“দূষণ কমানোর দিক থেকে এটা ভালো; কালো ধোঁয়া নেই, বায়ু দূষণ কম হবে, শব্দ দূষণও কমছে,” বলেন পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জিয়াউল হক।
সংগৃহিত
ঢাকার বনশ্রী থেকে সদরঘাট যেতে রাইডশেয়ারিং অ্যাপে ভাড়া বাড়াতে বাড়াতে ৭০০ টাকাতেও কোনো গাড়ি চালককে রাজি করাতে পারছিলেন না শামীম আহমেদ। ফোনে অনুরোধ, অপেক্ষা, ফের অনুরোধ—সবমিলিয়ে এক ঘণ্টাতেও কাউকে পাওয়া গেল না।
অপেক্ষার এই সময়ে অনেক ইজিবাইক চালকই শামীমকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। একপর্যায়ে দুর্ঘটনার শঙ্কা নিয়েই তিনি চেপে বসলেন ব্যাটারিচালিত এক ইজিবাইকে; ভাড়াও অর্ধেক—মাত্র ৩০০ টাকা।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে শামীম বলছিলেন, “গুলিস্তান থেকে সদরঘাট পর্যন্ত ওইটুকু রাস্তাই যেন চিরস্থায়ী যানজটের এলাকা। জ্বালানি চালিত গাড়ির চালকরা জানেন, এক ঘণ্টার কমে পৌঁছানো সম্ভব না, তাই কেউ যেতে চান না।
“রাজি হলেও ভাড়া চান দ্বিগুণেরও বেশি। কিন্তু ইজিবাইকগুলো তো যাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকে। ভাড়াও কম।”
স্বল্প খরচ, সহজ প্রাপ্যতা আর চলাচলের স্বাধীনতার কারণে গ্রাম থেকে শহর—সবখানেই মানুষ ইজিবাইকে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অভিযোগও—অতিরিক্ত বাহন, অদক্ষ চালক আর লাগামহীন গতিতে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে পথে।
কেবল ইজিবাইকই নয়, দেশের সড়কে এখন দেখা মিলছে বিদ্যুচ্চালিত চার চাকার গাড়ি, দুই ও তিন চাকার সাইকেল, ডেলিভারি বাইকসহ নানা মডেলের চীনা গাড়ি। এর মধ্যে ইজিবাইক ও রিকশা বাদে অন্য যানকে নিবন্ধন দিচ্ছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)।
আর শিল্প মন্ত্রণালয়ের ‘ইলেকট্রিক ভেহিকল শিল্প উন্নয়ন নীতিমালা ২০২৫’-এর খসড়ায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) কর্তৃক নির্ধারিত মান ও টেস্টিং সম্পন্ন করে’ ইজিবাইকের নিবন্ধন দেওয়া হবে।
বর্তমানে দেশে কত সংখ্যক ইজিবাইক রয়েছে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। অবশ্য গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু সংসদে বলেছিলেন, সারাদেশে প্রায় ৪০ লাখ ইজিবাইক চলাচল করছে।
বিদ্যুচ্চালিত মোটরযান একদিকে যেমন মানুষের জীবনযাত্রাকে সহজ করছে; তেমনই জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর মোটরসাইকেল, রিকন্ডিশন কার, সিএনজি অটোরিকশাসহ পুরনো ধাঁচের যানবাহনের ওপর নির্ভরতাও কমছে। সেই সঙ্গে শব্দ দূষণ ও বায়ু দূষণ থেকে নিস্তার মিলছে।
অবশ্য পরিবেশবান্ধব এসব যানবাহনে ব্যবহৃত ব্যাটারির সঠিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে রয়েছে উদ্বেগ। ব্যাটারির ধ্বংসাবশেষ মাটিতে মিশে গিয়ে নতুন ক্ষতি ডেকে আনছে কি না, সেই প্রশ্নও উঠছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জিয়াউল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দূষণ কমানোর দিক থেকে এটা ভালো। কালো ধোঁয়া নেই, বায়ু দূষণ কম হবে। প্লাস শব্দ দূষণও কমছে।
“কিন্তু এসব যানবাহন যদি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে না থাকে, সংখ্যায় যদি বেশি হয়ে যায়; তাহলে ট্রাফিক জ্যাম তৈরি করবে। ট্রাফিক জ্যাম আবার দূষণের কারণ হবে। তরল জ্বালানি নির্ভর গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে থাকলে ধোঁয়া ছড়ায়।”
ব্যাটারির বিষয়ে তিনি বলেন, “মেয়াদোত্তীর্ণ ব্যাটারি সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনার উপায় না থাকলে সেটা নতুন দূষণের কারণ হতে পারে। এখন কিছু রিসাইক্লিং প্রতিষ্ঠান আছে। এগুলোর সংখ্যা বাড়াতে হবে এবং পরিবেশ সম্মত রিসাইক্লিং প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে।
“বিষয়গুলো আমাদের বিবেচনায় আছে। হঠাৎ করে স্রোতের মতো ব্যাটারি চালিত রিকশা চলে এসেছে। সরকার ইলেকট্রিক ভেহিকল নীতিমালা তৈরি করছে। সেখানে ব্যাটারি ব্যবস্থাপনা নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর তার মতামতগুলো দিয়েছে।”
জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর যানবাহন কমছে?
