এক মাসের ব্যবধানে কিনে রাখা এক ভরি স্বর্ণের দর বেড়ে গেছে ২০ শতাংশের মতো।
হতে সংগৃহিত
বিশ্বজুড়ে অস্থিরতার মধ্যে নিরাপদ বিনিয়োগের সম্পদ হিসেবে স্বর্ণের দাম বেড়েই চলেছে। বিশ্ববাজারের প্রভাবে দেশেও হু হু করে বাড়ছে দাম, যার প্রভাবে বিক্রি কমেছে স্বর্ণের গয়নার।
বুধবার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো স্বর্ণের সর্বোচ্চ দাম ওঠেছে। আউন্সপ্রতি ৪ হাজার ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
দেশের বাজারে এক মাস আগে অর্থাৎ অগাস্টে এক ভরি স্বর্ণের যে দর ছিল তার থেকে প্রায় ৩৫ হাজার টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে এখন। এক মাসের ব্যবধানে কিনে রাখা এক ভরি স্বর্ণের দর বেড়ে গেছে ২০ শতাংশের মতো।
সোনার গহনা কিনতে এসে দাম শুনে হিমশিম খাচ্ছেন ক্রেতারা। তাদের বর্তমান মূল্যে তালিকা দেখাচ্ছেন বায়তুল মোকারম মার্কেটের এক দোকানি। ছবি: আব্দুল্লাহ আল মমীন
গেল ৩০ অগাস্ট ২২ কারেটের প্রতি গ্রাম স্বর্ণের দর ছিল ১৪ হাজার ৯৪৫ টাকা। সবশেষ বুধবার তা হয় ১৭ হাজার ৯২৭ টাকা। অর্থাৎ প্রতি গ্রামে বেড়েছে ২ হাজার ৯৮২ টাকা বা ১৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ। এতে এক ভরিতে (১১.৬৬৪ গ্রাম) স্বর্ণের দাম বেড়েছে ৩৪ হাজার ৭৮২ টাকা।
স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুধু দেশে নয়, গোটা দুনিয়ার কোথাও কোনো পণ্যের দাম এতটা বাড়েনি। কিন্তু এর কারণ কী?
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশে স্বর্ণ ধরে রাখতে তাদেরও দাম বাড়াতে হয়েছে, না হয় সব স্বর্ণ চলে যাবে সীমান্তের বাইরে অন্য কোনো দেশে।
এমন পরিস্থিতিতে দেশে সার্বিকভাবে স্বর্ণ কেনা-বেচা ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশের মত কমে গেছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
যে কারণে বাড়ছে স্বর্ণের দর
ঐতিহ্যগতভাবে বিশ্বজুড়ে অস্থিতিশীল সময়ে সোনাকে ‘মূল্য সংরক্ষণের’ মাধ্যম হিসেবে দেখা হয়। এবছর এখন পর্যন্ত সোনার দাম বেড়েছে প্রায় ৫৪ শতাংশ, ২০২৪ সালে যা ছিল ২৭ শতাংশ।
বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির পারদ কমে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউিইয়র্ক সুদহার কমিয়ে দেওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছে। এতে ডলারের দরও কমে যাচ্ছে।
মুনাফা ধরে রাখতে কয়েকটি দেশ ফেডারেল রিজার্ভের এই সিদ্ধান্তে স্বর্ণে বিনিয়োগ শুরু করেছে।
ফ্রান্স ও জাপানে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলমান থাকায় বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ সম্পদ হিসেবে সোনার দিকে আকৃষ্ট হচ্ছেন। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ, ইউক্রেইন সংঘাত, ফ্রান্স ও জাপানের রাজনৈতিক অস্থিরতা- এসব কিছুও নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে সোনার চাহিদা বাড়াচ্ছে।
কয়েকটি দেশ ডলারের সঙ্গে স্থানীয় মুদ্রা বিনিময় হার ধরে রাখতে স্বর্ণের মজুতও করে চলছে।
সেই তালিকায় সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রয়েছে চীন। এমনকি প্রতিবেশি দেশ ভারতও স্বর্ণের মজুত বাড়াচেছ। তাতে বাংলাদেশেও স্বর্ণের বার ও গয়না প্রবেশে খরচ বেড়েছে ব্যবসায়ীদের।
