অনেক ইউটিউবার এখন শুধু কনটেন্ট ক্রিয়েটর নন, হয়ে উঠছেন মিডিয়া কোম্পানি যাদের নিজস্ব পণ্য, দোকানভিত্তিক ব্যবসা এবং ব্র্যান্ড রয়েছে।
হতে সংগৃহিত
ইউটিউব এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্মগুলোর একটি যা ক্রিয়েটরদের জীবিকা অর্জনের অসংখ্য সুযোগ দিচ্ছে। গত জুনে কোম্পানিটির ক্রিয়েটিভ ইকোসিস্টেম যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপিতে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি ডলার যোগ করেছে এবং চার লাখ ৯০ হাজারেরও বেশি চাকরির সৃষ্টি করেছে বলে ঘোষণা করেছিল।
তবে অনেক ইউটিউবার এখন বিজ্ঞাপন থেকে আয় ও ব্র্যান্ড ডিলের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে দিচ্ছেন। এর পেছনের কয়েকটি কারণের মধ্যে প্রথমত, বিজ্ঞাপন থেকে আয় অনিশ্চিত। ইউটিউব নিয়মিত তার নীতিমালা পরিবর্তন করে ফলে কিছু ক্রিয়েটর তাদের ভিডিওর জন্য বিজ্ঞাপন নিশ্চিত করতে হিমশিম খান যা তাদের আয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তারা এটাও বুঝেছেন যে এই আয়ের উৎস যে কোনো সময় হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে।
এই অনিশ্চয়তা বুঝতে পেরে অনেক ইউটিউবার এখন শুধু কনটেন্ট ক্রিয়েটর নন তারা হয়ে উঠছেন সম্পূর্ণ মিডিয়া কোম্পানি, যাদের নিজস্ব পণ্য, দোকানভিত্তিক ব্যবসা এবং ভোক্তামুখী ব্র্যান্ড রয়েছে। এটি ইউটিউবের অ্যালগরিদম বা নীতিমালা পরিবর্তনের পরেও টিকে থাকতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে, এই সহায়ক আয়ের উৎসগুলো তাদের ইউটিউব চ্যানেলের চেয়ে দ্রুত ও স্থায়ীভাবে বাড়ছে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে প্রযুক্তি সাইট টেকক্রাঞ্চ।
মিস্টারবিস্ট
জিমি ডোনাল্ডসন যিনি মিস্টারবিস্ট নামে পরিচিত, তিনি ৪৪ কোটি ২০ লাখ সাবস্ক্রাইবার নিয়ে ইউটিউবের সবচেয়ে বড় তারকাদের একজন এবং একইসঙ্গে সবচেয়ে আগ্রাসী উদ্যোক্তাদের একজন।
২০১৮ সালে একটি মার্চেন্ডাইজ স্টোর ‘শপমিস্টারবিস্ট’ দিয়ে যাত্রা শুরু করলেও এখন তার ব্যবসায়িক পোর্টফোলিওতে যুক্ত হয়েছে আরও বহু উদ্যোগ। এর মধ্যে গত তিন বছর ধরে চলছে তার স্ন্যাক ব্র্যান্ড ‘ফিস্টেবলস’।
ফিস্টেবলসের প্রথম পণ্য ছিল ‘মিস্টারবিস্ট বার’। এটি একটি চকোলেট বার যা লঞ্চের প্রথম ৭২ ঘণ্টায়ই ১০ লাখের বেশি বিক্রি ও এক কোটি ডলারের বেশি আয় করেছিল। বর্তমানে ফিস্টেবলস তার ইউটিউব কনটেন্ট এবং এমনকি প্রাইম ভিডিওতে প্রচারিত তার ‘বিস্ট গেইমস’ প্রতিযোগিতা সিরিজের চেয়েও বেশি লাভজনক। ২০২৪ সালে ফিস্টেবলস প্রায় ২৫ কোটি ডলার রাজস্ব এবং দুই কোটি ডলার মুনাফা করেছে। অন্যদিকে তার মিডিয়া ব্যবসায় প্রায় আট কোটি ডলার লোকসান হয়েছে।
তার অন্যান্য ব্যবসার মধ্যে রয়েছে ইউটিউবার লোগান পল এবং কেএসআই-এর সঙ্গে গড়া প্যাকেটজাত খাদ্য ব্র্যান্ড ‘লাঞ্চলি’, খেলনা লাইন ‘মিস্টারবিস্ট ল্যাব’, ‘মিস্টারবিস্ট বার্গার’ এবং ডেটা অ্যানালিটিক্স প্ল্যাটফর্ম ‘ভিউস্ট্যাটস’। এমনকি তিনি ‘অ্যামেরিকান ইনভেস্টর কনসোর্টিয়াম’-এর অংশ হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে টিকটকের কার্যক্রম কেনার চেষ্টাও করেছিলেন। এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এমপ্লয়ার ডট কমের প্রতিষ্ঠাতা জেসি টিন্সলে।
