মিরপুরে খেলা দেখতে আসা দর্শকদের কণ্ঠে হতাশা আর ক্ষোভ আছে বাংলাদেশ দলের পারফরম্যান্স নিয়ে, পাশাপাশি আছে আবেগ-ভালোবাসাও।
সংগৃহিত
বাংলাদেশ দলের সাম্প্রতিক ওয়ানডে ব্যর্থতা নিয়ে ক্রিকেট অনুসারীদের যে ক্ষোভ আর হতাশার ঢেউ, তা আছড়ে পড়েছে মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামেও। আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ যাচ্ছেতাইভাবে হেরে দেশে ফেরার পর বিমানবন্দরে ক্রিকেটারদের যেমন দুয়ো দিয়েছেন অনেকে, তেমনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে খেলা দেখতে মিরপুরে আসা অনেকের কণ্ঠেও একই সুর। তবে ব্যতিক্রম কম নয়। দুঃসময়েও ওপর বিশ্বাস হারাননি, এমন আছেন অনেকেই।
নরসিংদীর রায়পুরা থেকে একই পরিবারের ছয় সদস্য ভোরে রওনা হয়েছেন মিরপুরের উদ্দেশে। সৌরভ, বাদশা, বিসমিল্লাহ, আলী, সাব্বির ও আবির, দুপুরে দেখা গেল কারও চোখে ক্লান্তি নেই, বরং কন্ঠে বাংলাদেশ দলকে নিয়ে আশার ছোঁয়া।
“দেশ আমার, সাপোর্ট তো করতেই হইব। হারলেও বাংলাদেশ, জিতলেও বাংলাদেশ। এই আশাতেই আসছি। দল হারলে গালি দেওয়া সহজ, কিন্তু পাশে দাঁড়ানোই আসল সাপোর্ট।”
বাদশা একটু ভিন্ন সুরে বললেন, ‘‘বাংলাদেশ হারলে সমালোচনা হইব, কিন্তু সেইটার একটা সীমা আছে। বেশি করলে সেটা ক্ষতি। আমি মনে করি, আমরা নিজেরাই যদি বাংলাদেশের পাশে না থাকি, তাহলে আর কে থাকব? দেশের দল তো নিজের মতোই—ভালো করুক বা খারাপ, ভালোবাসা কমে না।”
তবু হতাশার কথা লুকাতে পারলেন না বাদশা।
“বাংলাদেশ দলে এখন ক্যাপ্টেনের ঘাটতি আছে। কোচেরও সমস্যা আছে। ক্যাপ্টেনরা এখনও বুঝতে পারে না কে কোন জায়গায় খেলবে। এইটা পরিষ্কার না হলে খেলা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। সাইফ তো সেই আগের মতোই—অস্থিরভাবে ব্যাটিং করে, কিন্তু বোলিং ভালো।”
‘‘খারাপ সময়েও পাশে থাকাটাই আসল সাপোর্ট’’
মাদারীপুর থেকে এসেছে তিন ভাই ও এক ভাতিজা—রিপন, কাউসার শেখ, সিয়াম শেখ আর ছোট্ট সামি। গ্যালারির মাঝ বরাবর বসে কাউসার হাসতে হাসতে বললেন, “বাংলাদেশ খারাপ খেলছে ঠিকই, কিন্তু মাঠে না আসলে মন ভরে না। গালাগালি যারা করে, তারা করবেই। নিজের দল হারলে কষ্ট লাগে, কিন্তু তাই বলে দূরে থাকা যায় না। খারাপ সময়েও পাশে থাকাটাই আসল সাপোর্ট।”
“এশিয়া কাপে পাকিস্তানের সঙ্গে যে ম্যাচটা হেরেছি, ওটা টিভিতে দেখে মনটা ভেঙে গিয়েছিল। কিন্তু তাই বলে মাঠে না এসে পারি? দলের পাশে থাকতে হয়, কারণ এই সময়টাই তাদের সবচেয়ে বেশি দরকার।”
সিয়াম শেখ বলেন, “বাংলাদেশের প্রিয় ফরম্যাট ওয়ানডে। অথচ আফগানিস্তানের সঙ্গে একটা ম্যাচও জিততে পারিনি। এটা কষ্ট দেয়। কিন্তু খারাপ সময়ে পাশে না থাকলে ভালো সময়ের আনন্দও ঠিক লাগে না।”
‘‘হারলেও বাংলাদেশ, তাই পাশে থাকব’’
রাজশাহীর ছেলে মোহাম্মদ এনামুল হক এখন সাভারে স্নাতকে পড়ছেন। তিনি এসেছেন একাই। হাতে পতাকা, চোখে প্রত্যাশা, “মিরপুরের রেকর্ড বাংলাদেশের পক্ষে বরাবরই ভালো। বাইরের মাঠে হেরেছে ঠিকই, কিন্তু ঘরের মাঠে সবসময় ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, এবারও পারবে। যত ভুলই হোক, শেষ পর্যন্ত সাপোর্ট করব, কারণ দিনশেষে বাংলাদেশই আমাদের দল।”
তবে ক্রিকেটারদের দায়বদ্ধতা নিয়েও প্রশ্ন তুললেন এনামুল “খেলোয়াড়রা বলে, আমরা এগারো জন সারা দেশের হয়ে খেলি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, হারলে দায় নেবে কে? বেতন তো ওরাই নেয়। দায়ভারও ওদের নিতে হবে। দর্শকদের সমালোচনা অন্যায় না। আসলে এই সমালোচনার মধ্য দিয়েই জবাবদিহিতা আসতে পারে।”
তিনি থেমে আবার বললেন, “এশিয়া কাপে বাজে পারফরম্যান্স, আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৯৩ রানে অলআউট—এসবের পরও যদি দলের ভেতরে আত্মসমালোচনা না হয়, তাহলে সমালোচনা হবেই। দর্শক রাগ করছে, কারণ তারা পরোয়া করে। এটা ঘৃণা নয়, ভালোবাসার এক রূপ।”
‘‘বাংলাদেশের খেলা মানেই মন ভালো হয়ে যায়’’
গ্যালারির শেষ দিকে বসে আছে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র আজান। বয়স ১২, প্রিয় ক্রিকেটার মোস্তাফিজুর রহমান। মুখে বাংলাদেশের পতাকার রঙ, চোখে অদ্ভুত উচ্ছ্বাস। “বাংলাদেশের ম্যাচ হলে মাঠে আসতে ভালো লাগে,” বলল সে স্বতস্ফূর্ত কণ্ঠে।
কিন্তু পরক্ষণেই বড়দের মতো গম্ভীর কণ্ঠে যোগ করল, “আফগানিস্তানের সঙ্গে হেরেছে, খারাপই খেলেছে। টিভিতে দেখেছি, খুব খারাপ লেগেছে। তবুও মনে হয় মাঠে আসি, বাংলাদেশের খেলা দেখি। যতই হারুক, বাংলাদেশ মানেই ভালো লাগে।”
তার কথার সরলতায় যেন ফুটে উঠল সেই অনুভূতি, যা হয়তো গ্যালারির প্রতিটি দর্শকের মনেই ছিল-হতাশা, রাগ, ভালোবাসা, আবেগ, সবকিছুর মিশেল।