উপহার দেওয়ার জন্য সোনার রিং দেখছেন এক ক্রেতা। দাম বাড়ায় সাধ পূরণ কঠিন ঠেকছে তার কাছে। রাজধানীর বায়তুল মোকারম মার্কেট থেকে তোলা। ছবি: আব্দুল্লাহ আল মমীন
বাংলাদেশে ব্যবহৃত স্বর্ণের প্রায় পুরোটাই অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে আসে, যার বেশিরভাগই চোরাই পথে।
এছাড়া কিছু আসে প্রবাসীদের মাধ্যমে শুল্কমুক্ত অবস্থায়। আর কোনো প্রবাসী বেশি পরিমাণে আনতে চাইলে প্রতি ভরিতে ৫ হাজার টাকার শুল্ক পরিশোধ করতে হয়।
চোরাই পথে স্বর্ণ আসার তথ্য দিয়েছেন বাংলাদেশে স্বর্ণের দর ঠিক করে দেওয়া একমাত্র সংগঠন বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস) এর দর নির্ধারণ সংক্রান্ত কমিটির চেয়ারম্যান মাসুদুর রহমান।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমরা তো দ্বিতীয় পর্যায়ের ক্রেতা। আমাদের কাছে কেউ বার নিয়ে আসে বা কেউ পুরাতন গয়না নিয়ে আসে। তা দিয়ে নতুন ডিজাইন বানাই বিক্রি করি।”
দর নির্ধারণ নিয়ে তিনি বলেন, “‘গোল্ড’ হচ্ছে এখন ‘সেকেন্ড কারেন্সি’। ডলারের দাম নাকি কমে যাবে, তাই স্বর্ণ কিনে রাখছে সবাই। এজন্যই দিনকে দিন দাম বেড়ে যাচ্ছে।
“এখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে আমাদের দেশেও বাড়াতে হবে। কারণ হল, এটা না বাড়ালে স্বর্ণ তো দেশে থাকবে না। সব চলে যাবে।”
বিশ্ব বাজারের ডলারের সঙ্গে স্বর্ণের দাম উঠানামার বিষয়টি প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণ করে বাজুস ও পুরান ঢাকার তাঁতী বাজারের একটি দল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাদের একজন বলেছেন, ব্লুমবার্গ, ওর্য়াল্ড গোল্ড কাউন্সিল ও কয়েকটি আন্তর্জাতিক বুলিয়ান এক্সচেঞ্জ প্রতি মূহূর্তে স্বর্ণের দামের সঙ্গে অন্যান্য মুদ্রার বিনিময় হার প্রকাশ করে।
সেই দরের সঙ্গে সমন্বয় করে দেশে স্বর্ণের বাজার দর ঠিক করা হয়। দর নিয়ে বিশৃঙ্খলা এড়াতে সারা দেশের ব্যবসায়ীদের ঠিক করে দেওয়া দরে স্বর্ণ বিক্রির নির্দেশনা দেয় বাজুস।
সংগঠনটির ‘স্টান্ডিং কমিটি অন প্রাইসিং অ্যান্ড প্রাইস মনিটরিং’ এর চেয়ারম্যান মাসুদুর রহমান বলেন, “স্বর্ণের দরে আমাদের হাত নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়লে আমাদেরও বাড়াতে হবে।”
লাফিয়ে লাফিয়ে সোনার দাম বাড়ায় ক্রেতা কমার কথা জানান দোকানিরা। মঙ্গলবার রাজধানীর বায়তুল মোককারম মার্কেটের অনেক সোনার দোকান দেখা যায় ক্রেতা শূন্য। ছবি: আব্দুল্লাহ আল মমীন
বেচাকেনা নিয়ে যা বলছেন ব্যবসায়ীরা
স্বর্ণের বার গলিয়ে ও পুরানো গয়না নতুন করে তৈরির কারিগর সবচেয়ে বেশি পুরান ঢাকার তাঁতী বাজারে। এরপরই বেশি পরিচিত বায়তুল মোকাররম গয়নার বাজার।
এ দুটি বাজার ও গুলশানের কয়েকটি শপিং মল ঘুরে স্বর্ণ কেনা-বেচায় মিশ্র প্রবণতা দেখা গেছে।
এক্ষেত্রে পুরনো ও বেশ পরিচিত দোকানে ক্রেতা সমাগম বেশি দেখা গেছে। অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত দোকানে ক্রেতার উপস্থিতি কোনো কোনো দিন একেবারেই থাকে না বলে ব্যবসায়ীরা বলছেন।
বায়তুল মোকাররম রিয়া জুয়েলার্সের বিক্রয়কর্মী নূরে বুলবুল রনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বেশিরভাগই আসছেন পুরনোটার সঙ্গে আরও কিছুটা যোগ করে নতুন নকশার গয়না গড়িয়ে নিতে। একেবারে নতুন যারা কিনছেন তারা বেশিরভাগই এক ভরি ওজনের কিনছেন।”