এখন মিস্টারবিস্ট আরও নতুন খাতে প্রবেশের পরিকল্পনা করছেন। তিনি একটি মোবাইল ভার্চুয়াল নেটওয়ার্ক অপারেটর প্রতিষ্ঠা করতে চান যা এটিএন্ড টি, টি-মোবাইল বা ভেরাইজন-এর মতো বড় অপারেটরের সঙ্গে অংশীদারিত্বে চালু হতে পারে।
এ ছাড়াও, তিনি সম্প্রতি একটি মোবাইল অ্যাপের ট্রেডমার্কের জন্য আবেদন করেছেন যা ব্যাংকিং, আর্থিক পরামর্শ এবং ক্রিপ্টো এক্সচেঞ্জ সেবা দেবে।
এমা চেম্বারলিন
২০১৬ সালে টিন ভ্লগার হিসেবে জনপ্রিয়তা পাওয়া এমা চেম্বারলিন এখন ইউটিউবে এক কোটি ২০ লাখেরও বেশি সাবস্ক্রাইবারের মালিক এবং পানীয় শিল্পে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
তিনি ২০১৯ সালে নিজের কফি ব্র্যান্ড ‘চেম্বারলিন কফি’ চালু করেন, যেখানে কোল্ড ব্রু, কফি পড, গ্রাউন্ড ও হোল বিন কফি, চা এবং মাচাসহ নানা ধরনের পণ্য পাওয়া যায়। তার এই উদ্যোগের পর আরও ইউটিউবার একই পথে আসেন যেমন জ্যাকসেপ্টিকআই তার ‘টপ অফ দ্য মর্নিন কফি’ এবং ‘ফিলিপ ডিফ্রাঙ্কো তার ‘ওয়েইক অ্যান্ড মেইক কফি’ ব্র্যান্ড চালু করেন।
২০২৩ সাল চেম্বারলিন কফির জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ বছর ছিল। এ সময়ে তারা বাজারে আনে রেডি-টু-ড্রিংক ক্যান লাত্তে, যা ফোর্বসের প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রায় দুই কোটি ডলার আয়ের সুযোগ তৈরি করে। এরপর এই ব্র্যান্ডের সাফল্য আরও বড় মাত্রায় পৌঁছায়, যখন জানুয়ারিতে তারা তাদের প্রথম অফলাইন স্টোর খুলল। এর আগে চেম্বারলিন কফির পণ্য পাওয়া যেত কেবল অনলাইন ও টার্গেট, স্প্রাউটস, ওয়ালমার্টের মতো রিটেইল স্টোরগুলোতে।
যদিও বিজনেস ইনসাইডারের তথ্য অনুযায়ী গত বছর চেম্বারলিন কফি সরবরাহ সমস্যার কারণে কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে এর রাজস্ব ৫০ শতাংশেরও বেশি বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে যা তিন কোটি ৩০ লাখ ডলারের বেশি হবে।
লোগান পল
লোগান পল, যার ইউটিউব চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা দুই কোটি ৩৬ লাখেরও বেশি, এখন মূলত পরিচিত তার রেসলিং ক্যারিয়ারের জন্য। তবে তার যাত্রার শুরুটা ছিল নানা বিতর্কে ঘেরা। বিশেষ করে ২০১৭ সালের এক কুখ্যাত ভিডিও এবং পরবর্তীতে কথিত প্রতারণামূলক এনএফটি প্রকল্প ‘ক্রিপ্টোজু’ তাকে দীর্ঘদিন সমালোচনার মুখে রেখেছিল।
তিনি ২০২২ সালে ইউটিউবার কেএসআইয়ের সঙ্গে মিলে চালু করেন এনার্জি ড্রিংক ব্র্যান্ড ‘প্রাইম’ যা অল্প সময়েই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ২০২৩ সালে ব্র্যান্ডটির বিক্রি এক কোটি ২০ লাখ ডলার ছাড়ায় যা বেশিরভাগ কনটেন্ট ক্রিয়েটরের ইউটিউব ভিউ, বিজ্ঞাপন বা ব্র্যান্ড ডিল থেকে পাওয়া আয়ের বহু গুণ বেশি।
তবে পরবর্তীতে ‘প্রাইম’ বিক্রির পতন, উচ্চ ক্যাফেইন কনটেন্ট নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজরদারি এবং ব্যবসায়িক পার্টনারদের মামলার মুখে পড়ে। যুক্তরাজ্যে ২০২৩ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বিক্রি প্রায় ৭০ শতাংশ কমে যায়।
তার আরেকটি উদ্যোগ ম্যাভেরিক অ্যাপারেল ২০২০ সালে তিন থেকে চার কোটি ডলারের মধ্যে আয় করেছিল।
