দূষণ ছড়ায় এমন অনেক পণ্যই হয়ত না জেনে ব্যবহার করা হচ্ছে।
হতে সংগৃহিত
অনেকেরই ধারণা, ঘরের ভেতরের বাতাস বাইরের তুলনায় নিরাপদ। তবে বিজ্ঞান বলছে, ঘরের ভেতরেই এমন কিছু বস্তু ও কাজ প্রতিদিন চলে, যা ধীরে ধীরে বাতাস দূষিত করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং’য়ের ডিন ও অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণ বিশেষজ্ঞ রিচার্ড করসি রিয়েলসিম্পল ডটকম-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেন, “ঘরের ভেতরে এমন অনেক কণিকা, রাসায়নিক পদার্থ ও বিষাক্ত গ্যাস নিঃশ্বাসে নিচ্ছি যা হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যানসার, এমনকি স্নায়ুজনিত রোগেরও কারণ হতে পারে।”
বায়ু দূষণের ধরন
সূক্ষ্ম কণিকা: ধুলোবালির সঙ্গে আরও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাও বাতাসে ভেসে বেড়ায়। এগুলোর মধ্যে আছে পরাগ, পশুর লোম, রান্নার ধোঁয়া থেকে উৎপন্ন অতি সূক্ষ্ম কণা। এগুলো ফুসফুসের গভীরে গিয়ে জমা হয়।
ভোলাটাইল অর্গানিক কমপাউন্ডস (ভিওসি): এগুলো কার্বনভিত্তিক রাসায়নিক, যা সহজেই বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। রং, ফার্নিচার, পেস্টিসাইড, গ্লু বা পরিষ্কারক দ্রব্যে এগুলোর উপস্থিতি বেশি।
সেমি-ভোলাটাইল কমপাউন্ডস (এসভিওসি): এগুলো তরল বা কঠিন অবস্থায় থেকে ধীরে ধীরে বাতাসে ছড়ায়। যেমন- আসবাব ও ম্যাট্রেসে ব্যবহৃত আগুন প্রতিরোধক রাসায়নিক বা ‘ফরএভার কেমিকেল’।
বিষাক্ত গ্যাস: গ্যাসচালিত চুলা বা হিটার থেকে উৎপন্ন নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, ক্লোরিন, অ্যামোনিয়া বা কার্বন মনোক্সাইড বাতাসে মিশে যায়।
ওজোন: তিনটি অক্সিজেন পরমাণুর সমন্বয়ে তৈরি ওজোন গ্যাস সহজেই অন্য রাসায়নিকের সঙ্গে বিক্রিয়া করে আরও ক্ষতিকর যৌগ তৈরি করে।
প্রতিদিনের নয়টি উৎস
দেয়াল, মেঝে ও আসবাবপত্র: নতুন রং, ফার্নিচার বা ভিনাইল ফ্লোরিং থেকে নিঃসৃত রাসায়নিক বাতাসে মিশে যায়।
করসি বলেন, “এই রাসায়নিকের কিছু অংশ কয়েক দিনের মধ্যে মিলিয়ে যায়। তবে কিছু অংশ বছরের পর বছর বাতাসে ভাসতে থাকে।”
বিশেষ করে ম্যাট্রেসে থাকা ‘ফরএভার কেমিকেল’ রাতে দীর্ঘ সময় ধরে শরীরে প্রবেশ করে।
গ্যাসচালিত চুলা: গ্যাসচালিত চুলা নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড এবং অতিক্ষুদ্র কণিকা তৈরি করে, যা মস্তিষ্কে জমা হয়ে স্নায়ুর ক্ষতি করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, গ্যাসচালিত চুলা শিশুদের হাঁপানির ঝুঁকি বাড়ায়।
মোমবাতি ও সুগন্ধি পণ্য: মোমবাতির মিষ্টি গন্ধের পেছনেও থাকে ভিওসি এবং সূক্ষ্ম কণিকা। কয়েক মিনিট জ্বালালেও বাতাসে দূষণ ছড়িয়ে পড়ে।
করসি বলেন, “ধূপ মোমবাতির চেয়েও বেশি ক্ষতিকর। গবেষণায় এর সঙ্গে ক্যান্সারের সম্পর্ক পাওয়া গেছে।”
