নিয়ন্ত্রিত নয় বরং মুক্ত ক্যাম্পাসের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হওয়ার আশা নিয়ে রাত পোহালেই ভোট দেবেন ২৭ হাজারের বেশি ছাত্র-ছাত্রী।
হতে সংগ্রহীত
শেষবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচনের পর পেরিয়ে গেছে ৩৫ বছর। এই দীর্ঘ সময়ে দেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে সাতটি, কিন্তু চাকসু নির্বাচন আর হয়নি।
ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে রাজনৈতি পটপরিবর্তনের পর নতুন এক বাস্তবতায় অবশেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের নেতৃত্ব নির্বাচনে শিক্ষার্থীদের অপেক্ষা শেষ হচ্ছে বুধবার।
চট্টগ্রাম শহর থেকে দূরে পাহাড় ঘেরা ক্যাম্পাসে রাত পোহালেই বহুল প্রতীক্ষিত ভোট উৎসবে মেতে উঠবেন শিক্ষার্থীরা, যার সব আয়োজন শেষ করে এনেছে ভোটের জন্য গঠিত নির্বাচন কমিশন।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের তরফে নিরাপত্তার সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
সপ্তম চাকসু নির্বাচন দিয়ে জীবনে প্রথমবারের মত ভোট দেওয়ার অভিজ্ঞতা হবে অনেক শিক্ষার্থীর। এবারই প্রথম ওএমআর ব্যালটে হবে চাকসুর ভোট। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্যও থাকছে পৃথক কেন্দ্রে ভোট দেওয়ার সুযোগ।
জাতীয় নির্বাচনের মতো থাকছে স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স, আর ওএমআর মেশিনে ভোট গণনাও প্রথম। ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রদর্শনের ব্যবস্থাও করেছে প্রশাসন।
সাড়ে তিন দশকে বদলে গেছে অনেক কিছুই। এবারই প্রথম চাকসু ও হল সংসদগুলোর নির্বাচনের প্রচারে দেয়াল লিখন বা ব্যানার-পোস্টার ছিল না। প্রচারপত্র ছাড়াও সব প্রার্থীই প্রথমবার প্রচারের জন্য নির্ভর করেছেন ডিজিটাল মাধ্যমের ওপর, সাথে যোগ হয়েছে নাটক, গান, নাচসহ নানা সৃষ্টিশীল আয়োজন।
গত বছরের ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এবারই প্রথম দলটির ‘নিষিদ্ধ ঘোষিত’ ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের অংশগ্রহণ ছাড়াই হতে চলেছে চাকসু ভোট।
চট্টগ্রাম নগরী থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে হাটহাজারী উপজেলায় বিশ্ববিদ্যালয়টির অনেক কিছু বদলালেও আগের রূপেই আছে ঐতিহ্যবাহী শাটল ট্রেন। শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হয়ে থাকা এই ট্রেনও চাকসু নির্বাচনের ভোট গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ।
ভোটের দিন শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে আসা যাওয়া সহজ করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিশেষ ট্রেনেরও ব্যবস্থা করেছে। বাসের সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, তাদের সব প্রস্তুতি শেষ। পালা এখন ভোটের। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে সুন্দর ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনই আশা করছে।
যে কোনো ধরনের ভোট হলেই থাকে প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি। চাকসুতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। পূর্ণাঙ্গ ও আংশিক মিলিয়ে ১৩টি প্যানেলে কয়েক ছাত্র ও সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিশ্রুতির ডালি মেলে ধরেছে শিক্ষার্থীদের সামনে। এখন শিক্ষার্থীদের পালা প্রায় তিন যুগ পর চাকসুতে নাজিম উদ্দিন ও আজিম উদ্দিন আহমেদের উত্তরসূরি বেছে নেওয়ার।
তবে ছাত্র-ছাত্রীদের মূল চাওয়া আবাসন সংকট নিরসনে উদ্যোগ নেওয়া, হলকে ছাত্র সংগঠনের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করা, যাতায়াতের সমস্যা সমাধান, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, গবেষণা ও উচ্চ শিক্ষার সুযোগ বাড়ানো, সব শিক্ষার্থীর জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির মত বিষয়গুলো।
