সব কিছু পরিকল্পনা মতো হবে এমন মনোভাব ধরে রাখলে ছুটি কাটিয়েও অতৃপ্তি থেকে যেতে পারে।
সংগৃহিত
ছুটি মানেই আনন্দ, বিশ্রাম, ঘোরাঘুরি আর মানসিক প্রশান্তির সময়। তবে অনেক সময় সেই বহুল প্রতীক্ষিত ছুটি শেষ হয় হতাশা, ক্লান্তি কিংবা এক ধরনের আফসোস বা অপরাধবোধ নিয়ে।
মনে হয়, এত সময় আর টাকা খরচ করে ঘুরে এসেও মন ভরলো না বা হয়ত পরিবার-বন্ধুদের মতো উপভোগ করা হলো না।
এই অনুভূতির নাম হল ‘ভ্যাকেশন গিল্ট’ বা ছুটি-পরবর্তী অপরাধবোধ।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, এটি একেবারেই স্বাভাবিক। আর এর পেছনে রয়েছে মানুষের প্রত্যাশা ও বাস্তবতার অমিল।
ছুটির সময় অপরাধবোধ কেন হয়?
ছুটি বা ভ্রমণ এমন এক ধারণা, যা অনেকের কাছে বিলাসিতা বা বিশেষ অভিজ্ঞতা হিসেবে ধরা হয়। যেখানে কর্মজীবীদের বেশিরভাগেরই দীর্ঘ বেতনসহ ছুটি পাওয়া সম্ভব নয়, সেখানে একটি ছুটি মানেই বিরল এক মুক্তির সুযোগ।
তাই মানুষ সেটির জন্য অনেক পরিকল্পনা করে, অনেক প্রত্যাশা গড়ে তোলে। তবে বাস্তবে সেই ছুটি যদি প্রত্যাশামতো আনন্দ বা প্রশান্তি না এনে দেয়, তখনই শুরু হয় অপরাধবোধ বা আফসোস।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্লিনিক্যাল মনোবিজ্ঞানী কার্লা মেরি ম্যানলি ওয়েলঅ্যান্ডগুড ডটকম’য়ে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই বিষয়ে বলেন, “ছুটিকে নিখুঁত বা একদম ‘পারফেক্ট’ কিছু ভাবা এক ধরনের আত্মবিধ্বংসী চিন্তা। কোনো ছুটি কখনই শতভাগ নিখুঁত হতে পারে না।”
আবহাওয়ার পরিবর্তন, বিমান বিলম্ব, থাকার জায়গা প্রত্যাশামতো না হওয়া বা প্রিয়জনদের সঙ্গে অপ্রত্যাশিত তর্ক এসব সাধারণ ঘটনা।
তবে এগুলোই যদি ছুটির মানে বদলে দেয়, তাহলে আনন্দের জায়গায় চলে আসে হতাশা আর অপরাধবোধ।
‘জর্জ ওয়াশিংটন স্কুল অব মেডিসিন অ্যান্ড হেল্থ সায়েন্সেস’য়ের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও সহযোগী অধ্যাপক লরেঞ্জো নরিস বলেন, “অধিকাংশ মানুষ ভ্রমণে গিয়ে চারটি বিষয় অর্জন করতে চায়। যার মধ্যে রয়েছে বিশ্রাম, সম্পর্কের সংযোগ, আত্মচিন্তা এবং রোমাঞ্চ। তবে যখন এই চারটির কোনো একটি বাস্তবে মেলে না, তখনই জন্ম নেয় অপরাধবোধ।”
হয়তো কেউ ছুটিতে গেছেন কেবল বিশ্রামের উদ্দেশ্যে, তবে রিসোর্টে গিয়ে তিনি একঘেয়েমিতে ভুগছেন। তখনই মনে হতে পারে- সময় ও অর্থ নষ্ট হল।
আবার কেউ যদি বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে মনমতো আনন্দ না পান বা অন্যরা বেশি উপভোগ করছে মনে হয়—তাহলেই শুরু হয় আত্মদোষারোপ।
নরিস বলেন, “যখন ভাবেন ছুটিতে সব কিছু ঠিকঠাক হয়নি, তখনই মনে হয় কিছু ভুল করেছেন বা অন্যদের হতাশ করেছেন। তবে আসলে এটি মানসিক এক প্রতিক্রিয়া মাত্র।”
এই অপরাধবোধ অনেক সময় হতাশার সঙ্গেও যুক্ত থাকে। কারণ মানুষ ভাবে- ‘চাইলে এটা ঠিক করতে পারতাম’, অথচ ছুটি তো শেষ হয়ে গেছে।
নরিসের মতে, “অপরাধবোধ বা আফসোস এমন এক অনুভূতি, যা সবসময় একটু দেরিতে আসে, ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর। তাই যখন সেটি ঠিক করতে চাই, তখনই শুরু হয় অপরাধবোধের ঘূর্ণি।”
প্রত্যাশা বনাম বাস্তবতা
এই মনোবিজ্ঞানীরা মন্তব্য করেন- অনেকেই মনে করেন একটি ছুটি তাদের সমস্ত চাপ, সম্পর্কের টানাপোড়েন বা কাজের ক্লান্তি দূর করে দেবে। তবে সেটি বাস্তবসম্মত নয়।
নরিস বলেন, “যদি কেউ ভাবে ছুটি মানেই জীবনের সব সমস্যার সমাধান, তবে সেটি এক ধরনের ভুল প্রত্যাশা। নিজেকে সহানুভূতির সঙ্গে বুঝতে হবে ছুটি কোনো নায়কোচিত উদ্ধার অভিযান নয়।”
অর্থাৎ- যতই সুন্দর জায়গায় যাওয়া হোক, মানসিক ভারসাম্য বা ব্যক্তিগত অশান্তি থাকলে নতুন পরিবেশে গিয়েও সেটা দূর হবে না।
কীভাবে কাটিয়ে উঠবেন ‘ভ্যাকেশন গিল্ট’?