বাইরের বাতাস: বাইরের ধোঁয়া, গাড়ির এক্সজস্ট বা আগুনের ধোঁয়া জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকে যায়। তাই অনেক সময় বাইরের বাতাসও ঘরের ভেতরের মান নষ্ট করে।
পরিষ্কারক দ্রব্য: প্রাকৃতিক লেখা থাকলেও অনেক পরিষ্কারকে থাকে ভিওসি বা এসভিওসি, যা ব্যবহারের সময় বাতাসে মিশে যায়।
গ্যারাজের রাসায়নিক পদার্থ: গ্যাসলিন বা অন্যান্য দাহ্য পদার্থ গ্যারাজে রাখলে সেগুলোর বাষ্প ঘরে ঢুকে যেতে পারে।
করসি বলেন, “গ্যাসলিন থেকে নির্গত বেঞ্জিন একটি কার্সিনোজেনিক পদার্থ, যা রক্তের ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়।”
ছত্রাক, ভাইরাস ও ব্যাক্টেরিয়া: বাথরুম বা স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় থাকা ছত্রাকের সূক্ষ্ম কণা, ব্যাক্টেরিয়া ও ভাইরাস বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। অসুস্থ ব্যক্তির হাঁচি-কাশির মাধ্যমেও ভাইরাস বাতাসে থাকে।
কাঠের আগুন: অনেক ঘরে এখনো কাঠের চুলায় রান্না হয়। কাঠের ধোঁয়ায় থাকে সূক্ষ্ম কণিকা ও কার্বন মনোক্সাইড, যা ফুসফুসের ক্ষতি করে।
পোষা প্রাণী ও ফুল: প্রাকৃতিক উৎস থেকেও দূষণ হতে পারে। পোষা প্রাণীর লোম, মানুষের ত্বকের ক্ষুদ্র কণা ও ফুলের পরাগ বাতাসে মিশে অ্যালার্জি বাড়ায়।
ঘরের বাতাস পরিষ্কার রাখার উপায়
বাতাস চলাচল নিশ্চিত: জানালা খুলে বা এক্সহস্ট ফ্যান চালিয়ে ঘরের বাতাস পরিবর্তন করতে হবে। তবে যদি ঘরের বাইরে শিল্প এলাকা বা ব্যস্ত সড়ক থাকে, তখন বাইরের বাতাস টানলে বরং দূষণ বাড়তে পারে।
এয়ার পিউরিফায়ার ব্যবহার: ভালো মানের এয়ার পিউরিফায়ার ধুলা, ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাস এবং ক্ষতিকর গ্যাস কমাতে সাহায্য করে।
সচেতনভাবে পণ্য বাছাই: প্রাকৃতিক উপাদান বা কম রাসায়নিকযুক্ত পণ্য ব্যবহার করতে হবে।
মোমবাতি জ্বালালে সতর্ক থাকা: ঘর সাজতে অনেকেই মোমবাতি জ্বালান।
করসি পরামর্শ দেন, “মোমবাতির শিখা যেন স্থির থাকে— হাওয়া লেগে টিমটিম করলে অসম্পূর্ণ দহন হয় এবং বাতাসে কণিকা বাড়ে।”
উঁচু কাচের পাত্রে মোমবাতি রাখলে শিখা স্থির থাকে।
সিলিং ফ্যান ব্যবহার: করসি বলেন, “ওভারহেড ফ্যান বাতাস সমানভাবে ছড়িয়ে দেয়। এতে নির্দিষ্ট জায়গার দূষণ কমে যায়।”
নিরাপদভাবে পরিষ্কার করা: ধুলো জমলে শুকনা ঝাড়ু বা ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের বদলে ভেজা মপ ব্যবহার করতে হবে। এতে ধুলো উড়বে না এবং ‘এসভিওসি’ মিশে বাতাসে ছড়াবে না।
সুগন্ধি পণ্য কম ব্যবহার: করসি বলেন, “ওজোন’ গ্যাস সুগন্ধি পণ্যের সঙ্গে বিক্রিয়া করে শতাধিক নতুন রাসায়নিক তৈরি করে, যেগুলোর অনেকগুলোর বিষক্রিয়া এখনও অজানা। তাই যে এলাকা ওই গ্যাসের পরিমাণ বেশি থাকে সেখানে সুগন্ধি পণ্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাবধান হতে হবে।”