অন্যদিকে, তার ভাই জেক পলও একাধিক ব্যবসায় জড়িত। এর মধ্যে রয়েছে ‘অ্যান্টি ফান্ড’ নামের বিনিয়োগ তহবিল। এটি ওপেনএআই, অ্যান্ডুরিল, র্যাম্প ও কগনিশনের মতো কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছে। জেকের আরও দুটি ব্যবসা রয়েছে- পুরুষদের গ্রুমিং লাইন ডব্লিউ এবং মোবাইল বেটিং প্ল্যাটফর্ম ‘বেটর’।
রায়ান’স ওয়ার্ল্ড
মাত্র ১৩ বছর বয়সেই রায়ান কাজি ইউটিউবের অন্যতম জনপ্রিয় মুখ। তার ইউটিউব চ্যানেল রায়ান’স ওয়ার্ল্ড প্রায় চার কোটি তরুণ দর্শককে মুগ্ধ করেছে খেলনা রিভিউ এবং আনবক্সিং ভিডিওর মাধ্যমে।
তবে রায়ানের সাফল্য শুধু ইউটিউবেই সীমাবদ্ধ নয়। তিনি নিজের নামেই খেলনা ও পোশাকের একটি ব্র্যান্ড তৈরি করেছেন যা বিশ্বের নামকরা রিটেইল চেইনগুলোতে বিক্রি হয়। ২০২০ সালে এই ব্যবসা থেকে আয় হয়েছিল প্রায় ২৫ কোটি ডলার। রায়ান এবং তার পরিবার শিশুদের জন্য শিক্ষামূলক কনটেন্টভিত্তিক একটি টিভি শো ও একটি অ্যাপ চালু করে এরপর তাদের ব্র্যান্ডকে আরও বৈচিত্র্যময় করে তুলেছেন।
রোসানা প্যানসিনো
ইউটিউবে এক কোটি ৪৮ লাখ সাবস্ক্রাইবারসহ জনপ্রিয় বেকার রোসানা প্যানসিনো মূলত তার বেকিং টিউটোরিয়াল ও থিমভিত্তিক খাবারের জন্য পরিচিত। তার রেসিপিগুলো পপ কালচার, গেইমিং ও সিনেমা থেকে অনুপ্রাণিত যা তাকে তরুণ প্রজন্মের কাছে এক আলাদা পরিচিতি দিয়েছে।
ইউটিউব কনটেন্ট ছাড়াও প্যানসিনো বেশ কয়েকটি কুকবুক প্রকাশ করেছেন যা বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে এবং তার ‘নার্ডি নামিস’ ব্র্যান্ডকে আরও বিস্তৃত করেছে। তিনি অ্যামাজনসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে নিজের বেকিং টুলও বিক্রি করেন।
অন্যান্য ইউটিউবারও অতিরিক্ত আয়ের উৎস হিসেবে রান্নার সরঞ্জাম ও খাদ্যপণ্য বাজারে এনেছেন। যেমন বিখ্যাত ইউটিউব কুক ও লেখক ‘অ্যান্ড্রু রিয়া’ ২০২১ সালে তার ‘ব্যাবিশ কুকওয়্যার’ ব্র্যান্ড চালু করেন আর কমেডি জুটি ‘রেট অ্যান্ড লিংক’ চালু করেছেন তাদের সিরিয়াল ব্র্যান্ড ‘মিশম্যাশ সিরিয়াল’।
মিশেল ফ্যান
২০০৭ সালে মেইকআপ টিউটোরিয়ালের মাধ্যমে জনপ্রিয়তা পাওয়া মিশেল ফ্যান ছিলেন ইউটিউবের প্রথম দিককার বিউটি ইনফ্লুয়েন্সারদের একজন যিনি সফলভাবে তার কনটেন্টকে ব্যবসায় রূপ দিতে সক্ষম হয়েছেন।
তিনি বিউটি সাবস্ক্রিপশন সার্ভিস ‘আইপসি’র উদ্যোক্তাদের একজন, যেটি এখন বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় ব্র্যান্ড। পাশাপাশি তার নিজস্ব মেইকআপ লাইন ‘ইএম কসমেটিকস’-ও বেশ পরিচিতি পেয়েছে।
হুডা কাটান
২০১৩ সালে হুডা কাটান প্রতিষ্ঠা করেন বিশ্বখ্যাত বিউটি ব্র্যান্ড ‘হুডা বিউটি’। ২০১৭ সালে তিনি কোম্পানির কিছু শেয়ার বিক্রি করেন ‘টিএসজি কনজিউমার পার্টনার্স’-এর কাছে তবে ২০২৪ সালের জুনে তিনি আবার সেই শেয়ার নিজের হাতে ফিরিয়ে নেন কারণ, বিনিয়োগকারীরা কোম্পানিতে নতুন নেতৃত্ব আনার চাপ দিচ্ছিলেন যা তার দ্রুত বাড়ন্ত এ ব্র্যান্ডের ভিশনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল।
প্রতিবছর শত শত কোটি ডলারের বিক্রি করা হুডা বিউটি এখন বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী কসমেটিক ব্র্যান্ডগুলোর একটি।
অনেক ইউটিউব ইনফ্লুয়েন্সারই নিজেদের মেইকআপ ব্র্যান্ড চালু করেছেন যেমন ‘জেফ্রি স্টার কসমেটিকস’ এবং ‘টাটি বিউটি’। এগুলো সৌন্দর্য শিল্পে নতুন মানদণ্ড তৈরি করেছে।
