প্রধান উপদেষ্টা একটা সম্ভাব্য সময়সূচি বলেছেন। কোনো নির্দিষ্ট তারিখ বলেননি। কারণ এটা করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের, বলেন নির্বাচন বিশ্লেষক আলীম।
Published : 06 Aug 2025, 01:41 AM
আগামী ফেব্রুয়ারিতে রোজার আগে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য যে সময়ের কথা দুমাস আগে লন্ডন বৈঠকের যৌথ ঘোষণায় এসেছিল, সেই সময়সুচিই এবার নিজের মুখে ঘোষণা করলেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
মঙ্গলবার জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবসে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেছেন, আগামী রোজার আগেই, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দেবে সরকার।
নির্বাচন নিয়ে নানান শঙ্কা প্রকাশ ও দোদুল্যমানতা আর গুজব পেরিয়ে অবশেষে নির্বাচনের নির্ধারিত সময় ঘোষণা করলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা।
তবে নির্বাচনের কোনা সুনির্দিষ্ট তারিখ দেননি তিনি। তাতে নির্বাচন নিয়ে সংশয় কি দূর হল?
রাজনৈতিক দলের নেতারা কেউ কেউ প্রধান উপদেষ্টার এই ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে তফসিলের অপেক্ষায় থাকার কথা বলেছেন।
সংস্কার কার্যক্রম দৃশ্যমান না হওয়া এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কারণে এই মুহূর্তে সরকারের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন এসেছে কারও কাছ থেকে।
তবে প্রধান উপদেষ্টার এই ঘোষণায় দোদুল্যমানতা আর গুজবের অবসান হয়েছে বলে মনে করছেন নির্বাচন বিশ্লেষক ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য আব্দুল আলীম।
২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের তিন দিন পর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেয়।
সরকার গঠনের চার মাসের মাথায় ১৬ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে চলতি বছরের ডিসেম্বর বা ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের আভাস দেন ইউনূস।
সরকারপ্রধান ইউনূসসহ উপদেষ্টাদের নানা বক্তব্যে আশ্বস্ত না হয়ে নির্বাচনের পথনকশা (রোডম্যাপ) চাওয়ার পাশাপাশি চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে ভোটের দাবি জানিয়েছিল বিএনপি।
ভোটের তারিখ নিয়ে বিরোধের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারবিরোধী অবস্থান প্রকাশ করে আসছিল বিএনপি; মাঠের শক্তিও দেখাচ্ছিল বিভিন্নভাবে।
এর মধ্যে কোরবানি ঈদের আগের দিন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে নির্বাচনের সময়সীমা কিছুটা এগিয়ে আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধের সময় ঘোষণা করেন প্রধান উপদেষ্টা।
জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপিসহ বিভিন্ন দল তার এই বক্তব্যকে স্বাগত জানালেও বিএনপি আগের অবস্থানেই অনড় থাকে। তাদের দাবি ছিল চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের।
আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চে রোজার মধ্যে নির্বাচনি প্রচার এবং পরে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষাকে এপ্রিলে নির্বাচন হওয়ার পথে বাধা বলে তুলে ধরেন দলটির নেতারা।
মাঠে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নিষ্ক্রিয়তার মধ্যে এমন প্রেক্ষাপটে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে বিরোধপূর্ণ অবস্থার কারণে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার এবং জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারিক কার্যক্রমও বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করছিলেন বিশ্লেষকরা।
