নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী এই নারী দমন-পীড়নের শিকার হয়েও হাল ছাড়েননি। সংকট জর্জরিত ভেনেজুয়েলায় দশকের পর দশক তিনি কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্রের সুরক্ষার জন্য লড়াই করে গেছেন।
হতে সংগৃহিত
ভেনেজুয়েলায় বাড়তে থাকা কর্তৃত্ববাদের মুখে প্রতিরোধ এবং গণতন্ত্রের জন্য লড়াইয়ের প্রতীক হয়ে ওঠা মারিয়া কোরিনা মাচাদো এবছরের নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন।
ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর কঠোর শাসনের বিরোধিতায় মাচাদো এক গুরুত্বপূর্ণ মুখ এবং নির্ভীক এক কর্মী। জনগণের কাছে যার আবেদন একজন রক-স্টারের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। ৫৮ বছর বয়সী মাচাদো ভেনেজুয়েলার ‘লৌহ মানবী’ হিসেবেও পরিচিত।
বারবার দমন-পীড়নের শিকার হয়েও মাচাদো হাল ছাড়েননি। সংকট জর্জরিত একটি দেশে দশকের পর দশক তিনি কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্রের সুরক্ষার জন্য লড়াই করে গেছেন, অন্ধকার ঘনিয়ে এলেও গণতন্ত্রের শিখা জ্বালিয়ে রেখেছেন।
দেশবাসীকে গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে সচেতন করেছেন। তাদের সেই অধিকারের সুরক্ষায় অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। একনায়কতন্ত্র থেকে ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রামের নেপথ্যেও রয়েছেন এই মারিয়া কোরিনা মাচাদো।
সে কারণে এ বছর নরওয়ের নোবেল কমিটি তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। শুক্রবার নরওয়ের অসলোতে মারিয়ার নাম ঘোষণা করেছে কমিটি। এই পুরস্কারকে ভেনেজুয়েলার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এক ঐতিহাসিক স্বীকৃতি হিসাবেই দেখা হচ্ছে।
নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান ইয়রগেন ওয়াটনে ফ্রিডনেস সাংবাদিকদের সামনে মাচাদোর নাম ঘোষণার শুরুতেই বলেন, “এই পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে একজন সাহসী এবং নিবেদিতপ্রাণ শান্তির চ্যাম্পিয়নকে, একজন নারীকে যিনি অন্ধকারেও গণতন্ত্রের আলো জ্বলিয়ে রেখেছেন”।
নোবেল প্রাইজ কমিটির তথ্যানুযায়ী, আলফ্রেড নোবেলের উইলে উল্লেখিত শান্তি পুরস্কার প্রার্থী নির্বাচনের তিন শর্তই পূরণ করেছেন মাচাদো।
তিনি দেশের বিরোধী দলগুলোকে এক করেছেন, ভেনেজুয়েলার সমাজে সামরিকীকরণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন, শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পক্ষে দৃঢ়ভাবে কাজ করে গেছেন।
নোবেল পুরস্কার কমিটি আরও বলেছে, মাচাদো দেখিয়েছেন, গণতন্ত্র ও শান্তির পন্থা এক। তিনি এমন এক ভবিষ্যতের আশা প্রকাশ করেন, যেখানে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত থাকবে এবং তাদের কণ্ঠ শোনা যাবে। তারা শান্তিতে বাঁচার স্বাধীনতা পাবে।
মাচাদো সাম্প্রতিক সময়ে লাতিন আমেরিকায় সাহসিকতার এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান বলেন, গুরুত্বপূর্ণ ঐক্যের প্রতীক হিসেবে কাজ করেছেন মাচাদো। তিনি একসময় বিভক্ত থাকা বিরোধীদের একত্রিত করেছেন এবং দেখিয়েছেন—গণতন্ত্রের হাতিয়ারই শান্তির হাতিয়ার।”
মাচাদো আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হওয়া এবং তার জীবনের ওপর গুরুতর হুমকির পরও দেশে থেকেছেন। তার এই সিদ্ধান্ত লাখ লাখ মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে বলেই ভাষ্য চেয়ারম্যান ফ্রিডনেসের।
মারিয়া কোরিনা মাচাদোর ইতিবৃত্ত:
মারিয়া কোরিনা মাচাদোর জন্ম ভেনেজুয়েলার কারাকাসে ৭ অক্টোবর ১৯৬৭ সালে। এ সপ্তাহে তার বয়স হতে চলেছে ৫৮ বছর। তার মা ছিলেন মনস্তত্ত্ববিদ। বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী।
মাচাদো ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করেছেন। এরপর তিনি অর্থনীতিতে মাস্টার্সও করেন। পরবর্তীতে ব্যবসাক্ষেত্রে তিনি কিছু সময় কাজ করেছিলেন।
১৯৯২ সালে তিনি এতিম ও পথশিশুদের জন্য একটি ফাউন্ডেশন খোলেন যার নাম ছিল ‘এটেনা ফাউন্ডেশন’। এর ১০ বছর পর ২০০২ সালে মাচাদো ভোট পর্যবেক্ষণ সংগঠন ‘সুমাত’ এর সহপ্রতিষ্ঠাতা হন।
এই সংগঠনের লক্ষ্য ছিল অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বচনের প্রচার চালানো। এই সংগঠনের মধ্য দিয়েই আনুষ্ঠানিকভাবে মাচাদোর পদার্পণ ঘটে রাজনীতিতে। তিনি বিবাহিত। তিন সন্তান রয়েছে তার।
মাচাদোর রাজনৈতিক পথ পরিক্রমা:
২০১০ সালে মাচাদো রেকর্ড সংখ্যক ভোট পেয়ে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালে তৎকালীন প্রশাসন তাকে পদচ্যুত করে । তার আগ পর্যন্ত তিনি পদে ছিলেন।
পরে তিনি ভেন্টে ভেনেজুয়েলার জাতীয় সমন্বয়ক হন। ২০১২ সালে ভেনেজুয়েলায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘ভেন্টে ভেনেজুয়েলা’ নামের উদার এই রাজনৈতিক দল। এই দলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মারিয়া মাচাদো। বর্তমানে তিনি দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
ভেন্টে ভেনেজুয়েলার সমন্বয়ক হওয়ার ৫ বছর পর মাচাদো সয় ভেনেজুয়েলা অ্যালায়েন্স গড়তে সহায়তা করেন, যার লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত দলগুলো থেকে গণতন্ত্রপন্থি শক্তিকে একত্রিত করা।
আত্মগোপনে গিয়েছিলেন কখন?
