ইকবাল সেন্টার থেকে ব্যাংকটির সব কার্যক্রম সরিয়ে নেওয়ার পদক্ষেপও নিয়েছে ব্যাংকটির বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ।
সংগৃহিত
প্রিমিয়ার ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা ডা. এইচবিএম ইকবালের বিরুদ্ধে ব্যাংকটির বর্তমান চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ‘জীবননাশের’ হুমকি দেওয়ার অভিযোগের পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করতে আদালতের অনুমতি চেয়েছে পুলিশ।
একই সঙ্গে যে ভবনের ভাড়াকে কেন্দ্র করে এ সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে সাবেক সংসদ সদস্য ইকবালের মালিকানাধীন সেই ইকবাল সেন্টার থেকে প্রিমিয়ার ব্যাংকের সব কার্যক্রম সরিয়ে নেওয়ার পদক্ষেপও নিয়েছে ব্যাংকটির বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ।
বনানী থানার ওসি রাসেল সারোয়ার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা গত ১৪ সেপ্টেম্বর একটি অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগটি সাধারণ ডায়েরি হিসেবে নথিভুক্ত করে তদন্তের জন্য একজন এসআইকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এরইমধ্যে আদালতে পূর্ণাঙ্গ তদন্তের জন্য অনুমতি চেয়ে আবেদন করা হয়েছে।”
আদালতের অনুমতি পেলেই পুরো বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে, বলেন তিনি।
বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে ভাড়া পরিশোধ না করলে ফোনে ‘জীবননাশের হুমকি’ দেওয়ার অভিযোগ করে প্রিমিয়ার ব্যাংকের তৎকালীন অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) শাহেদ সেকান্দার ব্যাংকের তরফে গত ১৪ সেপ্টেম্বর বনানী থানায় সাবেক চেয়ারম্যান ইকবালের বিরুদ্ধে জিডি করেন।
জিডিতে অভিযোগ করা হয়, অভিযোগ দায়েরের দুই দিন আগে ১২ সেপ্টেম্বর সকালে এবং রাতে দুই দফা ফোন করে সাবেক চেয়ারম্যান গুলশানের রেনেসাঁ হোটেলে থাকা গুলশান শাখা এবং ইকবাল সেন্টারে থাকা ব্যাংকের কার্যালয়ের ভাড়া পরিশোধ করতে ১৪ সেপ্টেম্বর বিকাল ৫টা পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন।
“এসময়ের মধ্যে না দিলে তিনি হুমকি দিয়ে বলেছেন, ব্যাংকের চেয়ারম্যান আরিফুর রহমান ও এমডি মোহাম্মদ আবু জাফরের সমস্যা হবে। সেই সাথে মোহাম্মদ আবু জাফরের বাড়ি ‘ভ্যানিশ’ করে দেওয়া হবে। তাছাড়া পানি এবং বিদ্যু’ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হবে।”
সাবেক চেয়ারম্যান ও ইকবাল সেন্টারের কর্ণধার ইকবাল পরদিন ১৩ সেপ্টেম্বর শনিবার আবার এএমডি শাহেদকে ফোন করে ১৫ সেপ্টেম্বর সোমবারের মধ্যে ভাড়া পরিশোধ করতে বলেন বলে জিডিতে তুলে ধরা হয়।
অভিযোগে বলা হয়, এ সময়ের মধ্যে ভাড়া পরিশোধ করা না হলে বর্তমান চেয়ারম্যান ও এমডির ‘জীবননাশের হুমকি’ দেন এবং যেকোনো ধরনের ‘সহিংস ঘটনার’ জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেন।
ব্যাংকটির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, প্রিমিয়ার ব্যাংক বর্তমানে এইচবিএম ইকবালের ভবন ইকবাল সেন্টারে আছে। প্রতি মাসে সাড়ে ছয় কোটি টাকা ভাড়া হিসেবে নেন তিনি। নতুন পর্যদ দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক সাবেক চেয়ারম্যান ইকবালের ‘ঋণ কেলেঙ্কারি, নিয়োগে অনিয়মসহ’ বিভিন্ন বিষয়ে তদন্ত করছে।
