কৌশল জানা থাকলে মশা মারতে কামান দাগার প্রয়োজন পড়বে না।
Published : 30 Jun 2025, 07:24 PM
বাংলাদেশের গরম ও আর্দ্র আবহাওয়াতে মশার উৎপাত নতুন কিছু নয়। বিশেষ করে বর্ষাকালে বা বৃষ্টির পর উঠানে, ছাদে, ড্রেনের পাশে বা টবের নিচে জমে থাকা পানিতে দ্রুত জন্মাতে পারে মশার ‘লার্ভা’ বা শূককীট।
এতে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া বা ম্যালেরিয়া ছড়ানোর ঝুঁকি বেড়ে যায়। তবে বাড়ির আঙিনা বা ছাদে কিছু সহজ ব্যবস্থা নিলে এই সমস্যা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা যায় এবং সেটা করতে প্রয়োজন হয় না দামি সরঞ্জাম বা ক্ষতিকর রাসায়নিকের।
এই বিষয়েই রিয়েল সিম্পল ডোটকম-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের ‘রাটগার্স ইউনিভার্সিটি’র পতঙ্গবিদ্যা বিভাগের প্রধান ড. ডিনা ফনসেকা কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন।
যে কারণে কামড়ায় মশা
আমরা ভাবি মশা মানুষকেই বেশি কামড়ায়। তবে বাস্তব হল, অধিকাংশ মশা শুধু মানুষ নয়- ব্যাঙ, পাখি বা গিরগিটির রক্ত খেতে পছন্দ করে।
তবে কিছু আগ্রাসী জাতের মশা আছে যেমন- ‘এশিয়ান টাইগার মশা’ যারা মানুষের রক্তই খোঁজে।
ড. ফনসেকা বলেন, “শুধু মেয়ে মশারাই রক্ত খায়, কারণ তারা ডিম তৈরির জন্য রক্ত থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সংগ্রহ করে।”
আর গরম ও ভেজা পরিবেশেই এদের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যায়।
কখন বেশি দেখা যায়?
জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত মশার প্রকোপ বেশি থাকে। আবার দিনের মধ্যে সকালে ও সন্ধ্যায় মশা সবচেয়ে বেশি সক্রিয় থাকে। তবে কিছু মশা দিনের বেলাতেও কামড়াতে পারে।
বাগানে মশা প্রতিরোধের সহজ উপায়
বাগান, উঠান কিংবা বাড়ির সামনে খোলা জায়গা, ছাদ বা বারান্দা থেকে মশার বিস্তার রোধ করতে সহজ কিছু পন্থা অবলম্বন করা যায়।
জমে থাকা পানি সরান: মশার বংশবিস্তারের জন্য এক ফোঁটা পানিই যথেষ্ট। প্লাস্টিকের বোতল, পুরানো টায়ার, ফুলের টব, মগ বা যে কোনো খোলা পাত্রে জমে থাকা পানি মশার আদর্শ আবাসস্থল হয়ে ওঠে।
ড. ফনসেকা বলেন, “একটি ছোট দইয়ের পাত্রে ৫শ’টি পর্যন্ত মশার ‘লার্ভা’ পাওয়া যেতে পারে।”
তাই প্রতিদিন ঘরের চারপাশে ভালো করে খুঁজে জমে থাকা সব পানি ফেলে দিন বা ঢেকে রাখুন।
ছাদ ও ড্রেন পরিষ্কার
ছাদে বাগান থাকলে আশপাশে নালায় ময়লা জমে পানি আটকে গেলে সেখানে মশা জন্মায়। বিশেষ করে ছাদে থাকা ড্রেন বা পাইপ লাইন নিয়মিত পরিষ্কার না করলে সেখানেও পানি জমে।
তাই ছাদে ঝাঁড়ু দিতে হবে, নালার মুখ পরিষ্কার রাখতে হবে। আর প্রয়োজনে ছাঁকনি ব্যবহার করতে হবে।
গাছের টব ও রিসাইকেল বক্সে নজর
ফুলের টবের নিচে থালা বা ট্রেতে পানি জমে থাকলে তাও মশার জন্মস্থল হতে পারে। আবার রিসাইকেল বক্সে জমা ক্যান বা বোতলের ভেতরে বৃষ্টির পানি জমে যায়। তাই বোতলের নিচে ছোট ছিদ্র করে দিতে হবে যেন পানি জমে না থাকে।
