“এত পরিশ্রম করে আলোচনা করল; শেষ পর্যন্ত ঐকমত্যের জায়গায় অনৈক্য সৃষ্টি করে গেল,” বলেন অধ্যাপক নিজামউদ্দিন।
সংগৃহিত
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাড়ে আট মাসের যাত্রা শেষ হলো শুক্রবার।
এই যাত্রায় রাষ্ট্র সংস্কারের একগুচ্ছ সুপারিশের বিষয়ে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে একই সুরে বাঁধার চেষ্টা করেছে কমিশন।
সেই চেষ্টায় কখনো প্রশংসা কুড়িয়েছে, কখনো শুনতে হয়েছে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ।
নানা মতাদর্শের রাজনীতিকদের সঙ্গে নিয়ে ঐকমত্য কমিশন তাদের এ বন্ধুর যাত্রার ইতি টানে জাতীয় জুলাই সনদ বাস্তবায়নের একগুচ্ছ সুপারিশের মধ্য দিয়ে।
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে তুলে দেওয়া ঐকমত্য কমিশনের কিছু সুপারিশ জাতির মধ্যে সম্প্রীতির স্বপ্ন যেমন জাগিয়েছে, তেমনি বিভাজনের ভয়ও ধরিয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
মুহাম্মদ ইউনুসকে সভাপতি করে এ কমিশনের যাত্রা শুরু হয় গত ১২ ফেব্রুয়ারি; আর মেয়াদ শেষ হয় ৩১ অক্টোবর।
মেয়াদ শেষের দিনে শুক্রবার দুপুরে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আজ আনুষ্ঠানিকভাবে ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ শেষ হলো। আর মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে না।”
পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকরা কমিশনের ‘অনেক ভালো অর্জনের’ পরও দলগুলোয় শেষ পর্যন্ত অনৈক্য থাকায় ‘হতাশা’ প্রকাশ করেছেন।
বিরাজমান রাজনৈতিক বিতর্ক ও বিপরীতমুখী অবস্থান থাকলে সরকারের চ্যালেঞ্জ ও সঙ্কটের কথাও বলেছেন বিশ্লেষকদের কেউ কেউ।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ‘অম্ল-মধুর’ যাত্রাকে ‘ঐতিহাসিক মাইলফলক’ হিসেবে দেখতে চান এ কমিশনেরই সদস্য ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠক। ফাইল ছবি।
কী রেখে গেল ঐকমত্য কমিশন
সংসদ বিষয়ক গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক নিজামউদ্দিন আহমদ বলেন, “ঐকমত্য কমিশন এত পরিশ্রম করে সবাইকে নিয়ে আলোচনা করলো, নিজেরা কষ্ট করল; শেষ পর্যন্ত ঐকমত্যের জায়গায় অনৈক্য সৃষ্টি করে গেল। অরাজনৈতিক মানুষের বড় ধরনের দুর্বলতা।”
রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা ভিন্নমতসহ জুলাই জাতীয় সনদে সই নেওয়ার পর তা চূড়ান্ত সুপারিশে তা না রাখায় সমালোচনা করেন তিনি।
নিজামউদ্দিন আহমদ বলেন, “ঐকমত্য কমিশন কাজটা করেছে, ভালো। এত সময় দরকার ছিল না। ঐকমত্য কমিশন সুপারিশ করতে পারে, তাদের সিদ্ধান্ত সরকার মানতে বাধ্য নয়। এখন সরকারের ওপর বড় চাপ বাড়বে। সরকার এখন কী সিদ্ধান্ত নেয়, তার উপর নির্ভর করবে। সরকারকে খুব সতর্কতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
ইতোমধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন হয়ে গেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “পরিষ্কার বিভাজন হয়ে গেছে। গণভোট নিয়ে বিভাজনে হয়েছে।
“এটা তো কারো ওপর চাপাচ্ছেন। বড় রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর চাপিয়ে দিতে পারবেন না। এটাই হচ্ছে অরাজনৈতিক মানুষের বড় ধরনের দুর্বলতা। দলগুলোর অনৈক্যের কারণে সামনে সংকট বাড়বে এবং এখন সরকারের পক্ষ থেকে মিনিমাইজ করে এগোতে হবে।”
সাবেক সচিব একেএম আব্দুল আউয়াল মজুমদার মনে করেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বছরব্যাপী উদ্যোগের কাজগুলো ভালো হলেও দলগুলোয় ঐকমত্য না হওয়ার ব্যর্থতা রয়েছে কিছুটা।
“এটা (দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য) হয় নাই। তো এটা কিছুটা ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু যারা ক্ষমতায় যাবেন, তারা যেগুলা স্বীকার করেছেন, সেগুলা হয়তো বাস্তবায়ন হতে পারে; সেটাও মন্দ না; কিছু তো হলো। ঐকমত্য কমিশন তো একটা ভালো কাজ করে দিয়ে গেল। নো ডাউট। তারা কষ্ট করেছে ভালো কাজ করেছে; তারা রাস্তা দেখাইছে। এখন সেটার প্রকৃত অর্জন হবে রাজনৈতিক দলগুলো বা রাজনৈতিক সরকার যদি সেটা বাস্তবায়নের সদিচ্ছা দেখায় বা করে।”
