ইতিহাস বলছে, বিহারে রাজনৈতিক হাওয়া যে দিকে বয়, তার প্রতিধ্বনি দিল্লিতে শোনা যায়।
সংগৃহিত
নির্বাচন নিয়ে পূর্বাভাস দেওয়া কঠিন। আর সেটা যদি হয় ভারতের বিহার রাজ্য, তাহলে আরও কঠিন। ভারতের রাজনীতিতে বিহার এমন এক রাজ্য, যেখানে নির্বাচন এলে দল, নেতা, জোট, ও ভোটের সমাজবিন্যাস এক অদ্ভুত রসায়নে মেশে। ভোটের সময় যতই ঘনিয়ে আসে, বিহারের রাজনীতি এক পরীক্ষাগারের মতো রূপ নেয়, যেখানে নতুন নতুন সমীকরণ গড়ে ও ভেঙে পড়ে। এই মুহূর্তে প্রশ্ন একটাই, ২০২৫ সালের নভেম্বরে হতে যাওয়া বিধানসভা নির্বাচনে কারা জিততে যাচ্ছে?
বিহারের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচন শুধু রাজ্য রাজনীতির জন্যই নয়, ভারতের কেন্দ্রীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। বিহার উত্তর ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্রে এক কৌশলগত রাজ্য, যার ৪০টি লোকসভা আসন দিল্লির ক্ষমতার অঙ্কে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ইতিহাস বলছে, বিহারে রাজনৈতিক হাওয়া যে দিকে বয়, তার প্রতিধ্বনি দিল্লিতে শোনা যায়।
বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার যদি আবারও এনডিএ-এর নেতৃত্বে সরকার গঠন করতে পারেন, তবে কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে বিজেপির আধিপত্য আরও দৃঢ় হবে, এবং ২০২৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে ‘অপরাজেয় গেরুয়া শিবির’-এর বয়ান শক্তিশালী হবে। বিপরীতে, আরজেডি–কংগ্রেস–বামফ্রন্টের জোট মহাগঠবন্ধন অপ্রত্যাশিতভাবে জিতে গেলে তা কেন্দ্রীয় বিরোধী শিবিরকে নতুন প্রাণ দেবে। বিশেষত ‘ইন্ডিয়া জোট’-এর পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় বিহার হতে পারে প্রতীকী পুনর্জাগরণের কেন্দ্র। আর যদি প্রশান্ত কিশোরের জন সুরাজ পার্টি (জেএসপি) উল্লেখযোগ্য ভোট কেটে নেয়, তাহলে তা ইঙ্গিত দেবে যে ভারতে নতুন বিকল্প শক্তির জন্য জনমানসে জায়গা তৈরি হচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে জাতীয় রাজনীতির ধারা পাল্টে দিতে পারে। অর্থাৎ, বিহারের নির্বাচন আসলে ভারতের কেন্দ্রীয় রাজনীতির ভবিষ্যতের এক প্রাথমিক পূর্বাভাস।
নবাব সিরাজের রাজ্য বলতে ‘বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা’ ঐতিহাসিকভাবে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিকভাবে যুক্ত। এই তিন রাজ্যের সামাজিক গঠন, ভাষার ঘনিষ্ঠতা, শ্রমবাজার ও অভিবাসনের প্রবাহ তাদেরকে পারস্পরিক নির্ভরশীল করেছে। বিহারের রাজনৈতিক পালাবদল তাই শুধু রাজ্য নয়, পূর্ব ভারতের সামগ্রিক ভারসাম্যকেও প্রভাবিত করে। বিশেষ করে শ্রম ও শিল্পের ক্ষেত্রে বিহার ও উড়িষ্যা থেকে পশ্চিমবঙ্গে বিপুল শ্রমিকের আগমন হয়, ফলে বিহারে নতুন সরকার আসলে তাদের নীতি পরিবর্তন বাংলার অর্থনীতিতেও প্রতিফলিত হয়। আবার কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে বিহারের অবস্থান দৃঢ় হলে পূর্ব ভারতের দাবিদাওয়া বিশেষত অবকাঠামো ও সংযোগ উন্নয়নের ইস্যু নতুন গুরুত্ব পাবে। ফলে বিহারের নির্বাচনের প্রভাব বাংলা ও উড়িষ্যার রাজনীতিতেও পরোক্ষভাবে অনুরণিত করে।
