চাষিদের অভিযোগ, তারা সার পাচ্ছেন না। যা পাচ্ছেন সেগুলো কিনতেও অতিরিক্ত দাম দিতে বাধ্য হচ্ছেন, যা তাদের জন্য চরম আর্থিক চাপ সৃষ্টি করছে।
সংগৃহিত
শীতকালীন ফসলের মৌসুম ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি’র মতে ইউরিয়াবিহীন সার নিয়ে সংকটে পড়েছেন লালমনিরহাট জেলার কৃষকরা।
চাষিদের অভিযোগ, তারা সার পাচ্ছেন না। যা পাচ্ছেন সেগুলো কিনতেও অতিরিক্ত দাম দিতে বাধ্য হচ্ছেন, যা তাদের জন্য চরম আর্থিক চাপ সৃষ্টি করছে।
সার ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরবরাহের ঘাটতির কারণে এই সংকট সৃষ্টি হয়েছে। তাদের মতে, গুদাম থেকে যে পরিমাণ সার তারা পাচ্ছেন, তা তাদের চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।
অপরদিকে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন বরাদ্দ কিছু কম হলেও তেমন সংকট নেই, বরং কিছু ব্যবসায়ী কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে সার বেশি দামে বিক্রি করার চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ তাদের।
লালমনিরহাট সদর উপজেলার কুলাঘাট গ্রামের কৃষক গোলাম রব্বানী জানান, “আমরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সার পাই না। তারা প্রায়ই বলে স্টক শেষ, কিন্তু যদি কেজিপ্রতি তিন থেকে পাঁচ টাকা বেশি দিই, তবে তারা সার দিতে পারে।”
একই সমস্যা লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার কৃষক মোসলেম উদ্দিনেরও।
তিনি বলেন, “জমির প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজন নন-ইউরিয়া সার। সময়মতো এই সার না হলে জমি প্রস্তুত করা যাবে না। সার ছাড়া জমিতে ফসল বপন করলে ফলন ভালো হবে না। এছাড়া চারা গজানোর পর যখন ইউরিয়া সার প্রয়োজন হবে তখন সারের চাহিদা আরও বাড়বে।”
এসব কারণে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে চাষিরা বলছেন, শীতকালীন ফসলের জন্য নন ইউরিয়া সারের সরবরাহ পর্যাপ্ত না হলে জমির প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হবে না এবং এর ফলে ফসলের উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
আদিতমারী উপজেলার কমলাবাড়ী এলাকার চাষি সহিদুল ইসলাম শহীদ বলেন, “কার্তিক মাসের আবাদের উপর ভর করে এই এলাকার কৃষক সারা বছর চলে। আর এই সময়ে সারের টান পড়লে কৃষকের অস্তিত্বে টান পড়বে।”
তিনি এই এলাকার কৃষকের স্বার্থ বিবেচনা করে সরকারকে সার নিয়ে সংকট কাটাতে ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানান।
এদিকে সার ব্যবসায়ীদের দাবি, সারের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে অনেক ফারাক। তারা বলছেন, অনেক সময় এক সপ্তাহের মধ্যে পুরো স্টক শেষ হয়ে যায়, যার ফলে কৃষকরা সার কিনতে গিয়ে খালি হাতে ফিরে যান।
এ বিষয়ে লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার সার ব্যবসায়ী আমিনুর রহমান বলেন, “বর্তমানে চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ কম হওয়ায় সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে চরাঞ্চলে কৃষি কার্যক্রম বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সারের চাহিদা অনেকগুণ বেড়ে গেছে।
তিনি আরও বলেন, “আমদানি নিষিদ্ধ থাকায় সরকারের বরাদ্দ করা সারের ওপরই আমরা নির্ভরশীল। আর আমরা সরকার নির্ধারিত দামেই সার বিক্রি করি। কোনো ব্যবসায়ী অতিরিক্ত দাম নেয় না।”
লালমনিরহাট জেলা সার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আব্দুল হাকিম বলেন, “সরকার যদি ২০০৯ সালের সার বিতরণ নীতিমালা অনুসারে বরাদ্দ দেয় এবং বর্তমান চাহিদার ভিত্তিতে সরবরাহ বাড়ায়, তবে সংকট থাকবে না।”
তিনি বলেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী যদি কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
লালমনিরহাটের একটি তামাক ক্ষেত।
বরাদ্দেই ঘাটতি
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২০২৫-২৬ রবি মৌসুমে লালমনিরহাট জেলায় প্রায় ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে ভুট্টা, ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো, ৮ হাজার হেক্টর জমিতে আলু, ৩ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষা, ২ হাজার হেক্টর জমিতে চিনাবাদাম এবং ৭ হাজার হেক্টর জমিতে শাকসবজি চাষ হবে।
