সন্দেহজনক লিংক, মেসেজ, ইমেইল বা ওয়েবসাইট এড়িয়ে চলা অ্যান্ড্রয়েড ম্যালওয়্যারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর সুরক্ষা।
সংগৃহিত
বিশ্বজুড়ে ব্যবহৃত তিনশ ৯০ কোটি ফোন অ্যান্ড্রয়েডে চলে, যেটি মোট স্মার্টফোনের প্রায় ৭০ শতাংশের সমান। এত বড় ব্যবহারকারী গোষ্ঠী থাকার কারণে অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইসগুলো ম্যালওয়্যার আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ফোন ম্যালওয়্যারে আক্রান্ত হলে সেটি সাইবার অপরাধীদের কাছে ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস করতে পারে, ব্যবহারকারীকে অজস্র বিজ্ঞাপনে জর্জরিত করে ফেলতে পারে এবং ফোনের সামগ্রিক পারফরম্যান্সও মারাত্মকভাবে কমিয়ে দিতে পারে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে প্রযুক্তি সাইট স্ল্যাশগিয়ার।
অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইস সংক্রমিত হওয়ার একটি সাধারণ উপায় হলো সন্দেহজনক অ্যাপ ইনস্টল করা, যেগুলোর মধ্যে ম্যালওয়্যার লুকিয়ে থাকতে পারে। অজানা থার্ড পার্টি ‘অ্যাপ স্টোর’ থেকে অ্যাপ ডাউনলোড করা বা পেইড সফটওয়্যারের ক্র্যাকড ভার্সন ইনস্টল করাই স্মার্টফোনকে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে ফেলে।
এসব অ্যাপ স্মার্টফোনের উপর অযাচিত নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে এবং ক্ষতি করতে পারে। তাছাড়া সন্দেহজনক লিংকে ক্লিক করা বা হ্যাকড ওয়েবসাইট ভিজিট করাও অ্যান্ড্রয়েড ম্যালওয়্যারের শিকার হওয়ার অন্যতম উপায়। তুলনামূলকভাবে বিরল হলেও কিছু ক্ষতিকর ইউএসবি ডিভাইস বা কেবলও শারীরিকভাবে ম্যালওয়্যার ছড়িয়ে ফোন আক্রান্ত করতে পারে।
যেভাবেই সংক্রমণ ঘটুক না কেন, আক্রান্ত অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইস কিছু নির্দিষ্ট লক্ষণ দেখায় যা থেকে বোঝা যায় ভেতরে কিছু একটা গণ্ডগোল হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে বারবার পপ-আপ বিজ্ঞাপন দেখা, হঠাৎ ডেটা খরচ বেড়ে যাওয়া, অস্বাভাবিক কার্যকলাপ ইত্যাদি। নিচে দেওয়া হলো এমন পাঁচটি লক্ষণ, যা দেখে বোঝা যেতে পারে আপনার ফোন ম্যালওয়্যারে আক্রান্ত।
১. হঠাৎ পপ-আপ বিজ্ঞাপন দেখা
অ্যাডওয়্যার হলো এক ধরনের সাধারণ ম্যালওয়্যার যা অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইসে প্রভাব ফেলে। সাধারণত স্মার্টফোনে ভিডিও দেখার সময়, ইন্টারনেট ব্রাউজ করার সময় বা অ্যাড-সাপোর্টেড অ্যাপ ব্যবহারের সময় বিজ্ঞাপন দেখা স্বাভাবিক। কিন্তু ম্যালওয়্যারে আক্রান্ত ফোনে এসব বিজ্ঞাপন দেখা যায় অস্বাভাবিক ঘনঘন হারে এবং বেশ বিরক্তিকরভাবে।
এ ধরনের পপ-আপ হঠাৎ করে যেকোনো অ্যাপ বা ব্রাউজারে দেখা দিতে পারে, বন্ধ করাও কঠিন হয়। কখনো কখনো এসব পপ-আপে ক্লিক না করলেও তা বিজ্ঞাপিত পণ্য বা অ্যাপের পেইজে নিয়ে যেতে পারে।