এর মধ্যে ১১ জুন লন্ডনে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তাদের বৈঠকের যৌথ ঘোষণায় বলা হয়, “সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে ২০২৬ সালে রোজা শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে সেই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন হবে।”
সেই ঘোষণার মধ্যে শর্ত জুড়ে থাকায় নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা ছিল।
মঙ্গলবার জাতির উদ্দেশ্যে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে আগামী রোজার আগে, ফেব্রুয়ারিতে ভোট আয়োজনের ঘোষণা এল।
চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী বছর ১৮ ফেব্রুয়ারি রোজা শুরু হতে পারে। সেই হিসাব ধরে তার আগে ভোটের তারিখ ঠিক করার কথা নির্বাচন কমিশনের।
ফেব্রুয়ারিতে ভোটের ঘোষণা
ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উদযাপনের দিনব্যাপী আয়োজনে বিকালে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজার মঞ্চে উপস্থিত হন মুহাম্মদ ইউনূস। রাজনৈতিক দলের নেতাদের পাশের রেখে জুলাই ঘোষণাপত্র ঘোষণা করেন সরকারপ্রধান। এরপর রাতে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন তিনি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আজ এই মহান দিবসে আপনাদের সামনে এ বক্তব্য রাখার পর থেকেই আমরা আমাদের সর্বশেষ এবং সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে প্রবেশ করব। আমরা এবার একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করব।
“অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে আমি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে চিঠি পাঠাব, যেন নির্বাচন কমিশন আগামী রমজানের আগে, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন।”
নির্বাচনের সময় জানালেও সুনির্দিষ্ট কোনো তারিখ ঘোষণা না করে প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে সবার ‘দোয়া’ চেয়েছেন, যাতে ‘সুন্দরভাবে’ নির্বাচন করে এ দেশের সকল নাগরিক একটি ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার কাজে সফলভাবে এগিয়ে যেতে পারে।
পাশাপাশি সরকারের তরফ থেকে সকল প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি বলেন, “এবারের নির্বাচন যেন আনন্দ-উৎসবের দিক থেকে, শান্তি-শৃঙ্খলার দিক থেকে, ভোটার উপস্থিতির দিক থেকে, সৌহার্দ্য ও আন্তরিকতার দিক থেকে দেশের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকে সেজন্য সকল আয়োজন সম্পন্ন করতে আগামীকাল থেকে আমরা সকলেই মানসিক প্রস্তুতি ও প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন শুরু করব।”
ইউনূস বলেন, সরকার এবার প্রবাসী ভোটারদের ভোট দেওয়ার আয়োজন নিশ্চিত করতে চায়। নির্বাচন কমিশনও এ বিষয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে।
পাশাপাশি নারী ভোটাররা যেন দেশের সর্বত্র নির্দ্বিধায় আনন্দ-উৎসাহ নিয়ে ভোট দিতে পারে, তা নিশ্চিত করার আগ্রহের কথা বলেন সরকারপ্রধান।
তিনি বলেন, “এবার যেন কেন্দ্রে কেন্দ্রে নারী ভোটারদের ঢল নামে আমরা সেই লক্ষ্যে সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করব।”
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ের তিনটি নির্বাচনের কথা মনে করিয়ে দিয়ে ইউনূস বলেন, “দেশের মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেবার কারণে গত ১৫ বছর ধরে নাগরিকবৃন্দ ভোট দিতে পারেনি। এবারের নির্বাচনে আমরা আমাদের বকেয়া আনন্দসহ মহা আনন্দে ভোট দিতে চাই।
“নির্বাচনের দিনকে আমরা ঈদের উৎসবের মতো করতে চাই। এবারের ভোটের আনন্দ থাকবে সবার মধ্যে। আপনারা সবাই বাচ্চাকাচ্চাদের নিয়ে ভোটকেন্দ্রে যাবেন।”
ভোটারদের উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “এখন থেকে প্রতিদিন আলাপ করুন, আপনার এলাকায় ভোটদান ব্যবস্থা কেমন হলে সুন্দর হয়, কেমন হলে আনন্দমুখর হয়, সেটা আগে থেকে ঠিক করার জন্য। নতুন বাংলাদেশ গড়ার কাজের ভিত্তি রচনা হবে এবারের নির্বাচনে। তার জন্য প্রস্তুতি নিন।”
