নানা দাবি-দাওয়ার আন্দোলনের কারণে এ পর্যন্ত ছয়বার পরিবর্তিত হয়েছে এই নির্বাচনের তফসিল।
হতে সংগ্রহিত
প্রায় সাড়ে তিন দশক পর অনুষ্ঠেয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা যেন কাটছে না।
নানা দাবি-দাওয়ার আন্দোলনের কারণে এ পর্যন্ত ছয়বার পরিবর্তিত হয়েছে এই নির্বাচনের তফসিল। ১৫ সেপ্টেম্বর ভোটগ্রহণের কথা থাকলেও ২২ সেপ্টেম্বর তৃতীয়বারের মত পিছিয়ে নতুন তারিখ ধরা হয় ১৬ অক্টোবর। তবে ওই তারিখ নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
‘পোষ্য কোটা’ পুনর্বহাল আর বাতিলের দাবিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ধস্তাধস্তির ঘটনায় ‘শিক্ষক লাঞ্ছনা’র অভিযোগ এনে শিক্ষকদের কর্মবিরতি এই শঙ্কার অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
‘পোষ্য কোটা’ পুনর্বহালের আন্দোলন
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানায়, ১৯৭৭ সালে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল বারী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘পোষ্য কোটা’ চালু করেছিলেন। ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘পোষ্য কোটা’ বাতিলের আন্দোলন শুরু করে শিক্ষার্থীরা। এ সময় প্রশাসন ‘পোষ্য কোটা’ চার শতাংশ থেকে কমিয়ে তিন শতাংশ করে।
শিক্ষার্থীরা সেটি না মেনে ‘পোষ্য কোটা’ পুরোপুরি বাতিলের দাবিতে আমরণ অনশনে বসেন। পরে ১ জানুয়ারি সহায়ক ও সাধারণ কর্মচারীদের সন্তানদের জন্য এক শতাংশ কোটা রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শিক্ষার্থীরা সেটিও মেনে না নিলে আন্দোলনের মুখে ২ জানুয়ারি ‘পোষ্য কোটা’ পুরোপুরি বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
‘পোষ্য কোটা’ বাতিলের পর থেকেই শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এটিকে ‘প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা’ উল্লেখ করে পুনর্বহালের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। পরে ১৩ অগাস্ট থেকে ‘পোষ্য কোটা’ পুনর্বহালসহ আট দফা দাবিতে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের একটি অংশ কর্মবিরতি ও অবস্থান ধর্মঘট শুরু করেন।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০ সেপ্টেম্বর ‘পোষ্য কোটা’য় ভর্তির সিদ্ধান্ত অনুমোদন করা হয়। পরে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে প্রশাসন সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে এবং ‘পোষ্য কোটা’ স্থগিত করে।
এরপর কর্মকর্তাদের সংগঠন অফিসার্স সমিতি পূর্ণদিবস কর্মবিরতি ও ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ ঘোষণা করলে নির্বাচন কমিশন ২২ সেপ্টেম্বর ভোটগ্রহণের তারিখ ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে পিছিয়ে ১৬ অক্টোবর নির্ধারণ করে।
এদিকে অফিসার্স সমিতির সভাপতি মোক্তার হোসেন ৯ অক্টোবরের মধ্যে ‘পোষ্য কোটা’ পুনর্বহাল ও শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনার শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানিয়ে ২৪ সেপ্টেম্বর কর্মবিরতি প্রত্যাহার করেন।
১৬ অক্টোবর নির্বাচনের আগে আবারও কর্মবিরতি শুরু হবে কি-না তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
জানতে চাইলে মোক্তার হোসেন বলেন, “আমরা রাকসু নির্বাচন চাই। সুষ্ঠু, স্বাভাবিক সুশৃঙ্খলভাবে এবং উৎসবমুখর পরিবেশে রাকসু নির্বাচন হোক। প্রশাসন যদি আন্দোলনের বিষয়টি নিয়ে বসে আমাদের সঙ্গে এবং দ্বিপাক্ষিক আলোচনা করে যে আপনাদের আন্দোলনটা রাকসু নির্বাচনের পরে নিয়ে যান, আমরা হয়তো বিবেচনা করার জন্য সেটি নিয়ে বসব। সঙ্গত কারণেই আমরা চেষ্টা করব, রাকসু নির্বাচনে যেন বিঘ্নিত না হয়। কিন্তু প্রশাসনের আন্তরিকতা থাকতে হবে।”
শিক্ষক লাঞ্ছনার অভিযোগে আন্দোলন
চলমান ‘পোষ্য কোটা’ বাতিলের আন্দোলনের মধ্যেই ২১ সেপ্টেম্বর শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় শিক্ষক লাঞ্ছনার অভিযোগ এনে এদিন রাতেই দোষীদের শাস্তির দাবিতে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করেন ‘পোষ্য কোটা’র পক্ষে আন্দোলন করা শিক্ষকরা।
পরে ২৫ সেপ্টেম্বর জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম, ইউট্যাব ও জিয়া পরিষদের শিক্ষকরা কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে নেন। তবে শিক্ষক লাঞ্ছনায় জড়িত শিক্ষার্থীদের শাস্তি নিশ্চিত করা না হলে আবারও আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তারা।
জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আমীরুল ইসলাম বলেন, “আন্দোলনের বিষয়টি নির্ভর করবে প্রশাসনের উপর। আমরা দৃশ্যমান শাস্তি দেখতে চাই, যদি দৃশ্যমান কিছু না হয় তাহলে আমরা সিদ্ধান্ত জানাব।”
তিনি আরও বলেন, “রাকসু নির্বাচনে এর প্রভাব পড়বে না। রাকসু নির্বাচন তার নির্বাচন কমিশনের মতোই হবে। রাকসু নির্বাচনের এখনো অনেক দেরি, আমি মনে করি, তার আগেই এই ছাত্রদের চিহ্নিত করে কিছু একটা করা উচিত। প্রশাসনকে শিক্ষক লাঞ্ছনার শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।”
প্রার্থীরা কী ভাবছেন
এদিকে যথাসময়ে রাকসু নির্বাচনের প্রত্যাশা করছেন প্রার্থীরা। তবে বিরূপ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে কয়েকজনের মধ্যে।
ইসলামী ছাত্রশিবির মনোনীত ‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলের সহসাধারণ সম্পাদক (এজিএস) প্রার্থী সালমান সাব্বির বলেন, “আমরা এখন পর্যন্ত আশা করছি, ১৬ তারিখেই নির্বাচন হবে। সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দায়িত্ব প্রশাসনের। শিক্ষক লাঞ্ছনার যে বিষয়টি সেটির জন্য একটি তদন্ত কমিটি কাজ করছে। তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিলে এ বিষয়ে মন্তব্য করা যাবে। আর ‘পোষ্য কোটা’সহ যেসব দাবি আছে সেগুলো আশা করি প্রশাসন সমাধান করে ১৬ তারিখই নির্বাচন দিতে পারবে।”
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল মনোনীত ‘ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্ম’ প্যানেলের সহসভাপতি (ভিপি) প্রার্থী শেখ নুর উদ্দিন আবির বলেন, “আমরা আসলে সবাই আশাবাদী যে, যথাসময়েই নির্বাচন হবে। শিক্ষক লাঞ্ছনার যে অভিযোগ সেটি নিয়ে তারা বিচারের দাবি জানাতে পারে তবে আমরা মনে এটি আর রাকসু নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে না।”
বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলোর জোট ‘গণতান্ত্রিক শিক্ষার্থী পর্ষদ’ প্যানেল থেকে সহসভাপতি (ভিপি) প্রার্থী ফুয়াদ রাতুল বলেন, “শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যে কর্মবিরতি সেটি ৯ তারিখের পর আবারও ফিরবে কি-না সেটি আমরা নিশ্চিত নই। আবার শিক্ষকদের যে দাবি, শিক্ষার্থীদের বিচারের মুখোমুখি করা, সেটি শিক্ষার্থীরা মেনে নেবে বলে আমাদের মনে হয় না। সব মিলিয়ে রাকসুতে বিরূপ পরিস্থিতি তৈরি হবে কি-না এটি নিয়ে একটা শঙ্কার জায়গা তো আছেই। তবে আমরা আশাবাদী থাকতে চাই।”
বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ ও ছাত্র ফেডারেশনের যৌথ প্যানেল ‘রাকসু ফর রেডিক্যাল চেঞ্জ’ মনোনীত সহসভাপতি (ভিপি) প্রার্থী মেহেদী মারুফ বলেন, “প্রথমত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা, সেই ঘটনায় একপাক্ষিক শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, আমরা সেটি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছি। পাশাপাশি রাকসুকে জিম্মি করে আবারও শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যে কর্মবিরতি সেটি তারা শুরু করবেন বলে শুনতে পাচ্ছি। এই অবস্থায় রাকসু নিয়ে যে অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে, আমরা আশা করব, তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে এবং প্রশাসন এক্ষেত্রে যথাযথ দায়িত্বশীল আচরণ করবে।”
নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন
নির্বাচন কমিশন তাদের নির্বাচনি প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে জানিয়ে ১৬ অক্টোবরই নির্বাচনের কথা বলছে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক এফ নজরুল ইসলাম বলেন, “আমাদের সবকিছুই প্রস্তুত আছে। কর্মবিরতি না হলে রাকসুতে কোনো বাধা নেই।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ খান বলেন, “কালকে ক্যাম্পাস খোলার পর আসলে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। রাকসু আমাদের সকলেরই প্রাণের দাবি। আন্দোলনের নামে রাকসুকে জিম্মি করা সঙ্গত হবে না।”
তিনি আরও বলেন, “এই বিষয় নিয়ে সিন্ডিকেটের সভায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং তারা কাজ শুরু করে দিয়েছে। আমরা এটার বিষয়ে আগেও আপিল করেছি। এটা একটি চলমান প্রক্রিয়া। আমরা এই বিষয়ে আন্তরিক এবং আশা করবে তারাও আমাদের সহযোগিতা করবে।”