এবার জেনে নেয়া যাক, বিহারে নির্বাচনের মাঠে কী ঘটছে আসলে। এনডিএ বা জাতীয় গণতান্ত্রিক জোটের কাছে চিরাগ পাসোয়ানের লোক জনশক্তি পার্টির (এলজেপি) উপস্থিতি বড় প্রাপ্তি হিসেবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। গত লোকসভা নির্বাচনে এই দলই এনডিএকে অঙ্কে সুবিধা দিয়েছিল। কিন্তু প্রশান্ত কিশোরের জন সুরাজ পার্টি (জেএসপি) রাজনীতির অঙ্ক গুলিয়ে দিতে চলেছে। তাই এখনই নিশ্চিতভাবে কারও বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করা দুঃসাধ্য।
বিহারের রাজনীতি বুঝতে হলে ভোটারদের ওপর নজর দিতে হবে। প্রায় সাত কোটিরও বেশি নাম আছে রাজ্যের ভোটার তালিকায়। তবে সমালোচকরা দাবি করছেন, অন্তত ১০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের নাম বাদ পড়েছে। ভারতের সুপ্রিম কোর্টে প্রশান্ত ভূষণের আবেদনও এই প্রশ্ন তোলে। সুতরাং, ভোটার তালিকার ত্রুটি নিয়েই নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে, এটা নিশ্চিত। ভারতের মতো গণতন্ত্রে কিছু ভুল-ত্রুটি থাকবেই এবং বিহারের মতো রাজ্যে ওই ভুলের পরিমাণ সামান্য হলেও অবশ্যম্ভাবী।
ভোটদানের হার নিয়ে আরেকটি বড় প্রশ্ন রয়েছে। সাধারণত বিহারে ভোটের হার থাকে ৫৬-৫৮ শতাংশের মধ্যে। অর্থাৎ প্রায় সাড়ে চার কোটি মানুষ ভোট দেন। এবার ওই হার বাড়লে নতুন ভোটারদের উৎসাহ বোঝা যাবে এবং তারা নির্বাচনের ফলে প্রভাব ফেলতে পারে।
গত এক দশকের নির্বাচনি পরিসংখ্যান এনডিএর পক্ষেই গেছে। ২০১৪, ২০১৯ ও ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে এনডিএর ভোট শতাংশ ছিল যথাক্রমে ৩৯, ৫৪ ও ৪৭-এর ওপরে। আরজেডি–কংগ্রেস–বামফ্রন্টের মহাগঠবন্ধন সে তুলনায় ৩০ থেকে ৩৯ শতাংশের মধ্যেই আটকে আছে। তবে ২০২৪ সালে মহাগঠবন্ধনের ভোট কিছুটা বেড়েছে, যা তাদের মনোবল বাড়াচ্ছে।
২০২০ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এনডিএ এবং মহাগঠবন্ধনের মধ্যে ছিল এক শ্বাসরুদ্ধকর লড়াই। ভোটের অঙ্কে সামান্য ব্যবধানই তৈরি করেছিল সরকার গঠনের পার্থক্য। ওই নির্বাচনে চিরাগ পাসোয়ানের এলজেপি এনডিএরই ক্ষতি করেছিল, বিশেষ করে জেডিইউর আসনে প্রার্থী দিয়ে। কিন্তু তার ফলেই বিজেপি তুলনামূলক ভালো ফল করেছিল। এই শিক্ষা থেকেই ২০২৪ লোকসভায় চিরাগকে সঙ্গে নিয়েছিল এনডিএ, এবং তাতে ফলও ভালো হয়েছে তাদের। চিরাগ পাসোয়ানও তাই এবারের নির্বাচনে অন্তত ৪০টি আসন দাবি করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত দরাদরির পর ২৯ আসন পেয়েছেন।