আরও ভয়ংকর বিষয় হলো, এসব বিজ্ঞাপন অনেক সময় এমন ওয়েবসাইটে নিয়ে যায় যা নিজেরাই ম্যালওয়্যার-আক্রান্ত ফলে আরও বড় হুমকি তৈরি হয়। এসব বিজ্ঞাপন সাধারণত ব্যাকগ্রাউন্ডে কাজ করা ম্যালওয়্যার-আক্রান্ত অ্যাপের মাধ্যমে আসে।
শুধু যে ক্রমাগত বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ফোন ব্যবহার করা অসম্ভব করে তোলে তাই নয় বরং ব্যবহারকারীর অনলাইন কার্যক্রমও ট্র্যাক করে ভবিষ্যতে আরও বেশি টার্গেটেড বিজ্ঞাপন দেখাতে পারে।
২. ফোনে অচেনা অ্যাপ দেখা
সন্দেহজনক অ্যাপই স্মার্টফোনে ম্যালওয়্যার প্রবেশের সবচেয়ে সাধারণ মাধ্যম। যদি ফোনে এমন কোনো অ্যাপ দেখতে পান যা ইনস্টল করেছেন বলে মনে পড়ছে না, তবে সেটিতে ম্যালওয়্যার থাকার সম্ভাবনা প্রবল।
অনেক সময় মানুষ থার্ড পার্টি অ্যাপ স্টোর থেকে মড বা ক্র্যাকড অ্যাপ ডাউনলোড করতে গিয়ে ঝুঁকিতে পড়ে। এসব ক্ষতিকর স্টোরে মূল অ্যাপটিকে পরিবর্তন করে তার সঙ্গে ম্যালওয়্যার যোগ করা হয় বা সম্পূর্ণ ভিন্ন অ্যাপ ইনস্টল হয়। ফলে ব্যবহারকারীরা অজান্তেই তাদের ফোনে ভাইরাস ইনস্টল করে ফেলেন।
গুগল প্লে স্টোর তুলনামূলকভাবে নিরাপদ কারণ এখানে অ্যাপগুলো নিয়মিতভাবে স্ক্যান করা হয় এবং গুগলের ‘প্লে প্রোটেক্ট’ সিকিউরিটি ব্যবস্থা নীতিভঙ্গকারী অ্যাপ নিষিদ্ধ করে। এমনকি থার্ড পার্টির স্টোর থেকে অ্যাপ ইনস্টল করলেও প্লে প্রোটেক্ট তা স্ক্যান করে নেয়। যদিও কিছু ম্যালওয়্যার ফাঁক গলে ঢুকে যেতে পারে।
যদি ফোনে এমন সন্দেহজনক অ্যাপ খুঁজে পান, সঙ্গে সঙ্গে আনইনস্টল করুন এবং প্লে প্রোটেক্ট দিয়ে ম্যানুয়াল স্ক্যান চালান। প্রয়োজনে অতিরিক্ত সিকিউরিটি চেক চালিয়ে বা ফোন রিসেট করে সুরক্ষা নিশ্চিত করুন। মনে রাখবেন কেবল অফিসিয়াল বা নির্ভরযোগ্য উৎস থেকেই অ্যাপ ডাউনলোড করা উচিত।
৩. ফোনের গতি কমে যাওয়া ও অতিরিক্ত গরম হওয়া
সাধারণভাবে আধুনিক স্মার্টফোনগুলো অ্যাপ চালানো, ওয়েব ব্রাউজ করা বা ডেটা সংরক্ষণ করার মতো কাজ সহজেই করতে পারে কিন্তু ম্যালওয়্যারে আক্রান্ত ফোনের প্রসেসরকে এসবের পাশাপাশি ব্যাকগ্রাউন্ডে অতিরিক্ত কাজ করতে হয়।
ম্যালওয়্যার ব্যাকগ্রাউন্ডে চলতে থেকে ফোনের কন্টাক্ট লিস্ট, ইমেইল, ডিভাইস ইনফরমেশনসহ নানা ডেটা চুরি করতে পারে যা ভবিষ্যতে পরিচয় চুরির মতো অপরাধে ব্যবহার হতে পারে। এই অতিরিক্ত চাপ ফোনকে ধীর করে দেয় এবং নিয়মিত কাজ করতেও সমস্যা তৈরি করে।
অপ্রয়োজনীয় এই ব্যাকগ্রাউন্ড প্রক্রিয়াগুলো ফোনকে অকারণে অতিরিক্ত গরম করে তুলতে পারে এমনকি ভারি গেইম খেলা বা ভিডিও এডিট করার সময়ের মতোও। একই সঙ্গে ব্যাটারি দ্রুত ফুরিয়ে যেতে থাকে।
