জোট রাজনীতির চেনা হিসাব বদলে দিতে পারে আরপিও সংশোধনের নতুন ধারা। প্রশ্ন উঠছে—সরকার কি বিশেষ কোনো দলকে অসুবিধায় ফেলে অন্য দলকে সুবিধা দিতে চাইছে?
সংগৃহিত
নির্বাচনি জোট হলেও প্রার্থীদের নিজ দলের প্রতীকে জাতীয় নির্বাচনে প্রতিযোগিতা করতে হবে। এমন বিধান যুক্ত করে নির্বাচনসংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের খসড়া অনুমোদন করেছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। গত ২৩ অক্টোবর উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বললেন, যদি নির্বাচনি জোট হয়, তাহলেও দলের যে প্রতীক, তা দিয়ে নির্বাচন করতে হবে; যাতে ভোটার স্পষ্ট ধারণা পান প্রার্থী কোন দলের।
প্রশ্ন হল, বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতা ও ভোটের সংস্কৃতি কী বলছে? ধরা যাক আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য, যাদের দলীয় প্রতীক কেটলি, তারা বিএনপির সঙ্গে নির্বাচনি জোট করল এবং নাগরিক ঐক্যকে কয়েকটি আসনে বিএনপি ছাড় দিল। অর্থাৎ ওই আসনগুলোতে বিএনপি কোনো প্রার্থী দিল না। তাহলে আসনগুলোতে নাগরিক ঐক্যের প্রার্থীরা কোন প্রতীকে নির্বাচন করবেন, তাদের দলীয় প্রতীক কেটলি মার্কায় নাকি জোটের প্রধান দল বিএনপির ধানের শীষে?
বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় কোনো বড় দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে অপেক্ষাকৃত ছোট দলের প্রার্থীদের নিজস্ব দলীয় প্রতীকে জয়ী হয়ে আসাটা এখনও বেশ কঠিন। কেননা দলগুলো নির্বাচনে জয়ের শতভাগ নিশ্চয়তা পেতে জোট করে। যেমন বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ প্রার্থীরা ধানের শীষ প্রতীকে যেভাবে নির্ভার থাকবেন, অন্য প্রতীকে সেটা হবে না। ফলে অপেক্ষাকৃত ছোট দলগুলো যখন কোনো বড় দলের সঙ্গে নির্বাচনি জোট করে, সেখানে স্বভাবতই ওই ছোট দলের প্রার্থীরা জোটের প্রধান দলের প্রতীকেই নির্বাচন করেন—যাতে ভোটাররা বুঝতে পারেন যে তিনি হচ্ছেন ওই বড় দলের প্রার্থী।
একইভাবে এবার যদি বিএনপির সঙ্গে আন্দালিভ রহমান পার্থর বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি, জোনায়েদ সাকির গণসংহতি আন্দোলন বা নুরুল হক নুরের গণঅধিকার পরিষদ এমনকি জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপিরও জোট হয়, তাহলে এই দলগুলো তাদের নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করলে বিএনপির ছেড়ে দেওয়া আসনগুলোয় এসব দলের প্রার্থীরা ভোটারদের কী করে বোঝাবেন যে তারা আসলে বিএনপি জোটের প্রার্থী? মান্না, পার্থ, সাকি বা নুর হয়তো ব্যক্তিগত পরিচিতির কারণে তাদের আসনে নিজস্ব দলীয় প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ভোট পাবেন। কিন্তু মাঠে যদি তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী থাকে বিএনপির মনোনয়নবঞ্চিত কেউ এবং সেই সঙ্গে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের মতো দল, তখন ওই তুলনামূলক ছোট দল, যারা মূলত নেতানির্ভর—সেইসব দলের প্রার্থীরা কি সুবিধা করতে পারবেন?
রাজধানীর তিতুমীর কলেজ থেকে গুলশান পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে আন্দালিভ রহমান পার্থ এবং তার দল বিজেপির গরুর গাড়ি মার্কার প্রচুর পোস্টার চোখে পড়ছে কয়েকদিন ধরে। বিএনপির সঙ্গে জোট করলেও তার দলের নিজস্ব প্রতীক গরুর গাড়ি মার্কায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়তো তার অসুবিধা নেই। কারণ তার একটা ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি ও রাজনৈতিক অবস্থান এরই মধ্যে তৈরি হয়েছে। তার এলাকাটিও গুলশান, বনানী ও ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে। কিন্তু বিএনপির সঙ্গে যদি তার দলের আরও কয়েকটি আসনের বিষয়ে সমঝোতা হয়, তাহলে বাকি আসনগুলোতে গরুর গাড়ি মার্কার প্রার্থীরা কতটা সুবিধা করতে পারবেন?
নাগরিক ঐক্যের কেটলি, গণসংহতি আন্দোলনের মাথাল বা গণঅধিকার পরিষদের ট্রাক প্রতীকের সঙ্গে দেশের কত শতাংশ মানুষ পরিচিত বা এইসব প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে এককভাবে এবং বিএনপির সঙ্গে জোট করেও এসব দলের কতজন প্রার্থী জিতে আসতে পারবেন? ধরা যাক তারা বিএনপির সঙ্গে জোট করলেন, কিন্তু ভোটাররা ব্যালট পেপারে দেখলেন যে ধানের শীষ নেই, সেটি কি তাদের বিভ্রান্ত করবে না? ভোটারদের মধ্যে যারা ধানের শীষে ভোট দিতে চান, তারা ব্যালট পেপারে ধানের শীষ না দেখলে বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ ছোট দলগুলোর প্রার্থী ও তাদের প্রতীক চিনে ঠিকমতো ভোট দিতে পারবেন? যদি না পারেন তাহলে ওই সুবিধাটা তখন কারা পাবে?