বিহারের রাজনীতির এক অনন্য চরিত্র হলেন জেডিইউ-এর নেতা নীতীশ কুমার। তার রাজনৈতিক যাত্রাই এই রাজ্যের ভোট-গণিতের কেন্দ্রবিন্দু। কখনও এনডিএতে, কখনও বিরোধী জোটে, আবার কখনও একা লড়াই করে তিনি যেন বিহারের রাজনীতির ‘স্থায়ী মুখ’। ২০০০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত নয়বার মুখ্যমন্ত্রী হওয়া এবং ১৮ বছরের বেশি সময় এই পদে থাকা—তার রাজনৈতিক কৌশল এতটাই বহুমাত্রিক যে, আজও তাকে বিহারের সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক মুখ বলা হয়।
বিরোধী শিবিরের চিত্র একেবারে ভিন্ন। তেজস্বী যাদবকে মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী ঘোষণা করলেও মহাগঠবন্ধনের ভেতর আসনরফা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। কংগ্রেস, সিপিআইএমএল, সিপিআই, সিপিএম প্রত্যেকেই নিজেদের ওজন অনুযায়ী বেশি আসন চাইছে। এমনকি ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চাও এক ডজন আসনের দাবি তুলেছে। এই জটিলতা বিরোধীদের ঐক্যে ভাঙন ধরাতে পারে, যা এনডিএর জন্য বড় সুযোগ।
এদিকে প্রশান্ত কিশোরের জন সুরাজ পার্টি এক নতুন সমীকরণ তৈরি করে দিয়েছে। গত বছর বিহারের চারটি উপনির্বাচনে দলটি গড়ে ২২ শতাংশ ভোট পেয়েছিল একটি আসনে, যা নজরকাড়া সাফল্য। যদি এ বারও তারা ৫-১০ শতাংশ ভোট পায়, তাহলে যে কোনো আসনে জয়-পরাজয়ের অঙ্ক পাল্টে যেতে পারে। বিশেষ করে জন সুরাজ যে ভোট কেটে নিতে পারে, তা মূলত এনডিএ বিরোধী ভোট। ফলে বিজেপি পরোক্ষে উপকৃত হতে পারে।
জন সুরাজের প্রতিশ্রুতি, বিশেষ করে মদের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার প্রশ্নটি বিহারের সমাজবিন্যাসে এক নতুন বিভাজন তৈরি করেছে। এই বিষয়টিকেই রাজনৈতিক ইস্যুতে রূপ দিয়ে প্রশান্ত কিশোর রাজনীতির মাঠে এক বড় আলোড়ন তুলবেন বলেই মনে করা হচ্ছে।
সব মিলিয়ে বিহারের নির্বাচনী ময়দান এখন উত্তপ্ত। বিজেপি-জেডিইউ-এলজেপি মিলে এনডিএ-এর অঙ্ক সুসংহত হলেও স্থানীয় অসন্তোষ, বেকারত্ব এবং নীতীশ সরকারের ক্লান্ত প্রশাসনিক ভাবমূর্তি তাদের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে। অন্যদিকে, তেজস্বী যাদবের তরুণ নেতৃত্বে মহাগঠবন্ধন দেখাচ্ছে আশার আলো। কিন্তু অভ্যন্তরীণ বিরোধ ও আসনরফার জট তাদের পিছিয়ে দিতে পারে।
বিহারের রাজনীতি তাই কেবল দলবদলের অঙ্ক নয়, বরং এক সাংস্কৃতিক মনস্তত্ত্বের প্রতিফলন। এখানে জাত, ধর্ম, অঞ্চল, বেকারত্ব, নারী ভোট সব কিছুই মিশে যায় ভোটবাক্সের ভাষায়। সেই কারণেই এই রাজ্যে কোনো সমীকরণই স্থায়ী নয়।
নভেম্বরের নির্বাচনে এখনও পর্যন্ত বিজেপি নেতৃত্বে এনডিএ জোট এগিয়ে আছে বলে মনে হচ্ছে। তাদের জোট মজবুত, নেতৃত্ব স্পষ্ট, আর সংগঠন মজবুত। কিন্তু প্রশান্ত কিশোরের জন সুরজ যদি ৫ শতাংশেরও বেশি ভোট টেনে নেয়, তাহলে ফলাফল হতে পারে একেবারে অনিশ্চিত। তেজস্বী যাদব যদি তরুণ ভোটারদের মন জয় করতে পারেন, তাহলে বিহারের রাজনৈতিক ইতিহাসে আরেকবার চমক দেখা দিতে পারে।
বিহারের নির্বাচনি লড়াই এখন শুধু অঙ্কের খেলাই নয় বরং রাজনৈতিক কৌশল, সামাজিক রসায়ন আর নেতৃত্বের শক্তিমত্তার সম্মিলিত পরীক্ষা। শেষপর্যন্ত বিজয়ী কে হবেন, সেটা জানতে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত।