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ বা বিআরটিএর পরিসংখ্যানে গেল দুই বছর ধরে নতুন করে গাড়ির নিবন্ধন কিছুটা কমার চিত্র উঠে আসছে। নিবন্ধনহীন বিদ্যুচ্চালিত গাড়ির আধিক্যের কারণে এমনটি হতে পারে বলে ধারণা করছেন।
বিআরটিএ চেয়ারম্যান আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ৫১৫টি ইলেকট্রিক গাড়ি রেজিস্ট্রেশনের আওতায় এসেছে।”
তবে বেশ কিছু গাড়ি নিবন্ধনের পর্যায়ে রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন কোম্পানির প্রতিনিধিরা। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এখন পায়ে চালিত রিকশা বা ভ্যান হাতে গোনা; বেশিরভাগ দখল ব্যাটারিচালিত বাহনের।
স্বল্প দূরত্বে সামান্য মালামাল পরিবহনের জন্য তিন চাকার দেশীয় ভ্যানগুলো এখন নিজেদের মতো করে ব্যাটারি ও মোটর বসিয়ে নিয়েছে। একই পরিবর্তন দেখা গেছে স্কুল ভ্যান, বিভিন্ন কোম্পানির পণ্য বিপণন ভ্যানসহ অন্যান্য প্রচলিত তিন চাকার বাহনে।
চীনের সুপরিচিত ইলেকট্রিক গাড়ি ব্র্যান্ড বিওয়াইডি গত বছর বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে বিপণন কার্যক্রম শুরু করে। স্বল্প সময়ে তাদের ৫০ লাখ টাকা থেকে এক কোটি টাকারও অধিক মূল্যের তিন ধরনের গাড়ি বেশ সাড়া ফেলেছে বলে কোম্পানির তরফে জানানো হয়েছে।
বিওয়াইডি বাংলাদেশের মার্কেটিং কর্মকর্তা রেজওয়ান রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এক বছর আগে যাত্রা শুরুর পর প্রায় ৩০০ গাড়ি বিপণন হয়েছে। এর অনেকগুলো রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হয়েছে এবং কিছু গাড়ি নিবন্ধনের পর্যায়ে রয়েছে।”
বিআরটিএর প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের ১০ মাসে সারাদেশে নতুন মোটরসাইকেল নেমেছে দুই লাখের কিছু বেশি। যেখানে ২০২০ সালে তিন লাখ ১১ হাজার, ২০২১ সালে তিন লাখ ৭৫ হাজার, ২০২২ সালে ৫ লাখ নতুন মোটর সাইকেল রাস্তায় নেমেছিল। ২০২৩ সালে এসে সংখ্যাটি নেমে যায় ৩ লাখ ১০ হাজারে, পরের বছর ২ লাখ ৬২ হাজারে।
সিএনজিচালিত অটোরিকশার সংখ্যাও কমছে ব্যাপকভাবে, যার দখল নিচ্ছে ব্যাটারি চালিত ইজিবাইক। ২০২০ সালে ১৬ হাজার ৭২৪টি সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিবন্ধন নিয়েছিল। পরের বছর ৯ হাজার, ২০২২ সালে ৭ হাজার সিএনজিচালিত অটোরিকশা সড়কে নেমেছিল।
২০২৩ সালে সরকার নিবন্ধন ফি কমিয়ে পুরনো অটোরিকশা জমা নিয়ে নতুন অটোরিকশার নিবন্ধন দিয়েছিল। সেই বছর ৯ হাজার ২৫৭টি অটোরিকশা নতুন করে নিবন্ধন নিয়েছিল। এর পরের বছর নতুন নিবন্ধন নেয় মাত্র চার হাজার অটো রিকশা। চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে নিবন্ধন নিয়েছে ১৬০০ অটোরিকশা।