ঐকমত্য কমিশনকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ও বিশ্লেষক আব্দুল আলীম বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে ঐকমত্যের চেষ্টা করেছে, সুপারিশসহ প্রতিবেদন দিয়েছে। এখন বাস্তবায়নের পালা এবং তাতে চ্যালেঞ্জ থাকবেই।
“একটা বড় বিষয় হচ্ছে, আগেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে আসার চেষ্টা করেছে । এবার ব্যাপকভিত্তিক সংস্কারের পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাস্তবায়ন যতটাই হোক না কেন, তবুও রূপরেখা আছে, এটা একটা ইতিবাচক দিক।”
অনেক বিষয়ে ঐকমত্য থাকার পরও ‘বড় বড় বিষয়ে মত পার্থক্যটা বোধয় না থাকলে ভালো হত’ বলেন মন্তব্য করেন তিনি।
“মতভিন্নতা থাকবে। কিন্তু কিছু বড় বড় কিছু ইস্যুতে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো এখন বিভাজিত। এই জিনিসটা আসলে আমার ধারণার বাইরে ছিল। আমরা আসলে বিভাজন দেখতে চাই না; কোনো বিভাজন থাকা আমার মতে উচিত না।”
মত ভিন্নতার কারণে বাস্তবায়ন নিয়ে সরকারের চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরে আব্দুল আলীম বলেন, “এটা চাপ নয়; এটা হয়তো একটা চ্যালেঞ্জ। আর এ ধরনের কাজের মধ্যে চ্যালেঞ্জ থাকবেই।”
সাড়ে আট মাসের যাত্র্রা
প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে মধ্য ফেব্রুয়ারিতে কাজ শুরু করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজকে সহ-সভাপতি এবং নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন প্রধান বদিউল আলম মজুমদার, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন প্রধান ইফতেখারুজ্জামান, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন সদস্য মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া ও পুলিশ সংস্কার কমিশন প্রধান সফর রাজ হোসেন ছিলেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য।
কমিশনের এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য) মনির হায়দারও।
প্রথম ধাপে ছয় মাস মেয়াদের জন্য গঠন করা হলেও দুই দফা মেয়াদ বাড়িয়ে ৩১ অক্টোবর করা হয়।
এরইমধ্যে একগুচ্ছ বিষয়ে ঐকমত্য পৌঁছে দলগুলোকে নিয়ে ১৭ অক্টোবর সই হয় ‘জুলাই জাতীয় সনদ, ২০২৫’।
ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে অংশ নেওয়া ২৫টি রাজনৈতিক দলের নেতাদের পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরা এই রাজনৈতিক সমঝোতার দলিলে সই করেন।
আর সবশেষ মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) জুলাই জাতীয় সনদের বাস্তবায়ন কীভাবে হবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত সুপারিশমালা প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করে জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন।
সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন এবং ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন বা আগে জুলাই সনদ নিয়ে গণভোট আয়োজনের সুপারিশ করে এ কমিশন।
রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যেগে এক বছর এক মাস পার
ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনে ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা। এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। ৮ অগাস্ট মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ গঠন হয়।
রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে সংস্কারের লক্ষ্যে ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ছয়টি কমিশন গঠন ও কমিশন প্রধানের নাম ঘোষণা করেন।
এতে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান করা হয় জ্যেষ্ঠ আইনজীবি শাহদীন মালিক; আর এক সপ্তাহ পর এ দায়িত্ব দেওয়া হয় ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক আলী রীয়াজকে।
একই বছরের ১৭ অক্টোবর স্বাস্থ্য, গণমাধ্যমসহ আরও সংস্কার কমিশন গঠনে সরকারের সিদ্ধান্তের কথা জানান এক উপদেষ্টা।
প্রথম ধাপের ছয় কমিশন
