“অতীতে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের করা প্রতিশ্রুতি নিজেরাই ভঙ্গ করেছে,” বলছে দলটি।
সংগৃহিত
আগের দিন মধ্যরাতে জুলাই জাতীয় সনদে সই না করার কথা জানানো জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) পরের দিন রাতে এর কারণ ব্যাখ্যা দিয়েছে।
শুক্রবার রাতে ফেইসবুকে দলটির ‘নীতি ও গবেষণা শাখা’ এ বিষয়ে বলেছে, “এনসিপি বলেছে, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের টেক্সট বা খসড়া এবং বাস্তবায়ন পদ্ধতির পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা দেখার পর সনদে সই করবে। কারণ, এনসিপি জুলাই সনদকে স্রেফ রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল কিংবা ফাঁকা প্রতিশ্রুতি মনে করে না।
“এনসিপি মনে করে জুলাই সনদের প্রধানতম কাজ হচ্ছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বৈরতান্ত্রিক ভিত্তি নির্মূল এবং গণতান্ত্রিক রূপান্তর। এ কারণে এই সনদের সুস্পষ্ট আইনি ও সাংবিধানিক ভিত্তি থাকতে হবে বলে এনসিপি মনে করে।”
এনসিপির সই না করার অবস্থান জানার পর সরকারের তরফে দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ শীর্ষ নেতাদের শুক্রবার অনুষ্ঠানে হাজির করাতে বৃহস্পতিবার দিনভর নানা তৎপরতা চলে। শেষ মুহূর্তে সনদে স্বাক্ষরের তারিখ ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
সনদে সই না করার বিষয়ে দলটির নেতারা বলছেন, ঐকমত্য কমিশনের আলোচনার সিদ্ধান্তের আলোকে সরকার সনদ বাস্তবায়নের খসড়া প্রকাশ করলে তা দেখেই দলটি স্বাক্ষর করবে।
এ বিষয়ে রাতে দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য যে প্রক্রিয়ার সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছিল সরকার এখনো তার খসড়া প্রকাশ করেনি। এনসিপির দাবি ছিল বাস্তবায়ন আদেশসহ জুলাই সনদে স্বাক্ষর করতে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সরকার সেই পথে হাঁটেনি। যে কারণে তারা সই করেননি।
“সরকার কোন প্রক্রিয়ায় জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করবে তা দেখে আমরা স্বাক্ষর করবো।”
শুক্রবার বৃষ্টিস্নাত বিকালে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাক্ষরের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়।
কমিশনের আলোচনায় অংশ নেওয়া দলগুলোর মধ্যে বিএনপি, জামায়াত, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদসহ ২৪টি দল এতে সই করে। তবে জুলাই অভ্যুত্থানের নেতাদের নিয়ে গঠিত নতুন দল এনসিপিসহ আটটি দল ঘোষণা দিয়ে অনুষ্ঠান বর্জন করে।
এ নিয়ে দিনভর আলোচনা ও প্রতিক্রিয়ার মধ্যে রাত পৌনে ১১টার দিকে এনসিপির ফেইসবুক পেইজে একটি পোস্ট দেওয়া হয়, যেটির শিরোনাম ছিল ‘এনসিপি কেন জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেনি?’
দলটির ‘নীতি ও গবেষণা শাখার’ দেওয়া ওই পোস্টে বলা হয়, “রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘ এক বছর ঐকমত্য কমিশনের সাথে কাজ করে জুলাই সনদ এবং বাস্তবায়ন পদ্ধতি প্রশ্নে একমত হয়েছে। জুলাই সনদ আদেশ>গণভোট> সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তনে সক্ষম গাঠনিক ক্ষমতা সম্পন্ন আগামী সংসদ (দ্বৈত ভূমিকা)–এই প্রক্রিয়ায় সনদ বাস্তবায়ন হবে এ ব্যাপারে সকল রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে। অথচ সনদের অঙ্গীকারনামায় বাস্তবায়ন পদ্ধতির উল্লেখ নাই।
“এনসিপি মনে করে বাস্তবায়ন পদ্ধতির উল্লেখ ছাড়া সনদে স্বাক্ষর করা জনগণের সাথে প্রতারণার শামিল। কারণ, অতীতে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের করা প্রতিশ্রুতি নিজেরাই ভঙ্গ করেছে।”
এছাড়াও ওই ব্যাখ্যায় আরও তিনটি বিষয় দলটি তুলে ধরেছে। এগুলো ‘জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট’ হিসেবে মন্তব্য করে বলা হয়েছে-
১. জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের খসড়া (টেক্সট) এবং গণভোটের প্রশ্নটি চূড়ান্ত করে আগেই জনগণের কাছে প্রকাশ করতে হবে।
২. জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের খসড়া জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায়ের বহিঃপ্রকাশ হিসাবে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জারি করবেন।
৩. গণভোটের মাধ্যমে জনগণ যদি জুলাই সনদে রায় দেয়, তবে নোট অব ডিসেন্টের কোনো কার্যকরিতা থাকবে না। গণভোটের রায় অনুযায়ী আগামী নির্বাচিত সংসদ তাদের উপর প্রদত্ত কনস্টিটিউয়েন্ট পাওয়ার (গাঠনিক ক্ষমতা) বলে সংবিধান সংস্কার করবে। সংস্কার করা সংবিধানের নাম হবে: বাংলাদেশ সংবিধান, ২০২৬।
দলটি ফেইসবুক পোস্টে বলেছে, “এসব বিষয়ের নিশ্চয়তা ছাড়া সনদের সাংবিধানিক ভিত্তি নিশ্চিত হবে বলে এনসিপি মনে করে না। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশে উল্লিখিত বিষয়সমূহের স্পষ্ট উল্লেখ নিশ্চিত করেই এনসিপি সনদে স্বাক্ষর করবে।
“অন্য কোনো কোনো দল বাহাত্তরের মুজিববাদী সংবিধানের মূলনীতি টিকিয়ে রাখার স্বার্থে সনদে সই করেনি। তাদের সাথে এনসিপির সই না করার মৌলিক পার্থক্য সহজেই চিহ্নিত করা সম্ভব।”
এ বিষয়ে দলের আরেক জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্ত শারমিন বলেন, “সরকার জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ প্রকাশ না করা পর্যন্ত আমরা এই বিষয়ে আমাদের নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাব। আমাদের নিয়মিত কর্মসূচিগুলোতে বিষয়টি নিয়ে আমরা আলোচনা করব। প্রয়োজন পড়লে এ বিষয়ে আমরা মাঠের কর্মসূচিও দেব।”
দলের আরেক নেতা সারোয়ার তুষার ফেইসবুকে এ বিষয়ক ব্যাখা তুলে ধরে লেখেন, “এনসিপি একটা সহজ ও স্পষ্ট দাবি জানিয়েছিল। জুলাই সনদের অঙ্গীকারনামায় বাস্তবায়ন পদ্ধতির উল্লেখ থাকতে হবে। অর্থাৎ, কীভাবে আপনি জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করবেন, কীভাবে আইনি ও সাংবিধানিক ভিত্তি নিশ্চিত করা হবে– এর উল্লেখ সনদে থাকতে হবে।
“জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে এ ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ> গণভোট> আগামী সংসদের দ্বৈত ক্ষমতা [কনস্টিটিউয়েন্ট পাওয়ার (গাঠনিক ক্ষমতা) + আইন প্রণয়নী ক্ষমতা] — এই প্রক্রিয়ায় সনদ বাস্তবায়ন হবে। এতে সকল রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে। তাহলে এটা সনদে উল্লেখ থাকতে সমস্যা কোথায়?
“সমস্যা হলো প্রতারণা করার খাসলত। এটা উল্লেখ না রাখতে চাওয়ার কারণ হলো পরবর্তীতে বলা হবে ওই মৌখিক ঐকমত্যের কোনো গুরুত্ব নাই, সাংবিধানিক পথের (যার অর্থ করা হয় পার্লামেন্টের কাছে সংবিধান সংশোধনের এখতিয়ার প্রদান) বাইরে যাওয়ার সুযোগ নাই ইত্যাদি। এই মতলবের কারণেই ঐকমত্যে আসা বিষয়েও সনদে উল্লেখ রাখতে গড়িমসি করা হয়েছে।”
তিনি লেখেন, “কমিশন ও সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে, এখন আর সনদ সংশোধনের সুযোগ নাই। অথচ আজ যখন আহতরা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দাবিতে বিক্ষোভ জানাল (মাসিক ভাতা, চিকিৎসা, আইনি সুরক্ষা ও নিরাপত্তা), তখন চাপে পড়ে সাথে সাথে সনদের টেক্সটের ৫ নং ধারা সংশোধন করা হলো। কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ ক্ষমাও চাইলেন।
“এখন কীভাবে সনদের টেক্সট সংশোধন করা গেল? আর বাস্তবায়ন পদ্ধতির উল্লেখের যৌক্তিক দাবিকে কীভাবে অগ্রাহ্য করা গেল? কার/কাদের নির্দেশে? এগুলোই এখনকার প্রতাপশালী রাজনীতি।
“কিংস পার্টি, কিংস পার্টি বলে চিৎকার না করে কমিশন ও সরকারের অদৃশ্য নিয়ন্ত্রক কারা চোখ-কান খুলে তা বোঝার চেষ্টা করা দরকার।
“উদ্ভূত পরিস্থিতির সকল দায় সরকারের। এনসিপির সহনশীলতা ও সহযোগিতার মনোভাবকে দুর্বলতা ভেবে বসবেন না।”
