শাস্ত্র মতে, মানববন্দনা, নারীর সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং ঈশ্বরের আরাধনাই কুমারী পূজার শিক্ষা।
হতে সংগৃহিত
শারদীয় দুর্গোৎসবের অষ্টমী তিথিতে কুমারী রূপে দেবী দুর্গার আরাধনা করলেন বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।
যে ত্রিশক্তিতে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি-স্থিতি ও লয়ের চক্রে আবর্তিত হচ্ছে, সেই শক্তি কুমারীতে বীজ আকারে আছে–এই বিশ্বাসেই বাঙালি হিন্দুরা অষ্টমীতে কুমারীকে দেবীদুর্গা হিসেবে আরাধনা করেন।
শাস্ত্র মতে, মানববন্দনা, নারীর সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং ঈশ্বরের আরাধনাই কুমারী পূজার শিক্ষা।
সাধক রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বহু বছর আগে নিজের স্ত্রী সারদা দেবীকে মাতৃজ্ঞানে যে পূজা করেছিলেন, তারই ধারাবাহিকতায় উপমহাদেশের মিশন ও মঠগুলোতে কুমারী পূজা হয়ে আসছে।
প্রতি বছরের মত এবারও সবচেয়ে বড় পরিসরে এই পূজা হয়েছে ঢাকার গোপীবাগে রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠে।
মঙ্গলবার সকাল থেকেই রামকৃষ্ণ মিশনে বাড়তে থাকে ভক্তদের ভিড়। বেলা সকাল ১১টায় কুমারীকে আনা হয় মণ্ডপে।
ঢাকের বাদ্য, কাঁসার ঘণ্টা, শঙ্খের আওয়াজ আর উলুধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে পূজা প্রাঙ্গণ, চলে ভক্তি গীতি। এছাড়া সকাল থেকেই দেবী দুর্গার আরাধনায় মণ্ডপে মণ্ডপে চলে পূজা আর চণ্ডিপাঠ।
রামকৃষ্ণ মিশনে সকালে পূজার অন্যান্য রীতি পালনের পর বেলা ১১টায় যখন কুমারী পূজা শুরু হয়, তখন মণ্ডপের প্যান্ডেলে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। অব্যবস্থাপনার কারণে কেউ কেউ ঠিকমত পূজা দেখতে পারেননি বলেও অভিযোগ করেন।

মানিকগঞ্জ থেকে পূজা দেখতে আসা ব্রজমোহন দাশ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কুমারী পূজা দেখেতেই সকালে মানিকগঞ্জ থেকে আসছি। মায়ের কাছে জগতের জন্য মঙ্গল কামনা করেছি।”
রামকৃষ্ণ মিশন কর্তৃপক্ষ বলেছে, জায়গার তুলনায় ভক্তদের ভিড় বেশি হওয়ায় জায়গার সঙ্কুলান করা যায়নি।
বেলা ১২টায় অঞ্জলি প্রদান ও প্রসাদ বিতরণের মধ্য দিয়ে রামকৃষ্ণ মিশনে কুমারীপূজার আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়।
রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামী দেবধ্যানানন্দ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সকল নারী জাতিকে সম্মান জানানোর জন্যই আমরা কুমারী পূজা করি। সাধারণত এক থেকে ১৬ বছরের মেয়েরা কুমারী পূজার উপযুক্ত। তবে তাদের অবশ্যই ঋতুমতী হওয়া চলবে না।”
পূজার আগে কুমারীকে স্নান করিয়ে নতুন লাল শাড়ি, গয়না, পায়ে আলতা, ফুলের মালা এবং অলঙ্কারে সাজানো হয় দেবীরূপে। পদ্মফুল হাতে দেবী পূজার আসনে বসার পর মন্ত্রোপাঠ আর স্তুতিতে তার বন্দনা করা হয়।
এবারের পূজায় কুমারী রূপে দেবীর আসনে বসেছিল লাবণ্য চ্যাটার্জি। তার বাবার নাম লিটন চ্যাটার্জি এবং মায়ের নাম বৃষ্টি চ্যাটার্জি। ২০১৯ সালের ১৪ মার্চ জন্মগ্রহণ করা লাবণ্য নীলফামারী ব্রাহ্মণপাড়া সদরের সন্ন্যাসীতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। লাবণ্যের বয়স সাড়ে ৬ বছর।