২০২৩ সালে বিরোধীদলীয় প্রাইমারি নির্বাচনে ৯২ শতাংশ ভোটে বিশাল জয় পেয়েছিলেন মাচাদো। তার সমাবেশগুলোতেও বিপুল লোক সমাগম হয়েছিল।
২০২৪ সালের জুলাইয়ে ভেনেজুয়েলায় অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নিকোলাস মাদুরোর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু মাচাদোর ওপর আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি। ফলে মাচাদো বিরোধীদলীয় প্রার্থী হিসেবে এডমুন্ডো গঞ্জালেসকে সমর্থন দেন এবং তার পক্ষে প্রচার চালিয়েছিলেন।
তবে ২০২৪ সালে ভেনেজুয়েলার নির্বাচনের ফল নিয়ে নিয়ে ব্যাপক বিরোধ দেখা দেয়। জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে বর্তমান প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর বিরুদ্ধে।
দেশটির নির্বাচন কর্তৃপক্ষ প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোকেই জয়ী ঘোষণা করে। তবে বিরোধীরা এই ফল প্রত্যাখ্যান করে। ভোট জালিয়াতির অভিযোগ তুলে তারা দাবি করে, নির্বাচনে বিরোধী প্রার্থী এডমুন্ডো গঞ্জালেস জয়ী হয়েছেন।
ভোটের ফল প্রকাশের পর তা বাতিলের দাবিতে ভেনেজুয়েলাজুড়ে বিক্ষোভ হয়। প্রেসিডেন্ট মাদুরো কঠোর হাতে বিক্ষোভ দমন করেন। এতে ২০ জনের বেশি বিক্ষোভকারী নিহত হয়।
সরকারের দমন-পীড়নের মুখে বিরোধী নেতা গঞ্জালেস আত্মগোপনে থাকার পর দেশ ছাড়েন। জীবনের ঝুঁকি থাকায় আত্মগোপনে যেতে হয় মারিয়া কোরিনা মাচাদোকেও।
তবু তাকে দমানো যায়নি। মাদুরোর বিরুদ্ধে দেশজুড়ে বিক্ষোভ চললেও, মাচাদো নির্যাতন, নিষেধাজ্ঞা ও হুমকির মুখেও তার লড়াই থামাননি।
নিভৃতে থেকেও মাচাদো কেবল স্বাধীন নির্বাচনের দাবি তোলাই নয়, বরং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোও তুলে ধরছেন। গণতন্ত্রের নৈতিক কণ্ঠস্বর হিসেবে তিনি রয়ে গেছেন কারাকাসের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে।
তাকে টাইম ম্যাগাজিন ২০২৫ সালের ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় রেখেছে। মাচাদো গত জানুয়ারিতে একবার কিছু সময়ের জন্য জনসম্মুখে এসেছিলেন।
মাদুরোর অভিষেকের আগে বিক্ষোভ চলার সময় তিনি প্রকাশ্যে আসেন। সে সময় মাচাদোকে গ্রেপ্তার করে পরে আবার ছেড়েও দেওয়া হয়।
নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া ২০তম নারী:
মাচাদো গত বছর ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ মানবাধিকার সম্মাননা শাখারভ পুরস্কার পেয়েছিলেন। আর এবার তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার পেলেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি এই পুরস্কার জয় করা ২০ তম নারী হলেন।
তিনি রাষ্ট্রমালিকানাধীন এন্টারপ্রাইজগুলো বেসরকারিকণসহ উদার অর্থনৈতিক সংস্কারের পক্ষে কথা বলে আসছেন। দেশের গরিব নাগরিকদের সহায়তা করার জন্য কল্যাণ প্রকল্প গঠনকেও তিনি সমর্থন করেন।
পুরস্কার পাওয়ার পর মাচাদোর প্রতিক্রিয়া:
মারিয়া কোরিনা মাচাদো বলেছেন, এবছর তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন শুনে অবাক হয়েছেন।
তার প্রেস টিম থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো একটি ভিডিওতে দেখা যায়, মাচাদো তার দলের এডমুন্ডো গঞ্জালেসকে বলছেন, “আমি হতবাক!”
বিস্মিত হয়ে মাচাদো বলেন, “এটা কি হল! আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।”