অন্তর্বর্তী সরকার দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণে বিভিন্ন উদ্যোগের মধ্যে অক্টোবরে প্রথম ধাপে রাষ্ট্রের ছয়টি খাত সংস্কারে কমিশন গঠন করে।
২০২৪ সালের ৩ অক্টোবর নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুদক ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। দুই দিন বাদে ৬ অক্টোবর গঠন করা হয় সংবিধান সংস্কার কমিশন।
কমিশন গঠনের দিন থেকে ৯০ দিনের মধ্যে তাদেরকে সরকার প্রধানের কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। এরপর তাদের মেয়াদও বাড়ানো হয়।
সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ সংস্কার ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রাথমিক প্রতিবেদন এ বছরের ১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার কাছে দেওয়া হয়। আর জনপ্রশাসন ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করা হয় ৫ ফেব্রুয়ারি।
আর ৮ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্র সংস্কারে গঠিত প্রথম ধাপের ছয় কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
এ ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রধানদের নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে গঠন করা হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
আরও পাঁচ সংস্কার কমিশন
প্রথম ধাপে ছয় সংস্কার কমিশনের কাজ চলার মধ্যে ২০২৪ সালের ১৮ নভেম্বর রাষ্ট্র সংস্কার এগিয়ে নিতে নতুন পাঁচ কমিশনের নাম ঘোষণা করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ খান স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান সাংবাদিক কামাল আহমেদ, শ্রম অধিকারবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ, নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভীন হক এবং স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের নেতৃত্ব দেন অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ।
৯০ দিনের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন দেওয়ার কথা থাকলেও মেয়াদ বাড়ানো হয়।
দ্বিতীয় ধাপে গঠিত কমিশনগুলোর মধ্যে ‘স্থানীয় সরকার সংস্কার’ কমিশনের প্রাথমিক সুপারিশের প্রতিবেদন জমা পড়ে ২২ ফেব্রুয়ারি। এরপর ২২ মার্চ জমা পড়ে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন।
এরপর ১৯ এপ্রিল নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন, ২১ এপ্রিল শ্রম অধিকার বিষয়ক প্রতিবেদ এবং ৫ মে স্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা পড়ে প্রধান উপদেষ্টার হাতে।
এর মধ্যে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে নানা মহলে সমালোচনাও হয়। নারী সংস্কার কমিশন বাতিলের দাবিও তোলে কয়েকটি সংগঠন। এর পরিপ্রক্ষিতে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের মেয়াদ ফের ৩১ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় দ্বিতীয় ধাপের পাঁচ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের সুপারিশ আমলে না নেওয়ায় আক্ষেপও ছিল তাদের। এসব কমিশনে সুপারিশ জাতীয় সনদে অন্তর্ভুক্ত করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি আহ্বান জানিয়ে চিঠিও দিয়েছিলেন কমিশনগুলোর প্রধানরা।
বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ও গণভোট দ্রুত সিদ্ধান্ত আসছে
ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তরের পর গত বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক হয়েছে।
বৈঠক শেষে ঢাকায় ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে এক ব্রিফিংয়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া কিংবা গণভোট নিয়ে ‘খুব দ্রুত’ সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন প্রশ্নে দলগুলোর মধ্যে মোটা দাগে দুই ধরনের বিরোধ তৈরি হয়েছে। প্রথমত, সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া; দ্বিতীয়ত হলো, গণভোটের দিনক্ষণ।
বিএনপিসহ কয়েকটি দল চায়, জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে হোক। আর জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পূর্ণ ভার থাকুক নির্বাচিত সংসদের ওপর।