‘সেরা ব্যক্তিকে’ নির্বাচিত করতে সবাইকে খোঁজ খবর নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “যাদের তাজা রক্তের বিনিময়ে আমরা আমাদের এই অতি মূল্যবান অধিকার ফিরে পেলাম, ভোটটা দেবার আগ মুহূর্তে যেন তাদের চেহারা আমাদের চোখে ভেসে ওঠে।”
তিনি বলেন, “ফেব্রুয়ারি বেশি দূরে নয়। নির্বাচন নিয়ে প্রস্তুতি নিতে নিতেই ভোটের দিন এসে পড়বে। বহু বছর আমরা কেউ ভোট দিতে পারিনি। এবার আমরা সবাই ভোট দেব। কেউ বাদ যাবে না।
“সবাই যেন বলতে পারি নতুন বাংলাদেশ গড়ার পথে দেশকে রওনা করার জন্য আমি আমার ভোটটা দিয়েছিলাম। আমার ভোটেই দেশটা সে পথে রওনা হতে পেরেছিল।”
‘গুজবের যবনিকা, এখন রোডম্যাপ দরকার’
নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলীম বলেছেন, প্রথম কথা হচ্ছে মানুষের অনেকের মধ্যে এক ধরনের সন্দেহ, এক ধরনের অবিশ্বাস, এক ধরনের গুজব ছিল যে নির্বাচন আদৌ ফেব্রুয়ারিতে হবে কিনা, দুই বছর হবে কিনা, তিন বছর হবে কিনা-এরকম একটা গুজব ছিল।
“প্রধান উপদেষ্টার আজকের ঘোষণার মধ্য দিয়ে সেই গুজবের যবনিকা ঘটলো। এখন আর কোন সন্দেহ নেই এখন আর কোন অবিশ্বাস নেই যে নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে হবে না। এখন পরিষ্কার হয়ে গেল ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে।”
এ বিশ্লেষক বলছেন, প্রধান উপদেষ্টা একটা সম্ভাব্য সময়সূচি বলেছেন। কোনো নির্দিষ্ট তারিখ বলেননি।
“কারণ এটা করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। বাংলাদেশের ইতিহাসে যত নির্বাচন হয়েছে, সব নির্বাচনের তারিখই নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করেছে। কখনো অন্তবর্তীকালীন সরকার বা অন্য কোনো সরকার এটা ঘোষণা করেননি। এখন মানে যেটা হবে যে প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশন তো বটেই, মানে দেশটা এখন নির্বাচনমুখী হয়ে গেল।”
তার মতে, তফসিল ঘোষণা ও ভোটের তারিখকে সামনে রেখে এখন নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের পথনকশার প্রস্তুতি নিতে পারে।
এ বিশ্লেষক বলেন, “সামনে একটা রূপরেখা আছে, সময়সূচি আছে। এখন নির্বাচন কমিশন যদি মনে করে, নির্বাচন কমিশনের রেওয়াজ ২০০৮ সালের নির্বাচন থেকে (রোডম্যাপ দেওয়া), আগে তো এই রোডম্যাপ ছিল না। রোডম্যাপের একটা রেওয়াজ চালু হয়ে গেছে।
“নির্বাচন কমিশন এখন একটা রোডম্যাপ ঘোষণা করতে পারে আর যথাসময়ে তফসিল ঘোষণা করবে। যেটা থেকে দুই মাস আগে হয়, যেটা করা হয়ে থাকে।”
প্রধান উপদেষ্টার ভোটের সম্ভাব্য সময় জানানোর পর দেশ এখন নির্বাচনমুখী হলেও আইনশৃঙ্খলার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন আব্দুল আলীম।
তিনি বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলো এখন নির্বাচনমুখী হয়ে যাবে। তারা তাদের যে অন্যান্য কার্যক্রম, সমস্ত কিছুর চেয়ে নির্বাচনটাকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে, তারা একটা প্রস্তুতি গ্রহণ করবে। নির্বাচন কমিশনও যে কাজগুলো শুরু করেছিল, প্রাক নির্বাচনের যে প্রস্তুতি সেগুলো আরো বেশি গতিশীল হবে, যেহেতু রোজার আগের নির্বাচন।”
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যাতে সংঘাতময় পরিস্থিতি না হয়-প্রধান উপদেষ্টার এমন বার্তার কথা তুলে ধরে এ নির্বাচন বিশ্লেষক বলেন, “কেউ যেন এটাকে (নির্বাচন) বানচাল করতে না পারে।
“এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা। যেটা আমি বারবার বলে আসছি- আগামী নির্বাচনের একটা বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি। আমার কাছে মনে হচ্ছে এটাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। এটা নিয়ে একটা বড় প্রস্তুতির ব্যাপার আছে।”
ইতিহাসের সেরা নির্বাচন ও যাতে সবাই ভোট দিতে পারে সে বিষয়েও গুরুত্বারোপ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা।