নতুন সময়ের ‘প্রথম ভোটাররা’ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ভোটের পর ‘তথাকথিত নেতা’ দেখতে আগ্রহী নন বলেও জানিয়েছেন। তারা চান শিক্ষার্থীদের একজন হয়ে তাদের পাশে থেকেই নেতৃত্ব দেবেন তাদেরই নির্বাচিত প্রতিনিধিরা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাওয়া, বহুল কাঙ্ক্ষিত এই ভোটে এমন চাকসু গঠন হবে যাতে করে হলগুলোতে ছাত্র সংগঠনের দখলদারিত্বের অবসান ঘটবে। নিয়ন্ত্রিত নয় বরং মুক্ত ক্যাম্পাসের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হওয়ার আশা নিয়ে রাত পোহালেই ভোট দেবেন ২৭ হাজারের বেশি ছাত্র-ছাত্রী।
সোমবার মধ্যরাতে শেষ হয়েছে ১৮ দিনের প্রচার। এ সময় বিভিন্ন প্যানেলের প্রার্থীদের একে অপরের বিরুদ্ধে বড় কোনো অভিযোগ না করলেও ছাত্রশিবির ও ছাত্রদল একে অপরের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের কয়েকটি অভিযোগ আনে। তবে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।
সে কারণে নিরাপত্তা ঝুঁকির শঙ্কা দেখছে না র্যাব। তারা বলছে, বাইরের ইন্ধন না থাকলে চাকসু ভোট নিয়ে কোনো ‘হুমকি নেই’।
চাকসু নির্বাচন কমিশনের সদস্য সচিব এ কে এম আরিফুল হক সিদ্দিকী সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন পর্যন্ত সার্বিক পরিবেশ ভালো। শেষ মূহূর্তের যে সমস্ত টুকিটাকি কাজ থাকে, সেগুলো চলছে।”
তিনি বলেন, “নির্বাচন সম্পর্কিত বড় কাজগুলো ইতোমধ্যে হয়ে গেছে। ব্যালট বাক্স, ব্যালট পেপারসহ যা-যা প্রস্তুতি আছে, সেগুলোও সম্পন্ন হয়ে গেছে।”
র্যাব-৭ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল হাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর হোসেন শহীদ সরওয়ার্দী এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মনির উদ্দিনের সঙ্গে দেখা করেছে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিজেদের প্রস্তুতি তুলে ধরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পুলিশ, এপিবিএন প্রচুর পরিমাণে নিয়োজিত থাকবে এবং আমাদের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের কমপক্ষে আটটি টহল দল সবসময় থাকবে। অতিরিক্ত রিজার্ভ ফোর্স আমরা রাখব, প্রয়োজন হলে তারাও আসবে।
“এছাড়াও আমাদের সাদা পোশাকে বেশ কিছু গোয়েন্দা সংস্থা থাকবে, গোয়েন্দার লোকজন থাকবে।”
লেফটেন্যান্ট কর্নেল হাফিজুর বলেন, “শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে কোনো হুমকি নেই। শুধু বাইরে থেকে ইন্ধন না এলে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা যাবে।”
ভোট উৎসবের জন্য উন্মুক্ত শিক্ষার্থীরা
জাতীয় পর্যায়ে ভোটার হলেও যারা কোনো ধরনের ভোট অতীতে দেননি, সবশেষ চাকসু নির্বাচনও তাদের জন্মের অনেক আগেই হয়েছে, তারা অনেক প্রথমের চাকসু নির্বাচনে প্রথমবার ভোট দেওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন।
রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আজিমুল সাকিব সজীব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভর্তি হওয়ার তিন মাসের মধ্যেই চাকসু নির্বাচন পাচ্ছি। এটি আমার জন্য যে কোনো ধরনের প্রথম ভোট। সেজন্য এটা নিয়ে আমার আশাও অনেক বেশি। সচেতনভাবেই ভোট দিতে যাব।”
দর্শন বিভাগের ২০২৪-২৫ শিক্ষা বর্ষের ছাত্র তৈমুল হাসিব বলেন, “প্রথমবারের মতো ভোটার হলেও গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে পারিনি। গত বছরের ৫ অগাস্টের পরে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে চাকসুতে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছি। এটা আমার জন্য বিরাট পাওয়া। প্রথমবার ভোট দেওয়ার আনন্দই অন্যরকম।”
