কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই সম্পদে চীনের কঠোর নিয়ন্ত্রণ থাকায় বিকল্প উৎসের খোঁজ করতে গিয়ে নয়া দিল্লি মিয়ানমারের এই বিদ্রোহীদের দ্বারস্থ হচ্ছে, বলছে একাধিক সূত্র।
হতে সংগৃহীত
শক্তিশালী এক বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সহায়তায় মিয়ানমার থেকে দুর্লভ ভৌত খনিজের নমুনা সংগ্রহে ভারত কাজ করছে বলে বিষয়টি সম্বন্ধে অবগত চারটি সূত্র বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছে।
কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই সম্পদে চীনের কঠোর নিয়ন্ত্রণ থাকায় বিকল্প উৎসের খোঁজ করতে গিয়ে নয়া দিল্লি মিয়ানমারের এই বিদ্রোহীদের দ্বারস্থ হচ্ছে।
ভারতের খনিজ মন্ত্রণালয় রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে উত্তরপূর্ব মিয়ানমারের খনিগুলো থেকে নমুনা সংগ্রহ ও পরিবহনের সম্ভাবনা যাচাই করতে বলেছে বলে তিন ব্যক্তি রয়টার্সকে জানিয়েছেন।
মিয়ানমারের ওই খনিগুলো কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মির (কেআইএ) নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত খনিজ কোম্পানি আইআরইএল এবং গত বছর বাণিজ্যিকভাবে দুর্লভ খনিজের চুম্বক তৈরিতে সরকারি অর্থায়ন পাওয়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মিডওয়েস্ট অ্যাডভান্সড ম্যাটেরিয়ালস মিয়ানমার থেকে নমুনা সংগ্রহের এই আলোচনায় জড়িত বলে জানিয়েছে সূত্রগুলো।
এসব নমুনায় বৈদ্যুতিক গাড়ি ও অত্যাধুনিক সব যন্ত্রপাতিতে ব্যবহার করা যায় এমন চুম্বক তৈরির মতো পর্যাপ্ত ভারি দুর্লভ ভৌত পদার্থ আছে কিনা দেশীয় গবেষণাগারে তা পরীক্ষা করে দেখার আশা করছে নয়া দিল্লি।
গত জুলাই মাসে এক অনলাইন বৈঠকে ভারতের খনিজ মন্ত্রণালয় এই প্রস্তাব তোলে, ওই বৈঠকে আইআরইএল, মিডওয়েস্ট এবং অন্তত আরও একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ছিলেন বলে জানিয়েছে একটি সূত্র।
নয়া দিল্লি সাধারণত রাষ্ট্র বহির্ভূত শক্তির সঙ্গে এ ধরনের আলোচনায় যায় না, সে বিবেচনায় একে ‘বেশ বিরল’ বলছে রয়টার্স।
ভারত যাচাই করতে পারে, এমন নমুনা সংগ্রহে কাচিন বিদ্রোহীরা এরই মধ্যে কাজে নেমে পড়েছে; ভারতে বড় আকারে রপ্তানি সম্ভব কিনা তা খতিয়ে দেখতেও তারা সম্মত হয়েছে বলে কেআইএ-র এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। অন্য সূত্রগুলোর মতো তিনিও নাম-পরিচয় প্রকাশ করতে রাজি হননি।
এ প্রসঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্র ও খনিজ মন্ত্রণালয় রয়টার্সের প্রশ্নের জবাব দেয়নি। আইআরইএল ও মিডওয়েস্টও কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
রয়টার্সের ফোন ও মেসেজে সাড়া দেননি কেআইএ-র মুখপাত্রও।
চীনের দখলে দুর্লভ খনিজ
দুর্লভ খনিজ পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া গেলেও সেগুলোকে চুম্বকে রূপান্তরের প্রযুক্তিতে চীনের প্রায় পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে ভূরাজনৈতিক প্রভাব খাটাতে চীন এই বছর ভারতসহ প্রধান অর্থনীতিগুলোর জন্য প্রক্রিয়াজাত দুর্লভ খনিজ রপ্তানিতে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে।
এদিকে নয়া দিল্লিও তার বিকাশমান অর্থনীতির জন্য এই খনিজের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে মরিয়ে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গত ৩১ আগস্ট জানান, চীনে মিয়ানমারের জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের সঙ্গে বৈঠকে দুর্লভ খনিজ প্রসঙ্গে আলোচনা হয়েছে। যদিও এ নিয়ে আর বিস্তারিত কিছু বলেননি তিনি।
হ্লাইংয়ের বাহিনীর সঙ্গে কাচিন বিদ্রোহীদের লড়াই চলছে।
মিয়ানমারের সঙ্গে দুর্লভ খনিজ নিয়ে ভারতের কোনো চুক্তি এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে আসেনি। এ প্রসঙ্গে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি মিয়ানমারের জান্তাও।
ভারতের এমন বড় আকারের শিল্পকারখানাও নেই, যেখানে দুর্লভ খনিজকে উচ্চ শুদ্ধতায় প্রক্রিয়াজাত করা যায়। এ অভাব মিটিয়ে বাণিজ্যিকভাবে দুর্লভ ভৌত চুম্বকের উৎপাদন শুরু করতে আইআরইএল জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একত্রে কাজ করতে চাইছে বলে গত মাসে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল রয়টার্স।
