পোশাক শিল্পের পর ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ব্র্যান্ডকে বিশ্ব দরবারে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে খেলনা শিল্পের।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বরাবরই কিছু গুরুত্বপূর্ণ খাত রয়েছে, যেগুলোর ওপর দেশের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান নির্ভরশীল। সময়ের পরিক্রমায় এই নির্ভরতার কাঠামো পরিবর্তিত হয় এবং নতুন খাত সামনে চলে আসে। বর্তমানে পোশাক শিল্প, ওষুধ ও প্লাস্টিক পণ্যের মতো প্রতিষ্ঠিত রপ্তানি খাতের পাশাপাশি বিকল্প একটি শিল্প হিসেবে খেলনা শিল্প অত্যন্ত দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। এটি কেবল দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদাই মেটাচ্ছে না, বরং বৈশ্বিক বাজারেও উল্লেখযোগ্য স্থান করে নিচ্ছে। অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য আনার ক্ষেত্রে এই খাত নতুন আশার সঞ্চার করেছে।
খেলনা শিল্পের বাজার এত দ্রুত বিস্তৃত হচ্ছে যে, এতে প্রচুর শ্রমশক্তি এবং কাঁচামালের প্রয়োজন। যদিও বেশিরভাগ খেলনা প্লাস্টিকের তৈরি, তবুও এর জন্য প্রচুর শ্রমিক প্রয়োজন, তাও তুলনামূলক কম মজুরিতে। দেশের বাজারে বিপুল চাহিদার পাশাপাশি বিদেশের বাজারেও তৈরি হচ্ছে চাহিদা। একটু মনোযোগী হলে আমরা এই সুযোগকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারব। আমাদের শৈশবের টমটমের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। এই টমটম তৈরিতে মাটির সড়া, বাঁশ, দড়ি, আঠা ইত্যাদি প্রয়োজন হয়। সব উপকরণই গ্রামনির্ভর। সম্পূর্ণ গ্রামীণ উপাদান দিয়ে তৈরি এই খেলনা গত পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে টিকে আছে। মোস্তফা গত প্রায় বিশ বছর ধরে শিশুদের খেলনা বিক্রি করেই তার সংসার চালাচ্ছেন। আবার, ফিরোজ শুধু বিক্রিই নয়, স্থানীয় উপকরণ দিয়ে বাড়িতে কিছু খেলনাও তৈরি করেন। গ্রামে এখন প্লাস্টিক রিসাইকেলের ব্যবস্থা হয়েছে। দিনভর বিভিন্ন এলাকা থেকে প্লাস্টিকের বোতল ও অন্যান্য জিনিস সংগ্রহ করে তিনি রিসাইকেল কেন্দ্রে বিক্রি করেন।
খেলনা শিল্পের বিশ্ববাজার অত্যন্ত বিশাল, যার আকার ১০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি এবং ২০৩২ সালের মধ্যে তা ১৫০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এই বিপুল বাজারে চীন বর্তমানে ৮০ শতাংশের বেশি অংশ নিয়ন্ত্রণ করলেও, সেখানে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় দেশটি নিম্নমানের খেলনা উৎপাদন থেকে ধীরে ধীরে সরে আসছে। এই পরিস্থিতি বাংলাদেশসহ অন্যান্য উদীয়মান অর্থনীতির জন্য একটি বিশাল সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশ এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে খেলনা রপ্তানিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখিয়েছে।
রপ্তানি বৃদ্ধি: ২০১৬-১৭ অর্থবছরে খেলনাসামগ্রী রপ্তানির পরিমাণ ছিল মাত্র ১৫.২৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। সেখান থেকে ছয় বছরে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে, ৮৮টি দেশে রপ্তানির মাধ্যমে তা প্রায় পাঁচ গুণ (৪০০% এরও বেশি) বেড়ে ৭৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে।
ভবিষ্যত সম্ভাবনা: নীতিগত সহায়তা পেলে এবং এই শিল্পের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা সম্ভব হলে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের খেলনা রপ্তানির আকার বেড়ে প্রায় ৪৭ কোটি ডলারে (৪৭০ মিলিয়ন ডলার) পৌঁছাতে পারে। এর ফলে বৈশ্বিক খেলনা রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ২৮তম হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
দেশীয় বিনিয়োগ ও বাজার: বর্তমানে দেশে খেলনা খাতে প্রায় ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে এই বিনিয়োগ দ্বিগুণ হতে পারে। এই শিল্পের প্রায় ২৫০টি প্রতিষ্ঠান বর্তমানে খেলনা উৎপাদনে নিয়োজিত।
বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া প্লাস্টিকের খেলনার একটি বড় অংশ ইউরোপের বাজারে যায়। রপ্তানি বাজারের সর্বোচ্চ ৩১.৭৬ শতাংশ রপ্তানি হয় স্পেনে, এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে যথাক্রমে ইতালি ও ফ্রান্স। প্লাস্টিকের খেলনা রপ্তানিতে বার্ষিক ১৬ শতাংশ গড় প্রবৃদ্ধি ধরলে ২০৩০ সালে বাংলাদেশে তৈরি খেলনার রপ্তানি বাজার ১৫ কোটি ১৭ লাখ মার্কিন ডলারে উন্নীত হবে। এই বাজারের আরেকটি বড় সুবিধা হলো, বেশিরভাগ খেলনা দ্রুত ভোক্তার হাত থেকে রিসাইকেল হয়ে পুনরায় খেলনায় রূপান্তরিত হয়। অর্থাৎ, এটি টেকসই পণ্য নয়, ফলে এর চাহিদা অন্যান্য পণ্যের তুলনায় অনেক বেশি।