তিনি বলেন, “চাকসুতে যারা নির্বাচিত হয়ে আসবেন, তাদের কাছে আমাদের অনেক চাওয়া। শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হিসেবে তারা আমাদের বিভিন্ন সংকটের কথা প্রশাসনের কাছে তুলে ধরবেন।
“র্দীঘদিন ধরে নির্বাচন হয়নি। প্রথমবারে এসে হয়তো তারা তেমন কিছুই করতে পারবেন না। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অন্তত পরিবর্তনের ধারা হলেও সূচিত হবে।”
চারুকলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী স্নেহার মতে, অনেক বছর পর চাকসু নির্বাচন হচ্ছে, আবার অনেকেই প্রথমবারের মতো ভোট দেবেন, এটা শিক্ষার্থীদের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে।
“আমরা উৎসবমুখর পরিবেশে আমাদের অধিকারের কথা বলার মত প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য ভোট দেব।”
নিরাপদ পরিবেশে ভোট হবে, এমন প্রত্যাশার কথা তুলে ধরে স্নেহা বলেন, “র্দীঘদিন ধরে প্রার্থীরা সম্প্রীতির পরিবেশে ভোটের প্রচার করেছেন, নির্বাচনও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে হবে আশা করা যায়।”
ভোটার উপস্থিতি নিয়ে যে কারণে শঙ্কা
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে মোট শিক্ষার্থীর ২৫ থেকে ২৭ শতাংশ শিক্ষার্থী থাকতে পারেন। এর বাইরের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন মেসে ও কটেজে অবস্থান করেন। তবে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর বসবাস ক্যাম্পাস থেকে ২২ কিলোমিটার দূরের শহরে। চারুকলা ইনন্টিটিউটের শিক্ষার্থীদের জন্য নির্ধারিত শিল্পী রশিদ চৌধুরী ছাত্র হোস্টেলটির অবস্থানও নগরীতে।
এসব ভাবনা থেকে শিক্ষার্থীদের ভোট কেন্দ্রে আনতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে নানা ধরনের উদ্যোগ। তবে প্রার্থীদের কেউ কেউ খুব বেশি ভোটারের উপস্থিতি নিয়ে সংশয়ও প্রকাশ করেছেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক হোসেন শহীদ সরওয়ার্দী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শিক্ষার্থীরা যেন তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে, সে জায়গা থেকে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। কেমন ভোটার উপস্থিতি হতে পারে, সেটা নির্দিষ্ট করে বলতে পারব না। তবে আমাদের পরিশ্রমকে যদি শিক্ষার্থীরা মূল্যায়ন করে, আমি আশাবাদী শতভাগ শিক্ষার্থী ভোট দিতে আসবেন।”
ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সম্প্রতির ঐক্য জোটের ভিপি প্রার্থী ইব্রাহীম রনি মনে করেন, দূরত্বের কারণে ভোটার উপস্থিতিতে একটা প্রভাব পড়তে পারে।
ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের জিএস প্রার্থী মো. শাফায়াত হোসেনও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নিয়ে আশঙ্কার কথা বলেছেন।
“তবুও আমরা আশা করি, যারা উপস্থিত আছেন তাদের ৭০ শতাংশ ভোট দিতে আসবেন,” যোগ করেন তিনি।
কার প্রতিদ্বন্দ্বী কে
এবারের চাকসু নির্বাচনে আংশিক ও পূর্ণাঙ্গ মিলিয়ে ১৩টি প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। এর মধ্যে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল নিজেদের নামে প্যানেল দিলেও ইসলামী ছাত্রশিবির ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’ নামে প্যানেলে নির্বাচন করছে।
এছাড়া ছাত্র ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট ‘দ্রোহ পর্ষদ‘ নামে প্যানেল দিয়ে চাকসুতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।
এছাড়া কয়েকটি বাম ছাত্র সংগঠন ও সাংস্কৃতিক সংগঠন মিলিয়ে ‘বৈচিত্র্যের ঐক্য’ প্যানেলে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে।