ক্রেতা উপস্থিতির বিষয়ে তিনি বলেন, “সার্বিকভাবে বললে, মানুষ আসা কমেছে। আগে ছয় দিনই ব্যবসা করলেও এখন সেভাবে হচ্ছে না। যাদের সামর্থ আছে, তারাই আসছেন। হয়ত মনে করছেন, আরও দাম বাড়বে। তাই কিনতে আসছেন।’’
এ বাজারের আমিন জুয়েলার্সে স্বর্ণের বাউটি (এক ধরনের কানের দুল) কিনতে এসেছিলেন এক নতুন দম্পতি।
পছন্দের নকশার বাউটি খুঁজতে খুঁজতে মিরাজুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলছিলেন, “নতুন বিয়ে করেছি। আগেও গয়না দেওয়া আছে। এখন দাম বেড়ে যাচ্ছে শুনে অন্য খরচ বাদ দিয়ে ছোট গয়না কেনার আব্দার। তাই নিয়ে আসছি, পরে দেখা যাবে।”
দাম বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতাদের অনেকেই আসছেন এরকম ছোট গয়না কিনতে। কানের দুল, আংটি, নাকফুল ও টিকলির দরদাম করতে দেখা গেছে ক্রেতাদের।
আমিন জুয়েলার্সের এ শাখার ব্যবস্থাপক বকুল দেবনাথ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ছয় দিনের দোকানদারিতে কোনোদিন বিক্রি বাড়ে তো, আবার কোনো দিন কমে যায়। সব ভালো-মন্দ নিয়ে আছি।
“তবে, ক্রেতা আমার কমে গেছে ৩০ শতাংশের মতো। এভাবে দাম বাড়তে থাকলে মধ্যবিত্তরা তো কখনোই সোনার জিনিস কিনতে পারবে না।”
বৃহস্পতিবার সবচেয়ে বেশি ক্রেতা পেলেও গত কয়েক মাস ধরে তা নেই বলেছেন ৩৬ বছরে ধরে গয়না বিক্রি করে আসা মোনা জুয়েলার্সের বিক্রয়কর্মী মাহফুজুর রহমান।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “শুক্রবার মানেই কোনো না কোনো ফাংশন, বিয়ে, আত্মীয় স্বজনের বাড়ি যাওয়া। মানুষ চার আনার একটি দুল বা আংটি কেনার জন্য বৃহস্পতিবার দোকানে আসতো। দাম যেভাবে বাড়ছে, এখন দোকান বেশিরভাগ সময়েই ফাঁকা থাকে।”
রাজধানীর বায়তুল মোকারম মার্কেটের জুয়েলার্সে দোকানে টানিয়ে রাখা হয়েছে সোনার নতুন মূল্য তালিকা। ছবি: আব্দুল্লাহ আল মমীন
বায়তুল মোকাররমের গ্রামীণ জুয়েলার্সের স্বত্বাধিকারী জাহিদুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষ নতুন গয়না কিনছে বেশি। পুরনো গয়না বিক্রি কমে গেছে। দিন গেলেই তো দাম বাড়ছে, কে বিক্রি করবে বলেন।
“এখন স্বর্ণের সরবরাহ কমে গেছে। নতুন স্বর্ণের বার আগের মত পাচ্ছি না। দোকান খালি হচ্ছে বেশি, ঢুকছে কম।”
এই স্বর্ণ ব্যবসায়ী বলেন, “আমরা তো আমদানি করি না। বেশি আসে হাতে হাতে। সেখান থেকে বড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে যা পাই, তাই কিনি। দাম তো তারাই ঠিক করে। তারা স্বর্ণের বার বিক্রি করে, আমরা গয়না বানাই। তারা তো বানায় না।”
ঢাকায় যেমন ক্রেতা কমেছে, তেমনি কমেছে সারাদেশেও।
ঢাকার বাইরে ৪০ শতাংশের মতো ক্রেতা কমার ধারণা দিয়ে মাসুদুর রহমান বলেন, “শুধু বাংলাদেশেই না, ভারতেও কমেছে ৩০ শতাংশের মতো।”
বেশিরভাগ স্বর্ণ বৈধভাবে আমদানি না হওয়ায় সারাদেশে স্বর্ণের বাজারের কোনো পরিসংখ্যান সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাজুসের কাছে নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আমদানি দায়ের সবশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনেও স্বর্ণ আমদানি সংক্রান্ত কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।
গুলশানের ওয়ার্ল্ড গোল্ড জুয়েলার্সের স্বত্বাধিকারী মাসুদুর রহমান বলেন, দেশে বছরে ৪০ টন স্বর্ণ ব্যবহার হয় বলে আমাদের কাছে পর্যব্ক্ষেণ রয়েছে। তবে, এর কোনো সঠিক তথ্য নেই কারো কাছে। আমরা ব্যবসা করি, বিক্রির উপর একটা শুল্ক নেয় এনবিআর।”