খেলনা শিল্প একটি শ্রমঘন খাত, যেখানে বিপুল সংখ্যক জনবল প্রয়োজন। বর্তমানে এই খাতে প্রায় ১.৫ মিলিয়ন মানুষ কর্মরত রয়েছেন। এর একটি বড় অংশ গ্রামে বসবাসকারী অদক্ষ ও স্বল্প দক্ষ নারী-পুরুষ, যাদের অপেক্ষাকৃত কম অর্থের বিনিময়ে কাজে লাগানো সম্ভব। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) এর তথ্যমতে, খেলনা শিল্পে প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক কাজ করছেন, যার মধ্যে ৮০ শতাংশই নারী।
খেলনা শিল্পকে গ্রামভিত্তিক শিল্প হিসেবে বিকশিত করার মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতিতে একাধিক সুবিধা আনা সম্ভব:
১. নারী কর্মসংস্থান: গ্রামের বিপুল সংখ্যক নারী জনশক্তির কর্মসংস্থান হবে, যা নারী ক্ষমতায়ন ও পারিবারিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
২. শহরের ওপর চাপ হ্রাস: কাজের সন্ধানে গ্রাম থেকে শহরে আসা মানুষের সংখ্যা কমবে, যা শহরের ওপর থেকে চাপ কমাতে সহায়ক হবে।
৩. স্থানীয় উপকরণের ব্যবহার: খেলনা শিল্পের একটি অংশ, যেমন ছেলেবেলার টমটম বা মাটির খেলনা, এখনও সম্পূর্ণভাবে গ্রামীণ উপাদান (মাটির সড়া, বাঁশ, দঁড়ি ইত্যাদি) ব্যবহার করে তৈরি হয়। মোস্তফার মতো ছোট বিক্রেতারা জানান, এই খেলনা বিক্রি করে তাদের সংসার চলে যায়। স্থানীয় উপকরণ নির্ভর এই ধরনের উৎপাদন ব্যবস্থা গ্রামীণ জীবন ও জীবিকার উৎস হিসেবে স্বনির্ভরতা তৈরি করে।
এই বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর পথে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে, যা নীতিগত সহায়তা ছাড়া অতিক্রম করা কঠিন। খেলনা শিল্পের জন্য এখন পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই, যার কারণে উদ্যোক্তারা বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধার মতো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি সহায়তা পেতে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। পাশাপাশি, কাঁচামাল আমদানিতে উচ্চ শুল্ক হার ও আমদানি-নির্ভর প্যাকেজিং খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এ ছাড়া পণ্যের মান নিশ্চিতকরণ, অপ্রতুল অবকাঠামো, গবেষণা ও উদ্ভাবনে কম বিনিয়োগ এবং ছাঁচ ও নকশা উন্নয়নের ঘাটতি আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা কঠিন করছে।
খেলনা শিল্পের টেকসই বিকাশের জন্য প্রয়োজন একটি সুচিন্তিত কৌশল। প্রথমত, সরকারকে দ্রুত একটি সুনির্দিষ্ট খেলনা শিল্প নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। দ্বিতীয়ত, কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক কমানো এবং রপ্তানিমুখী খেলনার জন্য বন্ডেড সুবিধা সম্প্রসারণ করা জরুরি। তৃতীয়ত, খেলনার বৈচিত্র্য ও আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করতে গ্রামে অবস্থিত নারী-পুরুষকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এবং উদ্যোক্তাদের প্রাথমিক মূলধন সরবরাহ করার মাধ্যমে ক্ষুদ্র কারখানা গড়ার উদ্যোগ নিতে হবে।
বাংলাদেশের খেলনা শিল্প কেবল একটি নতুন রপ্তানি সম্ভাবনাই নয়, বরং এটি দেশের গ্রামীণ অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন এবং সামাজিক অগ্রগতির একটি শক্তিশালী মাধ্যম। একদিকে বৈশ্বিক খেলনার বাজার যখন চীন থেকে সরে এসে বিকল্প খুঁজছে, তখন বাংলাদেশের খেলনা শিল্প সেই শূন্যস্থান পূরণের বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে প্রস্তুত। বিশেষত, এই শিল্পের ৮০ শতাংশেরও বেশি নারী কর্মীর অংশগ্রহণ প্রমাণ করে যে, এটি তৃণমূল পর্যায়ে নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে এবং গ্রামীণ পরিবারগুলোর জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সরাসরি ভূমিকা রাখছে। ঐতিহ্যবাহী মাটির ও বাঁশের খেলনা থেকে শুরু করে আধুনিক প্লাস্টিক পণ্যের উৎপাদন পর্যন্ত—এই শিল্প গ্রামীণ সম্পদ ও সহজলভ্য শ্রমকে কাজে লাগাচ্ছে। তবে, এই ‘বিকাশ’কে টেকসই করতে হলে অবশ্যই নীতিগত সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। খেলনা শিল্পের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা, কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক হ্রাস, এবং গ্রামীণ উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ অর্থায়ন ও আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি।
পোশাক শিল্পের পর ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ব্র্যান্ডকে বিশ্ব দরবারে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে খেলনা শিল্পের। গ্রামীণ জনশক্তি ও সহজলভ্য রিসাইকেলযোগ্য কাঁচামালকে কাজে লাগিয়ে প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা পেলে খেলনা শিল্প কেবল রপ্তানি বহুমুখীকরণেই নয়, বরং টেকসই গ্রামীণ অর্থনীতি গঠনেও এক বিশাল ভূমিকা রাখবে।
