জেটের আশপাশের বাতাসকে টেনে নিয়ে সেটিকে জোরে চেপে ধরে এই প্লাজমা ইঞ্জিন। তারপর সেটিকে মাইক্রোওয়েভ রেডিয়েশন বা বিকিরণ দিয়ে আঘাত করে।
সংগৃহিত
জেট প্রযুক্তিতে নতুন নতুন উদ্ভাবন সব সময়ই ঘটছে। আধুনিক প্রযুক্তিগত উন্নতির ফলে প্রকৌশলীরা এখন এমন সব নতুন দিকের খোঁজ করছেন, যা আগে কেবল ধারণা হিসেবেই ছিল। এর সর্বশেষ উদাহরণ, চীনে তৈরি প্লাজমা জেট ইঞ্জিন।
এ ‘যুগান্তকারী’ নতুন ইঞ্জিনটি মাইক্রোওয়েভ ও প্লাজমা প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে তৈরি, যার মানে কোনো প্রচলিত জ্বালানি বা ব্যাটারি ছাড়াই কাজ করতে পারে এই ইঞ্জিন।
জেটের আশপাশের বাতাসকে টেনে নিয়ে সেটিকে জোরে চেপে ধরে এই প্লাজমা ইঞ্জিন। তারপর সেটিকে মাইক্রোওয়েভ রেডিয়েশন বা বিকিরণ দিয়ে আঘাত করে। এ ইঞ্জিনে ব্যবহৃত মাইক্রোওয়েভের ফ্রিকোয়েন্সি আসলে বেশ কম, যা প্রায় রান্নাঘরের মাইক্রোওয়েভ ওভেনের সমান মাত্রার বলে প্রতিবেদনে লিখেছে প্রযুক্তি বিষয়ক সাইট স্ল্যাশগিয়ার।
এ রেডিয়েশন যখন বাতাসের সঙ্গে সংস্পর্শে আসে তখন তা প্লাজমায় রূপান্তরিত হয়। প্লাজমা হচ্ছে পদার্থের কঠিন, তরল ও গ্যাসের অবস্থার পরের অবস্থা বা চতুর্থ অবস্থা এবং সঠিকভাবে ব্যবহার করা গেলে অত্যন্ত কার্যকর শক্তির উৎস হতে পারে এটি।
প্লাজমা কেবল এই ইঞ্জিনেই নয়, বরং আরও বড় বড় প্রকল্পেও ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন– বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফিউশন এনার্জি পরীক্ষাগারে ব্যবহৃত হচ্ছে প্লাজমা। কারণ, প্লাজমা জীবাশ্ম জ্বালানি তৈরি করে না। ফলে এই নতুন জেট ইঞ্জিনটি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নয়। ইঞ্জিনটি চলার সময় কোনো রাসায়নিক পদার্থ বা দূষণকারী গ্যাস নির্গত হয় না, যা এখন পর্যন্ত তৈরি হওয়া সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব জেট ইঞ্জিন।
এর বিপরীতে, বর্তমানে ব্যবহৃত বেশিরভাগ জেট ইঞ্জিন অত্যাধিক পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড ছাড়ে। কার্বন ডাই-অক্সাইড কেবল বিষাক্ত গ্যাসই নয়, বরং তা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ, যা বহু বছর ধরে প্লেন শিল্পের জন্য বড় এক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এ নতুন প্লাজমা জেট ইঞ্জিনের বিকাশ ঘটলে তা ভবিষ্যতে এসব সমস্যা কমাতে ভূমিকা রাখতে পারে।
হীরা থেকে জেট ইঞ্জিনের যাত্রা
নতুন প্লাজমা জেট ইঞ্জিনটির ধারণা প্রথমবারের মতো ২০২০ সালে দিয়েছিলেন চীনের ‘উহান ইউনিভার্সিটি’র অধ্যাপক জাও ট্যাং। তবে অধ্যাপক ট্যাং শুরুতে প্লাজমা ইঞ্জিন তৈরির দিকে মনোযোগী ছিলেন না। তিনি মূলত মাইক্রোওয়েভ ব্যবহার করে ‘সিন্থেটিক হীরা’ তৈরির ওপর গবেষণা করছিলেন।
এ গবেষণার মাধ্যমে ‘প্লাজমা থ্রাস্টার’ এর ধারণায় পৌঁছে যান ট্যাং, যা মাইক্রোওয়েভ প্রযুক্তি ব্যবহার করে। তার অনুমান, সঠিক নকশা ও উন্নয়নের মাধ্যমে এই প্রযুক্তি প্রচলিত প্লেন ইঞ্জিনের বিকল্প হয়ে উঠতে পারে। এর ফলে পেট্রোল বা জ্বালানির প্রয়োজন কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
অধ্যাপক ট্যাং-এর প্রোটোটাইপ ইঞ্জিনটি প্রায় ২ পাউন্ড ওজনের স্টিলের বলকে বাতাসে উড়িয়ে রাখতে পারে। শুনতে বড় অগ্রগতির বিষয় মনে না হলেও বাস্তবে তা এমন এক ইঞ্জিনের জন্য এক সূচনা বিন্দু, যা আগামী বছরের জন্য আদর্শ হয়ে উঠতে পারে।
তবে এটি রাতারাতি হবে না। প্লাজমা ইঞ্জিনকে অবশ্যই অনেক বড় আকারের হতে হবে ও মজবুত পাওয়ার সাপ্লাই থাকতে হবে, যাতে শিল্পজুড়ে এর ব্যবহার সম্ভব হয়। সেই পর্যায়ে পৌঁছে গেলেও, ইঞ্জিনটিকে কঠোর পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হবে, যাতে নিশ্চিত হওয়া যায় এটি নিরাপদ ও কার্যকরভাবে কাজ করতে প্রস্তুত।
অধ্যাপক ট্যাংয়ের এ প্রচেষ্টা প্রশংসনীয়, তবে প্লাজমা শক্তির সম্ভাবনা অনুসন্ধান করা প্রথম বিজ্ঞানী তিনি নন। ২০২৫ সালের অক্টোবরে তাদের নিজস্ব এক প্লাজমা ইঞ্জিনের প্রোটোটাইপ উন্মোচন করেছেন রাশিয়ান প্রকৌশলীরা, যা দিয়ে কেবল ৩০ দিনে মঙ্গল গ্রহে পৌঁছানো যেতে পারে।
এদিকে, বর্তমানে পালসড প্লাজমা রকেট নিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা। এর আগে, ২০১৭ সালে জার্মানির একদল গবেষকও প্লাজমা থ্রাস্টার তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন। তবে সেটিকে প্রাথমিক পরীক্ষার ধাপের পর আর এগিয়ে নিতে পারেননি তারা।