কেআইএ-র সঙ্গে ভারতের আলোচনা নিয়ে জানতে চাইলে দিল্লির চাহিদা বিষয়ে অবগত ভারতীয় এক কর্মকর্তা বলেছেন, গুরুত্বপূর্ণ খনিজের প্রতি ভারতের আগ্রহ মোটেও কোনো গোপন বিষয় নয়।
“আমরা ব্যবসায়িকভাবে সরাসরি সহযোগিতা বাড়াতে চাই, যাতে বিশ্বের বিভিন্ন উৎস থেকে দুর্লভ খনিজ সংগ্রহ করা যায়,” মিয়ানমারের বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনার প্রসঙ্গ না ছুঁয়েই তিনি এ কথা বলেন।
খনিজ যাচাইয়ে ভারতের আইআরইএল গত ডিসেম্বর কাচিন প্রদেশে একটি দল পাঠিয়েছিল। এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনও মিয়ানমার থেকে দুর্লভ খনিজ সরবরাহ নিয়ে নানান প্রস্তাব শুনছিল, যার মধ্যে একটিতে ভারতের সঙ্গে মিলে কাজ করার কথা ছিল, আগের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল রয়টার্স।
চীনের তিয়ানজিনে সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) সাইডলাইনে মিয়ানমারের জান্তাপ্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ফাইল ছবি। ছবি: রয়টার্স
কেআইএ-র সঙ্গে চীনেরও সুসম্পর্ক আছে, তারা বেইজিংকে দুর্লভ খনিজ সরবরাহও করে, বলছেন সিঙ্গাপুরভিত্তিক স্বতন্ত্র বিশ্লেষক অংশুমান চৌধুরী।
“যদি চীন কেআইএ-এর সঙ্গে খাতির রেখে দুর্লভ খনিজ সংগ্রহ করতে পারে, তাহলে ভারত পিছিয়ে থাকবে কেন? প্রতিযোগিতাই এই সম্পর্ক স্থাপনের প্রেক্ষাপট তৈরি করে দিয়েছে,” বলেছেন ভারত-মিয়ানমার সম্পর্ক বিষয়ক এ বিশ্লেষক।
এ প্রসঙ্গে প্রশ্নের জবাবে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র রয়টার্সকে বলেন, ভারতের সঙ্গে কেআইএ-র কাজ করার সম্ভাবনা বিষয়ে বেইজিং অবগত নয়।
“তবে মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ সেখানে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে চীনের গঠনমূলক ভূমিকাকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্বীকৃতি ও ধন্যবাদ দিয়ে আসছে,” বলেছেন তিনি।
দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির সম্ভাবনা কতটা?
মিয়ানমারের সংখ্যালঘু কাচিন সম্প্রদায়ের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিতে ১৯৬১ সালে কেআইএ গঠিত হয় এবং পরবর্তীতে এটি মিয়ানমারের অন্যতম শক্তিশালী সশস্ত্র গোষ্ঠীতে পরিণত হয়।
সামরিক বাহিনী ২০২১ সালে মিয়ানমারের নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করার পর দেশজুড়ে সৃষ্ট বিদ্রোহের মধ্যে তারা চীন-সমর্থিত জান্তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের অন্যতম দেয়াল হয়ে ওঠে।
গত বছর তারা জান্তা-ঘনিষ্ঠ বাহিনীর কাছ থেকে কাচিন প্রদেশের চিপওয়ে-পাংওয়া খনি এলাকা দখল করে নেয়, ওই এলাকাটি থেকে বিশ্বব্যাপী বিপুল পরিমাণে ডিসপ্রোসিয়াম ও টার্বিয়ামের মতো ভারি দুর্লভ ভৌত পদার্থ যায়।
ছবি: রয়টার্স
যদিও কেআইএ এখনো চীনে খনিজ সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে, তবে ভামো শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে জান্তার সঙ্গে লড়াই, দুই পক্ষের সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়েছে।
সীমান্তে স্থিতিশীলতা নিশ্চিতে বেইজিং মিয়ানমারারের জান্তাকেই তার প্রধান মিত্র মনে করে, যে কারণে তারা কেআইএকে পিছু হটতে চাপও দিচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়ায় কেআইএ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াচ্ছে।
দিল্লির কর্মকর্তারা এ খনিজের সরবরাহ রুট তৈরিতে কেআইএ-এর সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্তে আগ্রহী। যদিও এসব খনিজ দুর্গম ও অনুন্নত পাহাড়ি অঞ্চল পেরিয়ে কীভাবে আনা যাবে, তার লজিস্টিক চ্যালেঞ্জ নিয়ে উদ্বেগও রয়েছে। বর্তমানে এসব খনিজ সড়কপথে সহজেই চীনে পাঠানো যায়।
আইআরইএল এ সংক্রান্ত কিছু আলোচনায় অংশ নিলেও তারা চায় বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান এ খনিজ পরিবহনের দায়িত্ব নিক, বলছে বিষয়টি সম্বন্ধে অবগত তিনটি সূত্র।
ধরা যাক, এসব চ্যালেঞ্জ পেরিয়ে কেআইএ ভারতে খনিজ পাঠাল, কিন্তু এরপরও চীনের সহযোগিতা ছাড়া সেসব খনিজকে প্রক্রিয়াজাত করা বেশ কষ্টসাধ্য হবে, বলছেন বেলজিয়ামের দুর্লভ খনিজ বিশেষজ্ঞ নাবিল মানচেরি।
“তত্ত্বগতভাবে ধরা যাক, ভারত এসব খনিজ পেল, তাহলে তারা সেগুলোকে আলাদা করে ব্যবহারযোগ্য পণ্য বানাতে পারবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য কার্যকর মাত্রায় উৎপাদন করতে তাদের অনেক সময় লাগবে,” বলেছেন তিনি।