একই পরিস্থিতি ডেলিভারি ভ্যান গাড়ির ক্ষেত্রেও। ২০২০ সালে যেখানে ১১৭০টি ডেলিভারি ভ্যানগাড়ি নিবন্ধিত হয়, সেখানে গত বছর নিবন্ধিত হয় ৫২৭টি, তার আগের বছর ৪২৪টি গাড়ি নিবন্ধন হয়েছিল। চলতি বছরের ১০ মাসে মাত্র ৪৯৯টি ডেলিভারি ভ্যান নিবন্ধন নেয়।
বিআরটিএ বলছে, জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর মোটরযান থেকে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কমিয়ে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রোধে বিশ্বজুড়ে বিদ্যুচ্চালিত গাড়ির ব্যবহার বেড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশের কর্মপরিকল্পনা এনডিসি বাস্তবায়নে ২০৩০ সালের মধ্যে ৩৪ লাখ টন কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণের অঙ্গীকার রয়েছে। সেই মোতাবেক এ সময়ের মধ্যে দেশের সড়ক পরিবহন খাতে ব্যবহৃত যানবাহনের ন্যূনতম ৩০ শতাংশকে বিদ্যুচ্চালিত গাড়িতে রূপান্তর প্রয়োজন।
অধিকাংশই ‘মেইড ইন চায়না’
ঢাকাসহ সারাদেশে যেসব ব্যাটারি চালিত নতুন বাহন আসছে, তার বেশিরভাগই চীন থেকে আমদানি করা। কিছু ইজিবাইক চীন থেকে বডি চেসিসসহ এলেও বেশিরভাগ তিন চাকার ইজিবাইকের বডি, চেসিসসহ ৪০ শতাংশ যন্ত্রাংশ বাংলাদেশে তৈরি হয়। এর মধ্যে রয়েছে আল মদিনা ও ডায়না ব্রান্ডের ইজিবাইক।
ঢাকায় বর্তমানে বিওয়াইডি যেমন গাড়ি বেচছে; তেমনই আকিজ, রানার, রিভো, ইজিগো, জিজাজোসহ বিভিন্ন বাংলাদেশি কোম্পানি ই-বাইক নিয়ে এসেছে।
ইজিবাইকের মোটর, ক্যাপাসিটর, হুইল শেভারসহ আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ আসে চীন থেকে; বাকি পণ্যগুলো তৈরি হয় বাংলাদেশের ওয়ার্কশপে।
ঢাকার মুগদা স্টেডিয়াম মার্কেটের চতুর্দিক জুড়ে রয়েছে চীনের তৈরি স্বল্প মাত্রার মোটর, ইজিবাইক ও ই-বাইকের বিপণন কেন্দ্র।
সেখানকার একটি দোকানের ব্যবস্থাপক নবীর উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ইজিবাইকগুলোর বডি তৈরি হয় দেশের বিভিন্ন ওয়ার্কশপে। আর পেছনের চাকার শেভার, মোটরসহ আরও কিছু দাবি যন্ত্রাংশ আসে চীন থেকে।
“এক লাখ ৫ হাজার টাকার একটি ইজিবাইকে অন্তত ৫০ হাজার টাকার যন্ত্রাংশ থাকে চীন থেকে আমদানি করা।”
চীনের তৈরি জিজাজো ব্র্যান্ডের ই-বাইক ও ইজিবাইক বিপণন করে জিজাজো বাংলাদেশ। মুগদা স্টেডিয়ামে জিজাজোর একজন বিক্রয়কর্মী বলেন, চীনে তৈরি ৯ সিটের ইজিবাইক তারা আমদানি করেছেন গত দুই বছর ধরে। প্রায় দুই লাখ টাকা দামের এই বাহনগুলো সরাসরি চীন থেকে তৈরি হয়ে আসায় এর ফিটনেসের কোনো ঝামেলা নেই। ফলে অনেকে ব্যক্তিগত, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে চলাফেরার জন্য গাড়িগুলো কিনে থাকেন।
ইভি এখনও সৌখিন পণ্য?
