গবেষকরা বলছেন, পৃথিবীর ভেতরের এ ব্যবস্থা সব সময়ই পরিবর্তনশীল। ফলে কোথাও চৌম্বক ক্ষেত্র শক্তিশালী হচ্ছে, আবার কোথাও তা দুর্বল হয়ে পড়ছে।
হতে সংগৃহিত
পৃথিবীকে ঘিরে থাকা চৌম্বক ক্ষেত্র আমাদের গ্রহটিকে নানা মহাজাগতিক ক্ষতিকর বিকিরণ থেকে রক্ষা করে। তবে আটলান্টিক মহাসাগরের ওপরের অংশে এ চৌম্বকীয় ঢাল দুর্বল হয়ে পড়ছে বলে সতর্ক করেছেন বিজ্ঞানীরা।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘সাউথ আটলান্টিক অ্যানোমালি’ নামে পরিচিত পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের একটি দুর্বল অংশটি ধীরে ধীরে আরও বড় হচ্ছে, অর্থাৎ পৃথিবীর ঐ অঞ্চলে চৌম্বক ক্ষেত্রের সুরক্ষা কমে যাচ্ছে।
ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থার ‘সোয়ার্ম’ স্যাটেলাইট মিশন থেকে পাওয়া ১১ বছরের নির্ভুল তথ্য বিশ্লেষণ করে গবেষকরা বলছেন, পৃথিবীর দক্ষিণ আমেরিকা ও দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরের উপর বিস্তৃত এ অঞ্চলটির দুর্বলতা ২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ইউরোপ মহাদেশের অর্ধেক আকারের সমান এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে।
পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র অদৃশ্য ঢালের মতো কাজ করে, যা জীবজগৎকে ক্ষতিকর মহাজাগতিক রশ্মি ও সূর্যের বিকিরণ থেকে রক্ষা করে। এই চৌম্বক ক্ষেত্রের উৎস পৃথিবীর প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার ভেতরে, যেখানে গলিত লোহা ঘুরতে ঘুরতে এক ধরনের বিদ্যুৎ প্রবাহ তৈরি করে। সেই বিদ্যুৎ প্রবাহ থেকেই পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র গঠিত হয় বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল নোরিজ।
গবেষকরা বলছেন, পৃথিবীর ভেতরের এ ব্যবস্থা সব সময়ই পরিবর্তনশীল। ফলে কোথাও চৌম্বক ক্ষেত্র শক্তিশালী হচ্ছে, আবার কোথাও তা দুর্বল হয়ে পড়ছে।
২০১৩ সালে উৎক্ষেপিত ‘সোয়ার্ম’ মিশনটি তিনটি একই রকম স্যাটেলাইট নিয়ে গঠিত। এসব স্যাটেলাইট বিজ্ঞানীদেরকে এখন পর্যন্ত মহাকাশ থেকে পাওয়া সবচেয়ে বিস্তারিত ও দীর্ঘমেয়াদি তথ্য দিয়েছে, যেখানে উঠে এসেছে, পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র কীভাবে সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হচ্ছে।
পৃথিবীর কেন্দ্র, ভূত্বক, মহাসাগর ও বায়ুমণ্ডল থেকে আসা বিভিন্ন চৌম্বক সংকেত সংগ্রহ করেছে সোয়ার্ম মিশনের স্যাটেলাইটগুলো। এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন, পৃথিবীর এই সুরক্ষামূলক চৌম্বক ঢালটি সময়ের সঙ্গে কীভাবে বদলে যাচ্ছে।
প্রথমবার ১৯ শতকে চিহ্নিত করা হয়েছিল ‘সাউথ আটলান্টিক অ্যানোমালি’ নামের এই দুর্বল চৌম্বক ক্ষেত্রটি। তবে সাম্প্রতিক সোয়ার্ম স্যাটেলাইটের তথ্যে ইঙ্গিত মিলেছে, এই দুর্বলতা এখন আগের চেয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।
মহাকাশ মিশনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ‘সাউথ আটলান্টিক অ্যানোমালি’। কারণ এ অঞ্চলের মধ্য দিয়ে যাওয়া বিভিন্ন স্যাটেলাইটে শক্তিশালী বিকিরণ পড়ে, যা ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি বিকল, হার্ডওয়্যার ক্ষতিগ্রস্ত বা সাময়িকভাবে স্যাটেলাইটের কাজ বন্ধ করে দিতে পারে।
‘টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অফ ডেনমার্ক’-এর অধ্যাপক ক্রিস ফিনলে বলেছেন, পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র কোথাও বেশি দুর্বল হচ্ছে, আবার কোথাও কম, সব জায়গায় একই রকম নয়।
“সাউথ আটলান্টিক অ্যানোমালি সব জায়গায় একরকম নয়। এটি বিভিন্ন জায়গায় ভিন্নভাবে আচরণ করছে। আফ্রিকার দিকে চৌম্বক ক্ষেত্র অনেক দ্রুত দুর্বল হচ্ছে, যা দক্ষিণ আমেরিকার দিকে তুলনামূলক ধীরে দুর্বল হচ্ছে।”
গবেষকরা বলছেন, পৃথিবীর ভেতরের গলিত লোহার কোর ও পাথুরে ম্যান্টেলের মধ্যে এক জায়গায় চৌম্বক ক্ষেত্রের অস্বাভাবিক চলাচল থাকায় এই দুর্বলতা সব জায়গায় সমান হচ্ছে না।
সাধারণত, চৌম্বক ক্ষেত্রের বিভিন্ন রেখা পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে বাইরে দিকে প্রবাহিত হয়। তবে সাউথ আটলান্টিক অ্যানোমালিতে কিছু রেখা উল্টো হয়ে আবার ভেতরের কোরের দিকে ফিরে যায়।
সোয়র্ম স্যাটেলাইটের তথ্য অনুসারে, এই উল্টো হয়ে যাওয়া চৌম্বক রেখাগুলোর একটি ধীরে ধীরে আফ্রিকার নিচে পশ্চিম দিকে সরছে। ফলে সেখানে চৌম্বক ক্ষেত্র আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে।
যখন দক্ষিণ আটলান্টিকের চৌম্বক ক্ষেত্র দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, আবার অন্য কিছু এলাকায় চৌম্বক ক্ষেত্র ভিন্নভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে।
উত্তর গোলার্ধে চৌম্বক ক্ষেত্র সাইবেরিয়ার ওপর শক্তিশালী হলেও কানাডার ওপর দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলে চৌম্বক উত্তর মেরুর অবস্থান রাশিয়ার দিকে সরে যাচ্ছে। চৌম্বক ক্ষেত্রের এই পরিবর্তন ন্যাভিগেশন পদ্ধতিতে প্রভাব ফেলতে পারে।
এসব পরিবর্তনের পরও বিজ্ঞানীরা জোর দিয়ে বলছেন, পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র ভেঙে পড়ার ঝুঁকি এখনও অনেক দূরে। ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থার সোয়ার্ম মিশনের ম্যানেজার আনজা স্ট্রম বলেছেন, “আমাদের পৃথিবীর গতিশীল হৃদয়ের বড় ছবি দেখাচ্ছে সোয়ার্ম।”