এই ধরনের জটিলতা এড়ানোর জন্যই মূলত জোটবদ্ধ দলের প্রার্থীরা জোটের প্রধান দলের প্রতীকে নির্বাচন করেন। বিগত দিনে তা-ই হয়েছে। যেমন বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের প্রার্থীরা ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করেছেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের প্রার্থীরা নৌকায় ভোট করেছেন। যেমন জাসদ, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি বা সাম্যবাদী দলের প্রার্থীরা তাদের নিজস্ব মশাল, হাতুড়ি বা চাকা মার্কায় ভোট করলে জিততেন কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। বাংলাদেশের ভোটারদের এই মনস্তত্ত্ব, শিক্ষা ও সচেতনতার বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়েই জোটবদ্ধ দলের প্রার্থীরা অভিন্ন প্রতীকে নির্বাচন করেন। বিএনপির পক্ষে তাই আরপিওর নতুন বিধান বাতিলের দাবি করা হয়েছে।
জোটবদ্ধ হলেও নিজস্ব প্রতীকে ভোট করাই যৌক্তিক এবং সম্মানের—এটা ঠিক। কিন্তু বাংলাদেশের মতো উঠতি গণতন্ত্রের দেশ, বিশেষ করে যেখানে গণতন্ত্র বারবার হোঁচট খেয়েছে এবং যেখানে শিক্ষিত ও সচেতন মানুষের সংখ্যা এখনও কম, সেখানে এখনই উন্নত গণতান্ত্রিক দেশের পদ্ধতি প্রয়োগ করলে বদহজম হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। যেমন আনুপাতিক নির্বাচন তথা পিআর পদ্ধতি বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে থাকলেও বাংলাদেশে এখনই এই পদ্ধতি প্রয়োগ করলে একটা ছ্যাড়াব্যাড়া অবস্থা তৈরি হবে বলে ধারণা করা হয়। একইভাবে জোটবদ্ধ প্রার্থীদের নিজস্ব প্রতীকে ভোট করার সিদ্ধান্তও ভোটের মাঠে নানা জটিলতার সৃষ্টি করবে। মূলত এর মধ্য দিয়ে জোটকারী দলগুলোই ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং অন্য দলের প্রার্থীরা এর সুযোগ নেবে। যে কারণে অন্তর্বর্তী সরকার যখন এই বিধানটি যুক্ত করে আরপিও সংশোধন করল, তখন অনেকের মনেই এই প্রশ্ন তৈরি হয়েছে যে, সরকার কি বিশেষ কোনো দলকে অসুবিধায় ফেলতে এবং বিশেষ কোনো দলকে সুবিধা দেওয়ার জন্য এই বিধানটি যুক্ত করল?
বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা আছে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন-এনডিএম-এর। দলটির প্রধান ববি হাজ্জাজ বলছেন, ‘জোটবদ্ধ প্রার্থীরা নিজস্ব দলীয় প্রতীকে ভোট করবেন, এটা চিন্তার বিষয়। হুটহাট করে কেন সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিল, আমার বুঝে আসছে না। রাজনীতিবিদদের কোনো পরামর্শ কিংবা দলগুলোর মতামত না নিয়ে সরকার আরপিও অনুমোদন দিয়েছে। আমাদের কোনো কথা তারা শুনল না। প্রায় প্রত্যেকটি দল নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রতীক ইস্যুতে আপত্তি জানিয়েছি। এমনকি নির্বাচন সংস্কার কমিশনকেও বিষয়টি বলেছি। এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে নষ্ট করেছে।’
এটা ঠিক যে, জোটবদ্ধ হলেও প্রার্থী নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচন করলে ভোটারদের কাছে তার নিজের ও দলের স্বতন্ত্র পরিচয় বজায় থাকে। ফলে প্রতিটি দল তাদের নিজস্ব সমর্থকগোষ্ঠীকে সক্রিয় রাখতে পারে। কিন্তু এটি সব দলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। উল্টো দিক দিয়ে বিবেচনা করলে, যখন কোনো ছোট বা মাঝারি দল (প্রতীকী অর্থে) অপেক্ষাকৃত বড় বা অতীতে সরকার গঠন করেছে এমন কোনো দলের সঙ্গে জোট করে, তার অর্থ দাঁড়ায় তারা ওই বড় দলের নির্বাচনি কৌশল, নীতি ওে পরিকল্পনার সঙ্গে একমত। সুতরাং নির্বাচনে তাদের প্রতীক অভিন্ন হওয়াই যুক্তিযুক্ত। যাতে করে ভোটাররা বুঝতে পারে যে ওই প্রার্থী আসলে অমুক জোটের তথা ওই বড় দলেরই প্রার্থী। তার নিজের দল বা প্রতীক যাই হোক না কেন। এটা প্রার্থীকে যেমন সুবিধা দেয়, তেমনি ভোটারদেরও সুবিধা। তাছাড়া জোটবদ্ধ প্রার্থীরা যদি নিজস্ব প্রতীকে ভোট করেন, সেটি নির্বাচনি প্রচারে তাদের নানারকম সমস্যায় ফেলবে। তাদের নির্বাচনি পোস্টার বা ব্যানারে থাকবে তার নিজস্ব প্রতীক সিংহ, অথচ তিনি ভোটারের কাছে গিয়ে বলবেন তিনি বিএনপির প্রার্থী। এটা ভীষণ সমস্যার সৃষ্টি করবে তাতে সন্দেহ নেই। সুতরাং জোটবদ্ধ প্রার্থীদের নিজস্ব দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করার বিধান করার পেছনে নির্বাচনকে কঠিন ও জটিল করে তোলার কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না, সেটিও ভেবে দেখা দরকার।