চীনের চেরি ব্র্যান্ডের বাংলাদেশি পরিবেশক চেরি বাংলাদেশের বিক্রয় ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মুসা খান মনে করেন, বাংলাদেশের জন্য ইলেকট্রিক গাড়ি এখনও সৌখিন পণ্য।
“কোম্পানির সিইও, এমডি, ডিএমডি তাদের দ্বিতীয় বা তৃতীয় অপশন হিসেবে এই গাড়িগুলো কেনে। তাদের আরও ২/৩টা গাড়ি থাকে। মানুষ এখনও হাইব্রিড ও প্লাগ ইন হাইব্রিড গাড়ির ওপর নির্ভর করে আছে। তবে ধীরে ধীরে বাণিজ্যিক চার্জিং স্টেশন বাড়লে বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজারও বড় হবে। এখন আপার মিডল ক্লাসের জন্য এই ইলেকট্রিক গাড়ি। কারণ, একটি ইভি কিনতে কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা লাগে। ভবিষ্যতে মিডলক্লাস গ্রাহকের জন্য এটা চলে আসবে। তখন হয়তো দামও আরও কমে আসবে,” বলেন মুসা খান।
ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় এখন বাণিজ্যিকভাবে ইলেকট্রিক ভেহিকাল (ইভি) বা বিদ্যুচ্চালিত গাড়ির চার্জিং স্টেশন চালু হয়েছে। আবার বাসাবাড়ির পার্কিংয়েও কেউ কেউ চার্জিং সুবিধা স্থাপন করে নিয়েছেন। ব্যাটারির ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী চার্জিং স্টেশনে আধা ঘন্টা থেকে এক ঘণ্টার মধ্যে এসব বাহনের পূর্ণ চার্জ হয়।
মুসা খান বলেন, “সাধারণ গাড়িতে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার মুভিং পার্টস থাকে। সেখানে ইলেকট্রিক গাড়িতে মাত্র ৩০০ মুভিং পার্টস যা অনেক বেশি ঝামেলামুক্ত। তেলের গাড়িতে ভেজাল তেলের কারণে গাড়ির লাইফ টাইম কমে যায়। বাংলাদেশে তেলে সমস্যাও থাকে।
“কিন্তু ইলেকট্রিক গাড়িতে ভেজাল বিদ্যুৎ বলে তো কিছু থাকবে না। ইলেকট্রিক গাড়িগুলোর বিদেশেও ৮ বছর ওয়ারেন্টি, দেশেও ৮ বছর ওয়ারেন্টি।”
চীনের তৈরি চেরি ও বিওয়াইডি ব্র্যান্ডের পাশাপাশি ইউরোপিয়ান লাক্সারি গাড়ি রোলস রয়েস স্পেকট্রা, মার্সেডিজ বেনস জি৫৮০, অডিসহ বিভিন্ন মডেলের ইলেকট্রিক গাড়ি এখন ঢাকার রাস্তায় ঘুরছে।
তবে এসব গাড়ির বেশিরভাগই চীনের তৈরি শক্তিশালী ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যাটারি ব্যবহার করে থাকে। বিওয়াইডি ও ক্যাটল—এই দুটো হচ্ছে চীনের ব্যাটারি ব্র্যান্ড, যা বিশ্বব্যাপী বিপণন হয়ে থাকে। মার্সেডিজ ও ক্যাটল এদের ব্যাটারি ব্যবহার করে।
চেরি বাংলাদেশের কর্মকর্তা মুসা খান বলেন, “বিশ্বব্যাপী ইলেক্ট্রিফিকেশনের হাব হচ্ছে চীন। তারা ব্যাটারি উৎপাদন করে। সেই ব্যাটারি বিশ্বের বিভিন্ন ব্র্যান্ড ও মডেলের গাড়িতে ব্যবহৃত হয়। আমি মনে করি বাংলাদেশে ইভির বাজার উজ্জ্বল। ধীরে ধীরে ব্যাটারি টেকনোলজি এগিয়ে যাচ্ছে। ওয়াটারপ্রুপ, পাংচার প্রুভ গাড়ি বাজারে আসছে। এগুলো ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে।”
জ্বালানিতে কতটা সাশ্রয়?