আব্দুল আলীম বলেন, “এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তো সবকিছু মিলিয়ে আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে যে দেশটা এখন পুরোপুরি নির্বাচনমুখী হয়ে গেল।”
দোদুল্যমানতা কাটার কথা বলছে বিএনপি
ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় ঘোষণা দেওয়ায় প্রধান উপদেষ্টা ইউনুসকে সাধুবাদ জানিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, “তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, নির্বাচন কমিশনের কাছে তিনি চিঠি পাঠাবেন আগামী ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে রমজান শুরু হওয়ার আগে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য।
“অবশ্য নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করবেন যথা সময়ে। কিন্তু মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা আজকে যেই নির্দেশনা দিয়েছেন তার ভাষণের মধ্য দিয়ে এবং চিঠি প্রদান করবেন নির্বাচন কমিশনকে যা বলেছেন, সেই ঘোষণার জন্য আমরা সবাই অপেক্ষা করছিলাম এবং সারা জাতি অপেক্ষা করছিল।”
তিনি বলেন, “এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে যে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে যে একটি দোদুল্যমানতা ছিলো বলে অনেকে মনে করছিলেন, তাদের মধ্যে দোদুল্যমানতা আর রইল না এবং যারা জাতি একটি নির্বাচনমুখী পরিবেশের দিকে যাবে এবং সেই নির্বাচনের আবহওয়া সৃষ্টি হবে।”
নির্বাচনের এই ঘোষণা রাজনৈতিক সংকট কাটবে কিনা জানতে চাইলে সালাহ উদ্দিন বলেন, “আমরা মনে করি, এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আরো বেশি প্রতিষ্ঠিত হবে এবং কোনো রকমের কোনো অনিশ্চিত পরিবেশ বা ব্যবসা-বাণিজ্য-বিনিয়োগে কোনো অনিশ্চিয়তা থাকবে না। সব কিছু সচল এবং গতিশীলতা পাবে…আমরা এটাই আশা করি।”
সন্দিহান এনসিপি
এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই মুহূর্তে নির্বাচন কেন্দ্রিক রাজনীতির চেয়ে সংস্কারকেন্দ্রিক রাজনীতিকে এনসিপি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। তবুও যে কোনো পরিস্থিতিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার প্রস্তুতি দল হিসেবে আমাদের রয়েছে।
“এনসিপি নির্বাচনের তারিখ নিয়ে কখনও নেতিবাচক মন্তব্য করেনি। নির্বাচনের আগে নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার করা প্রয়োজন। সেজন্য সরকার একটি কমিশনও করেছে, সেই কমিশন সুপারিশও জমা দিয়েছে। কিন্তু সেই সুপারিশের কোনো বাস্তবায়ন এখনো দেখা যাচ্ছে না। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দুটোর অবস্থাই খুবই শোচনীয়। নির্বাচনের সাথে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কারও এখনো বাস্তবায়ন হয় নাই।
“এমন পরিস্থিতিতে আমাদের প্রয়োজন ছিল একটা মাঠের পরীক্ষা নেওয়া। যে একটা জাতীয় নির্বাচন করার পরিস্থিতি বা সক্ষমতা আছে কিনা সেই পরীক্ষা করা। এর পাশাপাশি রয়েছে যে আওয়ামী লীগের অপরাধীদের বিচার, যা এখনো দৃশ্যমান হয়নি।”
“এসব চ্যালেঞ্জ মাথায় রেখে বলা যায় একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ কোন ভাবেই তৈরি হয়নি। তবুও প্রধান উপদেষ্টা এবং উপদেষ্টা পরিষদ, ঐক্যমত্য কমিশন এবং সংশ্লিষ্ট যারা আছেন সবাই যদি প্রচেষ্টা চালিয়ে যে থাকেন তাহলে হয়তো একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব।”
জাতীয় পার্টির মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দেশে নির্বাচনের একটা সময় ঘোষণা হয়েছে, এটা ভালো দিক, দলগুলো শান্ত হবে, অশান্ত থাকবে না।”
তবে দেশে ‘মব’ সহিংসতা চলছে এবং আইনের শাসনের ব্যত্যয় ঘটছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এসমস্ত বিষয় নিয়ন্ত্রণ না নিলে, পুলিশ, প্রশাসন, সরকার ও রাজনৈতিক দল সবার মধ্যে যদি সুষ্ঠু নির্বাচনের একটি ঐক্য না আসে, তাহলে আমি মনে করি কোনো অবস্থাতেই সরকার নির্বাচন করতে পারবে না।”