তবে ধীর গতি, দ্রুত ব্যাটারি শেষ হওয়া বা গরম হয়ে যাওয়া পুরনো ফোনের ক্ষেত্রেও স্বাভাবিক হতে পারে। তাই সঠিক কারণ নিশ্চিত করতে অ্যান্টিভাইরাস অ্যাপ দিয়ে পরীক্ষা করা উচিত। যদি ম্যালওয়্যার না থাকে, তাহলে অপ্রয়োজনীয় ফাইল বা অ্যাপ মুছে ফোনের গতি বাড়ানো যেতে পারে।
৪. ডেটা ব্যবহারে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি
ম্যালওয়্যার আক্রান্ত ফোন শুধু পারফরম্যান্স নয়, ডেটা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সমস্যা তৈরি করে। কারণ এসব ক্ষতিকর অ্যাপ নিয়মিতভাবে সার্ভারের সঙ্গে যোগাযোগ করে তথ্য পাঠায় ও গ্রহণ করে।
এতে করে মোবাইল ডেটা দ্রুত শেষ হয়ে যায় এবং সীমিত ডেটা প্যাক ব্যবহারকারীদের জন্য বাড়তি খরচের কারণ হয়। ব্যাকগ্রাউন্ডে এমন ডেটা ট্রান্সফার চলতে থাকলে আপনার অন্যান্য অ্যাপের নেট স্পিডও কমে যেতে পারে।
অ্যান্ড্রয়েডের সেটিংস থেকে ‘ডেটা ইউসেজ’ অপশনে গিয়ে দেখে নেওয়া যায় কোন অ্যাপ কত ডেটা ব্যবহার করছে। কোনো অপরিচিত বা অদ্ভুত অ্যাপ যদি অস্বাভাবিক পরিমাণে ব্যাকগ্রাউন্ড ডেটা ব্যবহার করে তাহলে সতর্ক হোন।
অনেক সময় ম্যালওয়্যার নিজেকে ‘সিস্টেম অ্যাপ’ হিসেবে লুকিয়ে রাখে। সাধারণ সিস্টেম অ্যাপ তেমন ডেটা ব্যবহার করে না, তাই ক্যালকুলেটর, ক্যালেন্ডার বা ওয়ালপেপার অ্যাপের মতো সাধারণ অ্যাপের ব্যাকগ্রাউন্ড ডেটা বন্ধ করে দিলে ম্যালওয়্যারের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
৫. অজানা কার্যকলাপ দেখা দেওয়া
অনেক সময় ম্যালওয়্যার ফোনে এমন কিছু পরিবর্তন ঘটায় যা প্রথমে তেমন গুরুত্ব না পেলেও বিপজ্জনক হতে পারে। যেমন ব্রাউজারের হোমপেইজ নিজে থেকেই কোনো বিজ্ঞাপন সাইটে বদলে যাওয়া অথবা পরিচিতদের কাছে সন্দেহজনক লিংক পাঠানো। এতে লিংকটি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় কারণ তা পরিচিত কারো কাছ থেকে এসেছে।
আরও ভয়ংকর হলো স্পাইওয়্যার, এটি কিবোর্ডে কী টাইপ করছেন সেটিও নজরদারি করতে পারে। এতে করে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, ক্রেডিট কার্ড, এমনকি সোশাল সিকিউরিটি তথ্যও ফাঁস হয়ে যেতে পারে।
যদি ফোনে অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ্য করেন যেমন হঠাৎ অজানা লেনদেন বা সন্দেহজনক মেসেজ তাহলে সেটি ম্যালওয়্যারের ফল হতে পারে। নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাস টুল দিয়ে এসব স্পাইওয়্যার সরানো সম্ভব হলেও একবার তথ্য ফাঁস হয়ে গেলে তা উদ্ধার করা কঠিন।
ব্যাংকিং বা ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁসের আশংকা থাকলে অবিলম্বে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত। সার্বিকভাবে, ইন্টারনেট ব্যবহারে সচেতনতা যেমন সন্দেহজনক লিংক, মেসেজ, ইমেইল বা ওয়েবসাইট এড়িয়ে চলা অ্যান্ড্রয়েড ম্যালওয়্যারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর সুরক্ষা।