বাগানের সাথে ছোট পুকুর বা সুইমিং পুল থাকলে রক্ষণাবেক্ষণ করা
যদি ছাদ বাগানের পাশে ছোট পুকুর বা সুইমিং পুল থাকে, সেখানে পানির সঞ্চালন ব্যবস্থা সচল রাখতে হবে। ক্লোরিন বা জীবাণুনাশক ব্যবহারে পানির গুণমান ঠিক রাখা জরুরি। জমে থাকা পানি আর ময়লা হলে মশা সহজেই বাসা বাঁধবে।
ধোঁয়া তৈরি
মশা ধোঁয়া অপছন্দ করে। তাই বাগানের পাশে বসার সময় ধূপ বা আগুন জ্বালিয়ে ধোঁয়ার মাধ্যমে মশা দূরে রাখা যায়। পিকনিক বা ছাদে আড্ডায় এই কৌশল কার্যকর।
গাছ লাগান যেগুলো মশা তাড়ায়
লেবু ঘাস, তুলসী, ল্যাভেন্ডার, রোজমেরি, বাসিল বা ক্যাটনিপ গাছ লাগালে মশা দূরে থাকে। এগুলো প্রাকৃতিকভাবেই মশা তাড়াতে সহায়ক। তাই ছাদে বা বারান্দাতে বাগান করার সময়ে বেশি বেশি এ ধরনের গাছ লাগাতে হবে।
আশপাশ পরিষ্কার ও পরিপাটি রাখা
বাগান থেকে অপ্রয়োজনীয় পুরানো জিনিসপত্র যেমন: ভাঙা বালতি, টায়ার, ক্যান বা খেলনা ফেলে দিতে হবে। না হলে এগুলোতে পানি জমে মশা জন্মাতে পারে।
গাছের কোটর বা গর্ত ভরাট
গাছে যদি গর্ত বা কোটর থাকে, যেখানে পানি জমে তাহলে সেখানে ‘এক্সপান্ডিং ফোম’ ব্যবহার করে বন্ধ করে দিতে হবে। এটি গাছের ক্ষতি না করে পানি আটকে রাখবে।
প্রতিবেশীদের সচেতন করা
শুধু নিজের বাড়ি পরিষ্কার রাখলেই চলবে না। পাশের বাড়িতে যদি মশার জন্মের উৎস বা বাগান থাকে তাহলে সেখান থেকে মশা আসবেই। তাই আশপাশের মানুষদেরও জানাতে হবে যেন তারা নিজের উঠান বা ছাদ পরিষ্কার রাখে।
মশা তাড়াতে যা করা যাবে না
সিট্রোনেলা মোমবাতি: এগুলোর ঘ্রাণ ভালো হলেও মশা তাড়াতে বিশেষ কার্যকর নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, এগুলোতে মশা তেমন ভয় পায় না।
বেশি রাসায়নিক স্প্রে: বাজারে অনেক স্প্রে পাওয়া যায়। তবে এগুলো অতিরিক্ত ব্যবহার করলে উপকারী পোকামাকড় যেমন- মৌমাছি বা প্রজাপতি মরে যায়। এতে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়।
প্রাতিষ্ঠানিক সেবা: অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মশা তাড়ানোর পরিষেবা দেয়। তবে এর কার্যকারিতা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সন্দেহ আছে।
ড. ফনসেকা বলেন, “প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক সময় উপকারী কীটপতঙ্গও মেরে ফেলে, যা দীর্ঘমেয়াদে পরিবেশের ক্ষতি করে।”
বিকল্প ও কার্যকর পদ্ধতি
- পাখি ও বাদুড় আকর্ষণ করতে পারলে ভালো। মশার প্রাকৃতিক শত্রু পাখি, বাদুড় বা মাছ, যারা মশা খেয়ে ফেলে। তাই বাগানে বার্ড ফিডার বসানো বা ছোট পুকুরে মাছ রাখা যেতে পারে।
- পাখার ব্যবহার ভালো বুদ্ধি। বাইরে বাগানে বসার সময় বড় পাখা ব্যবহার করলে বাতাসে মশা উড়তে পারে না। তবে একটি ফ্যান যথেষ্ট নয়, চারপাশে কয়েকটি ফ্যান বসানো ভালো।
- ‘লেমন ইউক্যালিপটাস অয়েল’ একটি প্রাকৃতিক তেল, যা স্প্রে করে মশা দূরে রাখা যায়। যারা ‘ডিইইটি’ ধরনের রাসায়নিক সহ্য করতে পারেন না, তাদের জন্য এটি উপযুক্ত।