অন্যদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দল দাবি তুলেছে, নভেম্বরেই গণভোট আয়োজন করতে হবে। আর জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আদেশ আসতে হবে প্রধান উপদেষ্টার হাত ধরে।
সনদ নিয়ে দলগুলোর এমন অনৈক্যের বিষয়ে আসিফ নজরুল বলেন, “গণভোট নিয়ে বিরোধ তো তীব্রতম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এসব বিষয়ে আমাদের একটা সময় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধান উপদেষ্টা। আমরা তাকে সহায়তা করার জন্য থাকব। আমাদের সঙ্গে পরামর্শের প্রয়োজন হলে তিনি করবেন এবং আমরা যে সিদ্ধান্ত নেব, সেখানে আমরা দৃঢ় থাকব। আর সিদ্ধান্ত খুব দ্রুত নেওয়া হবে।”
‘অপূর্ব সুযোগ ছিল’
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার শুক্রবার দীর্ঘ এ যাত্রার অভিজ্ঞতাকে অসাধারণ বলে মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, “আমাদের কাজ শেষ। এটা একটা ঐতিহাসিক মাইলফক। একই সঙ্গে আমি আনন্দিত ও ব্যথিত। এটা একটা অপূর্ব সুযোগ ছিল। এটা অসাধারণ একটা অভিজ্ঞতা এবং কয়জনের ভাগ্যে জোটে।”
দেশের স্বৈরাচারী ব্যবস্থার অবসান ঘটানোর ব্যাপারে একটা ভূমিকা রাখতে পেরেছেন মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আনুষ্ঠানিভাকে আমাদের কাজ শেষ। এ জন্য আমি আনন্দিত। আর অহেতুক ও অনাকাঙ্খিত রাজনৈতিক বিতর্কে ব্যথিত। আটটা খণ্ডে প্রায় ৩৭০০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন ও সুপারিশ দেওয়া হয়েছে।”
ঐকমত্য কমিশনের চূড়ান্ত সুপারিশের পর শেষ মুহুর্তে রাজনৈতিক বিতর্ক তোলা ঠিক নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি বলেন, “একটা ভুল বোঝাবুঝি। রাজনৈতিক বিতর্কটা অনাকাঙ্খিত, দুর্ভাগ্যজনক। দলগুলোর পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্কের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হয়েছে এবং কিছু দল এটার সঙ্গে দ্বিমত হয়েছে এবং নোট করা হয়েছে। নোট অব ডিসেন্টগুলো রেকর্ডের জন্য থাকবে এবং এগুলো জুলাই সনদে প্রপারলি রেকর্ডেড হয়েছে।“
দলগুলোর মূল্যায়ন কী
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কিছু সুপারিশ নিয়ে আপত্তি তুলেছে বিএনপি। কমিশনের বিরুদ্ধে ‘সংকট’ সৃষ্টির অভিযোগও তুলেছে দলটি।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কমিশনের কিছু সুপারিশকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি দেওয়ার জন্য জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন তাদের সুপারিশ সরকারের কাছে পেশ করেছে। সেখানে যেসব বিষয়ে ভিন্নমত বা নোট ডিসেন্টসহ ঐকমত্য হয়েছে, তার উল্লেখ না রেখে দীর্ঘ আলোচনায় যেসব প্রসঙ্গ আলোচনা আসেনি, তা অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের অন্য সকল সুপারিশ অগ্রহণযোগ্য বিধায় আমরা একমত হতে পারছি না।”
অন্যদিকে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, “আমরা আলোচনার সুবিধার্থে, আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য ‘ত্যাগ স্বীকার’ করেছি। নাম পরিবর্তন তারা চাইছে, আমরা মেনে নিয়েছি বিএনপিকে সুযোগ দেওয়ার জন্য। আমরা বেশি বললে, ওনারা আবার উঠে চলে যেতে চায়। তাদের যেহেতু দরকার, তাই আমরা ত্যাগ স্বীকার করেছি।”
জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেনি জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি।
এনসিপি নেতারা বলে আসছে, প্রধান উপদেষ্টার স্বাক্ষরে আদেশ জারি করতে হবে।
শুক্রবারও পিরোজপুরে এক অনুষ্ঠানে এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ দাবি করেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোটের পক্ষে সরাসরি আদেশ জারি করতে হবে।
তিনি বলেন, “গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য অবশ্যই নির্বাচন হতে হবে। তবে এর আগে গণভোটের পক্ষে সরাসরি আদেশ জারি করতে হবে এবং সেটা আওয়ামী লীগের মনোনীত রাষ্ট্রপতি নয়, বরং প্রধান উপদেষ্টাকে এ আদেশ জারি করতে হবে।”