বাস্তবসম্মত প্রত্যাশা নির্ধারণ: ছুটির আগে নিজের উদ্দেশ্য পরিষ্কারভাবে ঠিক করা। সিদ্ধান্ত নিতে হবে চাওয়া কী- শরীরচর্চা থেকে বিরতি, পরিবারে সময়, না-কি নিঃশব্দ বিশ্রাম?
সেটি স্পষ্ট থাকলে পরিকল্পনা বাস্তবসম্মত হয় এবং অনিশ্চিত পরিস্থিতিতেও মানিয়ে নেওয়া যায়।
কার্লা ম্যানলি বলেন, “যদি পরিষ্কারভাবে জানেন কী চান, তাহলে ছুটির প্রাকৃতিক অসম্পূর্ণতাকেও সহজভাবে গ্রহণ করতে পারবেন।”
যদি প্রধান লক্ষ্য হয় সঙ্গীর সঙ্গে সময় কাটানো, তাহলে হোটেলের বুকিং বাতিল বা কোনো স্থান বন্ধ থাকলেও জানবেন মূল লক্ষ্যটি পূরণ হয়েছে।
অনুভূতিকে অস্বীকার না করে গ্রহণ: অনেকেই অপরাধবোধ এড়িয়ে যেতে চান। তবে মনোবিজ্ঞানীদের পরামর্শ- এই অনুভূতিও একটি বার্তা বহন করে।
ম্যানলির মতে, “যখন অপরাধবোধ সহায়ক হয়, তখন এটি জানায় কোথাও কিছু ভুল হয়েছে। তখন সেই শিক্ষা নিতে পারি, তারপর সেটি ছেড়ে দিতে পারি।”
ছুটি শেষে যদি খারাপ লাগা আসে, সেটিকে কিছুটা সময় দিতে হবে। ভাবতে হবে, আসলে কেন এমন লাগছে।
হয়তো সময় ব্যবস্থাপনায় ভুল ছিল বা অতিরিক্ত প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। এসব বিষয় চিনে নিতে হবে, ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা নিতে হবে, তারপর সেটিকে ছেড়ে দেওয়াই ভালো।
নরিস বলেন, “অপরাধবোধকে সত্য হিসেবে না ভেবে সংকেত হিসেবে দেখতে হবে। নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে, এই অনুভূতির পেছনে বাস্তব প্রমাণ আছে কি?”
যেমন- কোনো ঐতিহাসিক স্থানে যেতে পারেননি ভিড়ের কারণে, এটা কি আপনার দোষ? নিশ্চয়ই না। তাই নিজেকে দোষ না দিয়ে বাস্তবতাকে মেনে নেওয়া উচিত।
অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা: প্রতিটি ছুটিই এক একটি শেখার সুযোগ। হয়ত একঘেয়ে রিসোর্টে গিয়ে বিরক্ত হয়েছেন, অথবা এত বেশি পরিকল্পনা করেছিলেন যে- কোনো মুহূর্তই উপভোগ করতে পারেননি। পরেরবার সেই অভিজ্ঞতাগুলো মাথায় রাখতে হবে।
নরিস ও ম্যানলি দুজনেই পরামর্শ দেন, “হলে সব কিছু, না হলে কিছুই নয়- এই মানসিকতা ত্যাগ করা জরুরি। যদি সামান্য আনন্দও পান, সেটিও সাফল্য।”
কৃতজ্ঞতা প্রকাশ: সবশেষে, কৃতজ্ঞতার চর্চা করতে হবে। হয়ত পুরো ভ্রমণ প্রত্যাশা মতো হয়নি, তবে কিছু না কিছু তো ভালো লেগেছে— সেটা হতে পারে প্রকৃতির রূপ, হয়ত কোনো নতুন অভিজ্ঞতা বা শুধু নিরাপদে ফিরে আসাটাই আনন্দের বিষয়।
ড. নরিস বলেন, “ছুটি শেষে নিরাপদে বাড়ি ফেরাই হতে পারে এক আনন্দের কারণ। জীবনের দৃষ্টিভঙ্গিই নির্ধারণ করে আপনি কেমন অনুভব করবেন।”