বিওয়াইডি সিল মডেলের উদাহরণ টেনে কোম্পানির মার্কেটিং কর্মকর্তা রেজওয়ান রহমান বলেন, “এটা এক চার্জে ৫৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত যেতে পারে। ফুল চার্জ করতে ৮২ দশমিক ৫ কিলোওয়াট বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। এভাবে কিছু গাড়ির ৬০ ইউনিট, আবার কিছু গাড়ি ১৮ ইউনিট বিদ্যুতে পূর্ণ চার্জড হয়।
“বর্তমান হিসাব অনুযায়ী চার্জিং স্টেশনে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ২৫ টাকা হিসাব করলে ইলেকট্রিক গাড়িগুলো প্রতি কিলোমিটার যেতে ২ টাকা ৫০ পয়সার মতো খরচ হয়। যেখানে সাধারণ তেলের গাড়িগুলোতে প্রতি কিলোমিটার যেতে খরচ হয় ১৫ টাকার মতো।”
জ্বালানির দাম ছাড়াও নিয়মিত মেরামত ও সিস্টেম লস বিবেচনায় ইলেকট্রিক গাড়িগুলো সব পক্ষের জন্য খুবই লাভজনক বলে দাবি করেন রেজওয়ান।
তার ভাষ্যে, “ইলেকট্রিক গাড়ির যান্ত্রিক দক্ষতা ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ। যেখানে তেলের ইঞ্জিনের দক্ষতা ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। অর্থাৎ ইলেকট্রিক গাড়িতে এনার্জি অপচয় রোধ হয়, আবার খরচও সাশ্রয় হয়।
“ঢাকায় ট্রাফিক জ্যামে তেলের গাড়িগুলো যখন বসে থাকে, তখন প্রচুর তেল অপচয় হয়ে যায়। ইলেকট্রিক গাড়িগুলো বসে থাকলে বাড়তি কোনো খরচ নেই।”
রেজওয়ান বলেন, “বাংলাদেশে এখন জ্বালানি সংকটের এই সময়ে ইলেকট্রিক গাড়ির ভবিষ্যত খুবই উজ্জ্বল বলে আমরা মনে করি। বিওয়াইডির প্রতিটি গাড়ি জলাবদ্ধতার মধ্যেও চলতে পারে। অর্থাৎ ওয়াটারপ্রুফ।
“সুতরাং এই অঞ্চলে ইলেকট্রিক গাড়ি খুবই সহনশীল। তবে এখানে রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে সিসি হিসাব নিকাশের কিছু ধোঁয়াশা রয়েছে। ইলেকট্রিক গাড়ির সিসি হয় না। তাই এটাকে সিসির সঙ্গে তুলনা না করে মোটরের সক্ষমতা অনুযায়ী রেজিস্ট্রেশন ফি নির্ধারণ করতে পারে।”
জনপ্রিয় হচ্ছে ই-বাইক
শহরাঞ্চলের বাসিন্দারা সময় বাঁচাতে ও যানজটের ঝক্কি এড়াতে দিনে দিনে ই-বাইকের দিকে ঝুঁকছে। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও অভ্যস্ত হয়ে উঠছে ই-বাইকে। ব্যাটারি চালিত বাইসাইকেলের পাশাপাশি কিছু ট্রাই সাইকেল ও চার চাকার সাইকেলও রাস্তায় দেখা যাচ্ছে।
গত এক বছর ধরে ঢাকার বিভিন্ন প্রান্তে চীনের তৈরি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নতুন নতুন পরিবেশক দেখা যাচ্ছে। দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে বাজারে রয়েছে আকিজ ও রানার। তারা চীনের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ই-বাইক কখনও নিজেদের নামে, আবার কখনও ব্র্যান্ডের নামে পরিবেশন করছেন।
রানার বাংলাদেশের চিফ কমিউনিকেশন অফিসার ওয়াহিদ মুরাদ বলেন, “রানার অটোমোবাইলস বিগত ৩ বছর ধরে বাংলাদেশে ইয়াদিয়া স্কুটার বাজারজাত করছে। দিন দিন এই ব্র্যান্ডের জনপ্রিয়তা ও ক্রেতা চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিশেষ করে শহরকেন্দ্রিক তরুণ ও নারী ব্যবহারকারীদের মধ্যে।