সাকির কাছে ‘উপযুক্ত সময়’, প্রিন্স চান ‘নিরপেক্ষ সরকার’
ভোটের সময় ঘোষণার পর নির্বাচন সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করতে ‘নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকার’ কবে গঠন করবে তা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে জানতে চেয়েছেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স।
অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে নিরপেক্ষতা ‘হারিয়েছে’ দাবি করে দ্রুত নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি জানিয়ে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা এখনও দাবি করি, নির্বাচন কমিশনকে বলা উচিত নির্বাচন ডিসেম্বরের মধ্যে আয়োজন করতে এবং সেটা সম্ভব বলে মনে করি। তার পরেও ওনার মুখ দিয়ে একটা সুনির্দিষ্ট মাসের খবর পেলাম, সেটা একধাপ অগ্রগতি বলে মনে করি।
“আমরা আশা করবো উনি এটাও জানাবেন, দ্রুততম সময়ে নিরপেক্ষ সরকার কবে গঠন করবেন। এটাও একটা সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য জরুরি কর্তব্য বলে আমাদের কাছে মনে হয়, কারণ এই সরকার ইতোমধ্যে নিরপেক্ষতা হারিয়ে ফেলেছে।”
গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকী বলেন, “আগামী ফেব্রুয়ারিতে রোজার আগে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য যে সময়ের কথা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, সেটা যৌক্তিক ও উপযুক্ত সময়। এ নিয়ে আর কোনো আশংকা যেন না কাজ করে, সেভাবেই বাকি সব ব্যবস্থা নিতে হবে।”
ভোটের ৫০-৬০ আগে তফসিল, বলছে ইসি
নির্বাচন রোজার আগে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ভোটের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণার পর শিগগির কর্মপরিকল্পনার বাস্তবায়নসূচি নিয়ে ‘অ্যাকশনপ্ল্যান’ প্রকাশ করার কথা বলেছে নির্বাচন কমিশন।
সেই সঙ্গে ভোটের তারিখের ৫০-৬০ দিন আগে বা ডিসেম্বরের শেষার্ধে তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলেছে নির্বাচন আয়োজনকারী সাংবিধানিক সংস্থাটি।
প্রধান উপদেষ্টার মুখ থেকে মঙ্গলবার ভোটের সময় ঘোষণার আসার এক প্রশ্নে নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি চলছে। প্রধান উপদেষ্টা সম্ভাব্য সময় জানিয়ে দিয়েছেন। আমরা ভোটের জন্য চলমান কাজগুলোর একটা অ্যাকশনপ্লান শিগগির ঘোষণা করব। আর ভোটের তারিখের ৫০-৬০ দিন আগে শিডিউল ঘোষণা করবো।”
৫০-৬০ দিন বিবেচনায় নিলে ডিসেম্বরের শেষার্ধে তফসিলের ঘোষণা আসতে পারে। সেক্ষেত্রে আবহাওয়া, পরীক্ষাসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করে তফসিল দেওয়ার সময় চূড়ান্ত করবে নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচন কমিশনার মাছউদ বলেন, “ভোটের তারিখের ৫০ থেকে ৬০ দিন আগে বা দুই মাস আগে তফসিল হলে সেরকমই (ডিসেম্বরের শেষে) হতে পারে। আরপিও’র ১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মনোনয়নপত্র জমা, বাছাই, প্রত্যাহারের সময় ও ভোটের দিন বর্ণনা করে এ তফসিল দেওয়া হবে।”
জানুয়ারির পুরো মাস, ফেব্রুয়ারি অর্ধেক আর ডিসেম্বরের শেষার্ধ- সব মিলিয়ে ৫০-৫৫ দিন সময়।
তিনি বলেন, “আমরা রোডম্যাপ ঘোষণা করবো না। তবে আমাদের অ্যাকশনপ্ল্যান আমরা শিগরি ঘোষণা করব ইনশাল্লাহ। অ্যাকশনপ্ল্যান-এ কি কি কাজ, কখন করব, কোনটা কখন শেষ হবে তা বলা থাকবে। দল নিবন্ধন কখন শেষ হবে, সীমানা নির্ধারণ কখন শেষ হবে, কেনাকাটা কবে শেষ- এমন বিষয় থাকবে তাতে।”
তফসিল ঘোষণার আগে এবং তফসিল ঘোষণার পরে কাজের ফর্দ তুলে ধরা হবে এ কর্মপরিকল্পনার বাস্তবায়নসূচিতে।
ইতোমধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এএমএম নাসির উদ্দিন বলেছেন, ভোটের তারিখের প্রায় দু’মাস আগে তফসিল ঘোষণা করা হবে।