাবকেরা সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়ার ভয় পান।
কারা আলাইমো বলেন, “যখন শিশু ছোট থাকে, তখন থেকেই তাদের বন্ধুদের অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত। সবাই মিলে একসঙ্গে ঠিক করা, কখন ফোন দেওয়া উপযুক্ত হবে।”
নিউইয়র্কভিত্তিক মনোবিশেষজ্ঞ ও দুই সন্তানের মা লরেন টেটেনবাউম তার সম্প্রদায়ে এমন উদ্যোগ নিয়েছেন।
তিনি বলেন, “অনেক অভিভাবক এমনকি ঘরে ল্যান্ডফোন ব্যবহারের দিকেও ঝুঁকছেন, যাতে শিশুরা প্রাথমিক পর্যায়ে যোগাযোগ রপ্ত করতে পারে।”
গবেষণায় দেখা গেছে, ১১ থেকে ১২ বছর বয়সিরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রবেশ করলে এক বছর পর তাদের জীবনের সন্তুষ্টি কমে যায়।
পরিবারে নিয়ম তৈরির গুরুত্ব
যেসব শিশু ইতিমধ্যেই স্মার্টফোন ব্যবহার করছে, তাদের জন্য কঠোর তবে বাস্তবসম্মত নিয়ম জরুরি।
কারা আলাইমো বলেন, “নিয়ম না মানলে শিশুরা ধরে নেয়, এগুলো শুধু কথার কথা।”
টেটেনবাউমের মতে- নিয়ম তৈরি করার সময় সন্তানদের মতামত নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
“যখন তারা নিজেরাই নিয়ম নির্ধারণে অংশ নেয়, তখন তা মানার প্রবণতাও বাড়ে,” তিনি বলেন।
অভিভাবকদের উচিত নিয়মে স্পষ্ট করা—
ঘুম, পড়াশোনা ও পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো যেন বাধাগ্রস্ত না হয়।
পড়াশোনার সময় ফোন ব্যবহার করা যাবে। শুধু গবেষণা বা বন্ধুদের সঙ্গে প্রশ্নোত্তরের প্রয়োজনে।
ফোনে অন্য কোনো অ্যাপের নোটিফিকেশন তখন বন্ধ রাখতে হবে।
টেটেনবাউম আরও বলেন, “শিশুদের মনে করিয়ে দিতে হবে যে, ফোনের মালিক অভিভাবক, সন্তান নয়। ফলে যে কোনো সময় অভিভাবক দেখতে পারবেন তারা কী করছে।”
অভিভাবকদেরও অনুসরণ দরকার
শুধু শিশুর জন্য নয়, বড়দেরও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে নিয়ম থাকা দরকার।
টেটেনবাউম বলেন, “অভিভাবকরা নিজেরাই যদি খাওয়ার সময় বা পারিবারিক আড্ডায় ফোনে ব্যস্ত থাকেন, তবে শিশুরাও সেটিই অনুসরণ করবে।”
তিনি পরামর্শ দেন- যদি মনে হয় শিশুর ‘স্ক্রিন’ ব্যবহারে ভারসাম্য হারিয়েছে, তবে বিকল্প আনন্দের পথ দেখানো উচিত।
যেমন- গতকাল বৃষ্টি ছিল, তাই আমরা বেশি সময় স্ক্রিনে কাটিয়েছি। আজ চল বাইরে হাঁটি বা বই পড়ি।