তিনি বলেন, এ কারণে ইমেজ সংকট তৈরি হওয়ায় নতুন পর্ষদ অতি দ্রুত ইকবাল সেন্টার থেকে প্রিমিয়ার ব্যাংকের সব কার্যক্রম সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এজন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। পাশপাশি এইচবিএম ইকবালের কাছে অর্থ পাওনা থাকায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ভবনের ভাড়াসহ সব কিছুর মাশুল পরিশোধ বন্ধ কর দেয়। এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে ব্যাংকের ওই কমর্কতাকে মোবাইল ফোনে কল করে হুমকি দেন তিনি।
ডা. এইচবিএম ইকবাল।
‘হুমকির’ বিষয়টি ব্যাংকের পর্ষদে তোলার পর ইকবালের বিরুদ্ধে থানায় জিডি করার সিদ্ধান্ত হয় বলে ওই কর্মকর্তা তথ্য দেন।
এ বিষয়ে ডা. ইকবালের পর প্রিমিয়ার ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আসা ডা. আরিফুর রহমান কোনো বক্তব্য দিতে চাননি।
ফোন করা হলে সাড়া মেলেনি এমডি আবু জাফর ও ডিজি করা এএমডি শাহেদের।
অপরদিকে অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে প্রকাশ্যে না থাকা এইচবিএম ইকবালের মোবাইল ফোনে কল ও এসএমএস দেওয়া হয়। তবে তিনি সাড়া দেননি।
গণ অভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ব্যাংক খাতে সংস্কারের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন ব্যাংকের পর্ষদ গঠন করে দেওয়ার সময়কালে নিজে থেকেই সরে দাঁড়ান প্রিমিয়ার ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইকবাল।
প্রায় ২৬ বছর অর্থ্যাৎ ১৯৯৯ সালে প্রিমিয়ার ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পর থেকে চেয়ারম্যান হিসেবে থাকা ডা. ইকবাল নিজে থেকেই স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দেন চলতি বছরের গত ১২ জানুয়ারি। দুদিন পর তা গ্রহণ করা হয়।
সেসময় তার সঙ্গে ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা তার আরেক ছেলে মঈন ইকবালও পদত্যাগ করেন। তিনি কোনো কারণ না দেখিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দেন। পিতা-পুত্র দুজনই পরিচালক হিসেবেও সরে দাঁড়ান।
এরপর তার আরেক ছেলে মোহাম্মাদ ইমরান ইকবালকে চেয়ারম্যান পদে বসানো হয়। ব্যাংকাররা বলছেন, আওয়ামী লীগের সাবেক এই সংসদ সদস্য নিজে সরে গিয়ে কৌশলে পর্ষদে পরিবারের নিয়ন্ত্রণ রাখতে পদত্যাগ করেছিলেন।
এর আট মাস পর গত অগাস্টের শেষের দিকে বেসরকারি খাতের ব্যাংকটির পর্ষদে ‘সুশাসনের ঘাটতি’ থাকাকে কারণ দেখিয়ে তা ভেঙে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মাধ্যমে সাবেক সংসদ সদস্য ইকবালের পরিবার মুক্ত হয় প্রিমিয়ার ব্যাংকের পর্ষদ।
নতুন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয় ইকবালের সময়ে ব্যাংকটির ভাইস-চেয়ারম্যান হিসেবে থাকা ডা. আরিফুর রহমানকে।
এদিকে সরকার পরিবর্তনের পর ইকবালের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
প্রাথমিক অভিযোগের ভিত্তিতে দুদক বলছে, “ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ২০১১ সাল থেকে প্রিমিয়ার ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে থাকার পাশাপাশি গুলশানে হোটেল রেনেসাঁ, গুলশান-২ এ হিলটন হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট, রয়েল ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা নির্মাণ করেছেন।”
এসময়ে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) সদস্যও ছিলেন তিনি।
দুদকের অভিযোগে বলা হয়, সাবেক এই সংসদ সদস্য গত এক যুগে এমন অসংখ্য কোম্পানির মালিক হয়েছেন এবং ওইসব প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পদে থেকে বিপুল সম্পদ অর্জন করেছেন।
এসবের পাশাপাশি প্রিমিয়ার ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকাকালীন ইকবালের সব ধরনের লেনদেন নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