“ইলেকট্রিক স্কুটার মূলত শহরকেন্দ্রিক গ্রাহকরাই বেশি ব্যবহার করছেন। গ্রামীণ এলাকায় এখনো সচেতনতা পুরোপুরি তৈরি হয়নি, তবে খুব দ্রুতই ইলেকট্রিক যানবাহন সারাদেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।”
ব্যাটারি ও মোটর নির্ভর বাইকগুলো বেশ সাশ্রয়ী দাবি করে তিনি বলেন, “একটি স্কুটারের ব্যাটারি ও মোটর ৫ থেকে ৬ বছর পর্যন্ত উচ্চমানের সার্ভিস দিতে পারে। ইলেকট্রিক স্কুটারে প্রতি কিলোমিটারে গড়ে প্রায় ১৪ পয়সা খরচ হয়, যা পেট্রোল বাইকের তুলনায় অনেক বেশি সাশ্রয়ী।”
রিভো বাংলাদেশের ব্যবস্থাপক (জিটিএম) ফরিদ উদ্দিন বলেন, “২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে যাত্রা শুরুর পর থেকে রিভো ব্র্যান্ডের ই-বাইকের বিক্রি ধাপে ধাপে বাড়ছে। তরল জ্বালানির একটি মোটর সাইকেল যেখানে সারা বছর গড়ে যেখানে ৪০ হাজার টাকার জ্বালানির প্রয়োজন হয়, সেখানে ই-বাইকে ৪ হাজার টাকার বিদ্যুৎ বিলই যথেষ্ট।
“ফলে ইলেকট্রিক বাইকগুলো ৯ থেকে ১২ গুণ খরচ সাশ্রয়ী। যত্ন সহকারে পরিচালনা করলে একটি বাইক ৭ থেকে ১০ বছর সচল রাখা সম্ভব।”
বাহনের আধিক্য
খিলগাঁও এলাকায় কথা হয় ইজিবাইক চালক রজ্জব আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, “ইজিবাইক চালাতে আরাম হলেও এখন গাড়ি বেশি হয়ে যাওয়ায় আয় কমে গেছে।
“এখন বাজার ভালো না। দেড়শ টাকার একটা খেপ মারতে এক দেড় ঘণ্টা সময় লেগে যায়। রিকশা বেশি হয়ে গেছে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও খেপ পাওয়া যায় না।”
নাটোরের বাসিন্দা কাজী শাকিল (৪০) এক সময় পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন। ২০১১ সাল থেকে তিনি চাকরি ছেড়ে নিজের কেনা সিএনজি চালিত অটোরিকশা চালাতে শুরু করেন। গত বছর নিজের সিএনজি চালিত অটোরিকশাটি ভাড়া দিয়ে দেন। ঢাকায় এসে একটি ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা কিনে চালাতে শুরু করেন।
শাকিল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সিএনজির চেয়ে অটোরিকশা সবদিক থেকেই ভালো। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে রাস্তায় গাড়ি বেড়ে গেছে।
“এখন বড়লোকরাও অটোরিকশায় বিনিয়োগ করছে। আর ড্রাইভারদের কোনো প্রশিক্ষণ নেই। যে যেমনে পারছে, রাস্তায় গাড়ি চালাচ্ছে। ফলে এক্সিডেন্টও বেশি হচ্ছে।”
ঢাকার রাস্তায় চলাচলের জন্য বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের একটি দলের নকশা করা ইজিবাইক অনুমোদনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এজন্য প্রচলিত স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন ২০০৯ সংশোধন করা হবে।
তবে এ বাহন মূল সড়কে চলতে না দেওয়ার কথা বলেছেন উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ।
তিনি বলেছেন, বুয়েটের নকশা করা বাহন ঢাকার রাস্তায় চলাচলের অনুমতি দেওয়া হবে, যা চালাতে পারবেন কেবল প্রশিক্ষিত চালকরা। সিটি করপোরেশনের মধ্যে অঞ্চল ধরে রিকশার সংখ্যা ঠিক করে দেওয়া হবে।