পূজা শেষে রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী পূর্ণাত্মানন্দজী মহারাজ বলেন, “কুমারী পূজা মাতৃভাবে মূলত ঈশ্বরেরই আরাধনা। কুমারী কন্যাকে জীবন্ত প্রতিমা করে তাতে জগজ্জননীর উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। দুর্গা পূজার অষ্টমী বা নবমীতে সাধারণত পাঁচ থেকে সাত বছরের একজন কুমারীকে প্রতিমার পাশে বসিয়ে দেবীজ্ঞানে পূজা করা হয়।
“দুর্গাজ্ঞানে পূজা করে সকলের মধ্যে মাতৃভাবেরই সঞ্চার করা হয়। প্রায় সর্বজাতীয় কন্যাকেই কুমারীরূপে পূজা করা যেতে পারে। তবে স্বত্ত্বগুণসম্পন্না, শান্ত, পবিত্র, সত্যশীল এসব দৈবী সম্পদের অধিকারিণী কুমারীই জগজ্জননীর প্রতিমারূপে গ্রহণের বিধি আছে। এ পূজা যে কেবল রামকৃষ্ণ মঠই করে থাকে, তা নয়। দুর্গাপূজার অঙ্গরূপে এ পূজা অনেক আগে থেকেই প্রচলিত।”
রোববার ষষ্ঠী তিথিতে মর্ত্যলোকে ঘুম ভেঙেছিল দুর্গার, প্রতিমায় চক্ষুদানের মধ্য দিয়ে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় ত্রিনয়নী দেবীর।
ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরের প্রধান পুরোহিত ধর্মদাশ চট্টোপাধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সপ্তমীতে পূজা দিলে সপ্তজনমের, মানে সাত জনমের পাপ মোচন হয়ে যায়।
“আর অষ্টমীতে ‘অষ্টমঙ্গল লাভ’ করা হয়। নবমীতে ‘পূর্ণপূজা’র পর দশমীতে দেবী ‘অপরাজিতা’ হন। দশমীতে দেবীকে বিদায় জানানোর বেদনাও জেগে ওঠে।”
সনাতন ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী, মহালয়ার দিন ‘কন্যারূপে’ ধরায় আসেন দশভূজা দেবী দুর্গা; বিসর্জনের মধ্য দিয়ে তাকে এক বছরের জন্য বিদায় জানানো হয়। তার এই ‘আগমন ও প্রস্থানের’ মাঝে আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী থেকে দশমী তিথি পর্যন্ত পাঁচ দিন চলে দুর্গোৎসব।

হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, দশভূজা দেবী দুর্গা অসুর বধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ধরায় আসেন। সন্তানদের নিয়ে কয়েকটি দিন পিতার গৃহে কাটিয়ে আবার ফিরে যান দেবালয়ে।
শাস্ত্র বলছে, ত্রেতাযুগে ভগবান রাম তার স্ত্রী সীতাকে উদ্ধার করতে দেবী দুর্গার অকালবোধন করেন। ব্রহ্মার নির্দেশ অনুযায়ী দুর্গার সাহায্যে রাবণ বধ করে সীতাকে উদ্ধার করেন তিনি। দেবীর সেই আগমণের সময়ই দুর্গোৎসব।
রাম শরৎকালে দেবীকে আহ্বান করেছিলেন বলে এ পূজা শারদীয় দুর্গা পূজা নামেও পরিচিত।
এবারের পূজায় কেবল ঢাকাতে গতবারের তুলনায় ৭টি বেড়ে মোট ২৫৯টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আর সারাদেশে মোট মণ্ডপের সংখ্যা ৩৩ হাজার ৩৫৫টি, যা গতবারের তুলনায় প্রায় হাজারখানেক বেশি।

বুধবার সকালে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে হবে দুর্গাদেবীর মহানবমী কল্পারম্ভ ও মহানবমী বিহিত পূজা। সন্ধ্যায় হবে আরতি প্রতিযোগিতা। এদিন সকালে তর্পণে দুর্গার মহাস্নান হবে, ষোড়শ উপচারে পূজা করা হবে। পুষ্প, অর্ঘ্য নিবেদন শেষে দেবীর চরণে পুষ্পাঞ্জলি দেবেন ভক্তরা। কোনো কোনো মণ্ডপে নবমীতে যজ্ঞের আয়োজন হয়। মহানবমীতে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠতে শুরু করে ভক্তদের হৃদয়।
বৃহস্পতিবার বিজয়া দশমীর দিন সকালে হবে দুর্গাদেবীর দশমী বিহিত পূজা ও পূজান্তে দর্পণ বিসর্জন। দুপুর ১২টায় থাকবে স্বেচ্ছায় রক্তদান এবং বিকেল ৩টায় বের হবে বিজয়া শোভাযাত্রা।
বিজয়া দশমীতে একদিকে ‘আনন্দময়ী মাকে’ বিদায় জানানোর পালা, আবার আসন্ন বছর ‘মা’ আবার আসবেন সেই অপেক্ষার শুরু। সেদিন প্রতিমা বিসর্জনের মধ্যদিয়ে শেষ হবে এবারের শারদীয় দুর্গোৎসব।