এসব ফসলের জন্য লালমনিরহাট জেলায় সারের চাহিদা ইউরিয়া ৬৮ হাজার ৯৩২ টন, টিএসপি ৩০ হাজার ২১০ টন, ডিএপি ৪৫ হাজার ৩২০ টন এবং এমওপি ৪৯ হাজার ৬১৬ টন।
চাহিদার বিপরীতে বরাদ্দ পাওয়া গেছে ইউরিয়া ৩৯ হাজার ৬৯০ টন, টিএসপি ১২ হাজার ৭০২ মে.টন, ডিএপি ২৩৫১১ মে.টন এবং এমওপি ১৫৮৫৩ মে.টন।
অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় জেলায় ইউরিয়া ২৯ হাজার ২৪২ টন, টিএসপি ১৭ হাজার ৫০৮ টন, ডিএপি ২১ হাজার ৮০৯ টন এবং এমওপি ৩৩ হাজার ৭৬৩ টন সার কম বরাদ্দ পাওয়া গেছে।
যদিও বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) লালমনিরহাট জেলার মহেন্দ্রনগরে অবস্থিত গুদামে ইউরিয়াবিহীন সারের যথেষ্ট মজুদ রয়েছে বলে দাবি করেছেন লালমনিরহাট বিএডিসির সহকারী পরিচালক একরামুল হক।
মহেন্দ্রনগরে বিএডিসির এই গুদামে দুটি জেলার জন্য (লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম) সার মজুদ রাখা হয়।
একরামুল হক বলেন, “সরকারি গুদামে সব সার মজুদ রয়েছে এবং ডিলাররা এটি সরকারি নিয়ম মেনে সংগ্রহ করে বিক্রি করছেন।”
তিনি বলেন, “সরকার প্রতি কেজি সার বিক্রির জন্য ভর্তুকি প্রদান করছে এবং ডিলাররা কেজিপ্রতি ২ টাকা লাভ করতে পারেন। তবে, কিছু ব্যবসায়ী মুনাফা বাড়ানোর জন্য কৃত্রিম সংকট তৈরি করার চেষ্টা করছেন বলে মনে হচ্ছে।”
লালমনিরহাট জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সাইখুল আরেফিন চাহিদার তুলনায় কিছু কম বরাদ্দ পাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, “এখন পর্যন্ত সারের কোনো সংকট না থাকলেও আমরা অতিরিক্ত বরাদ্দের জন্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছি তবে এখন পর্যন্ত কোনো সাড়া পাইনি।”
তিনি আরও বলেন, “তবে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, নতুন সার নীতিমালা প্রণীত হয়েছে এবং আগামী জানুয়ারি থেকে এটি কার্যকর হবে। এর মাধ্যমে সার সরবরাহের ক্ষেত্রে কারসাজি বন্ধ হবে বলে আশা করা যাচ্ছে “
এই কর্মকর্তা বলেন, “কিছু ব্যবসায়ী অতিরিক্ত মুনাফার জন্য কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে, যা ভোক্তা এবং কৃষকদের জন্য ক্ষতিকর। এর বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট ইতিমধ্যে অভিযান চালাচ্ছে।’’
সংকট বাড়াচ্ছে তামাক চাষ
এদিকে সারের এমন সংকটের মধ্যে নতুন উদ্বেগ সৃষ্টি করছে জেলার তামাক চাষ। চাষিরা বলছেন, লালমণিরহাটে তামাক চাষ বাড়ছে। প্রচুর জমিতে তামাক চাষ হলেও তার জন্য সরকারিভাবে কোনো সারের বরাদ্দ নেই।
কিন্তু তামাক চাষিরা নানাভাবে সার সংগ্রহ করছেন। তাতে রবিশস্য চাষিদের জন্য বরাদ্দকৃত সারের সংকট আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এ বিষয়ে আদিতমারী উপজেলা ভাদাই গ্রামের কৃষক অহিদুল ইসলাম বলেন, “আমি গত বছর ৩ দোন জমিতে তামাক চাষাবাদ করে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা লাভ করেছি। আর ২ দোন জমিতে আলু চাষ করে ৬০ হাজার টাকা লস করেছি। এখন আপনিই বলেন আমার কোনটা চাষাবাদ করা উচিত?”
তবে তামাক চাষের জন্য সার পান না জানিয়ে তিনি বলেন, “সারের দোকানে গেলে ডিলাররা সার না দিয়ে ফেরত দেন আমাদের।”
বরং তামাক চাষিদের জন্য সারের বরাদ্দ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন মহিষখোচা এলাকার কৃষক কূঞ্জরাম। তিনি বলেন, “আমরা যারা তামাক চাষি আছি তারা যেন সহজেই সার পাই সেটি যেন সরকার ব্যবস্থা করে দেন।”
লালমনিরহাট জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সাইখুল আরেফিন বলেন, “জেলায় তামাক চাষ সারের জন্য একটা বড় ফ্যাক্টর। লালমনিরহাটে গত বছর ১৫ হাজার ৫৫০ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছিল। তামাক চাষীরা যেন কোনোভাবেই ভর্তুকি দামের সারটা না পায় আমরা সেটি বিষয়টি নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি।”
“তবে কৃষক তামাক চাষের জন্য অন্য কোনো উপায়ে সার সংগ্রহ করছে। আসলে বিষয়টি খুব জটিল।”