চাকসুতে ভিপি পদে ২৪ এবং জিএস পদে ২২ জন ভোট করছেন।
মূল পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারীদের মধ্যে একজন মাত্র নারী প্রার্থী হলেন চৌধুরী তাসনিম জাহান শ্রাবণ। তিনি স্টুডেন্ট অ্যালায়েন্স ফর ডেমোক্রেসি-স্যাড ও ছাত্র ফেডারেশনের ‘বিনির্মাণ শিক্ষার্থী ঐক্য’ প্যানেল থেকে জিএস পদে লড়ছেন। এ প্যানেলে ভিপি পদে ভোট করছেন আবির বিন জাবেদ।
১৯৮১ সালে পঞ্চম চাকসুর নির্বাচনে ভিপি ও জিএস পদে নির্বাচিত হন ছাত্রশিবিরের সেসময়ের নেতা জসিম উদ্দিন সরকার ও আবদুল গাফফার। ৪৪ বছর পর আবার চাকসুর নেতৃত্বে আসার লড়াইয়ে নেমেছেন সংগঠনটি সমর্থিত ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট‘ প্যানেলের ইব্রাহীম হোসেন রনি ও সাঈদ বিন হাবিব।
ছাত্রদলের প্যানেলে ভিপি ও জিএস পদে লড়ছেন যথাক্রমে সাজ্জাদ হোসেন হৃদয় ও মো. শাফায়াত হোসেন।
‘বৈচিত্র্যের ঐক্য’ প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে ধ্রুব বড়ুয়া ও সুদর্শন চাকমার নেতৃত্বে।
‘দ্রোহ পর্ষদ’ প্যানেল থেকে ভিপি পদে ঋজু লক্ষী অবরোধ ও জিএস পদে লড়ছেন ইফাজ উদ্দিন ইমু।
স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী প্যানেলে ভিপি পদে মাহফুজুর রহমান ও জিএস পদে রশিদ দিনার ভোট করছেন।
ছাত্র অধিকার পরিষদ ও ইসলামী ছাত্র মজলিসের ‘সর্বজনীন শিক্ষার্থী সংসদ’ এর ভিপি পদপ্রার্থী তামজিদ উদ্দিন ও জিএস পদপ্রার্থী সাকিব মাহমুদ রুমি।
ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের ‘সচেতন শিক্ষার্থী সংসদ’ প্যানেল লড়ছে আবদুর রহমান রবিন ও মোহাম্মদ আবদুর রহমানের নেতৃত্বে।
‘সর্বজনীন শিক্ষার্থী ঐক্য পরিষদ’ এর ভিপি পদপ্রার্থী সাইদ মো. রেদওয়ান ও জিএস পদপ্রার্থী জিহাদ আরাফাত।
‘সার্বভৌম শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেল’ থেকে ভিপি প্রার্থী তাওসিফ মুত্তাকি চৌধুরী ও জিএস প্রার্থী মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসাইন।
সুফিপন্থি শিক্ষার্থীদের ‘অহিংস শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেল’ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে ফরহাদুল ইসলাম ও ইয়াসিন উদ্দিন সাকিবের নেতৃত্বে।
বিশ্ব ইনসানিয়াত বিপ্লব স্টুডেন্ট ফ্রন্টের ‘রেভ্যুলেশন ফর স্টেট অব হিউম্যানিটি’ প্যানেলে ভিপি পদে কেফায়াত উল্লাহ ও জিএস পদে শাহরিয়ার উল্লাহ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
এসব প্যানেলের মধ্যে মূলত ছাত্র শিবিরের ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট‘ এবং ছাত্রদলের প্যানেলের প্রার্থীদের প্রচার ছিল উল্লেখযোগ্য। সরাসরি প্রচার চালানোর বাইরে তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশি সক্রিয় দেখা গেছে।
এদের বাইরে বামপন্থী ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের ‘বৈচিত্র্যের ঐক্য‘ প্যানেলের প্রচার ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রচার মাঠে দেখা মিলেছে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট ও ছাত্র ইউনিয়নের ‘দ্রোহ পর্ষদ’ প্যানেলের।
ছাত্রদলের জিএস পদপ্রার্থী শাফায়াত হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা শিক্ষার্থীদের কাছে গিয়েছি, তাদের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছি। প্রশাসন নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড রাখবে, এটাই প্রত্যাশা।”
ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের ভিপি পদপ্রার্থী ইব্রাহীম হোসেন রানা বলেন, “চমৎকার পরিবেশে ভোটের প্রচার শেষ হয়েছে। আশা করছি বুধবার ভালো ভোট হবে। প্রশাসন নির্বাচনের দিন সবার জন্য সমান পরিবেশ তৈরি করবে এবং নিরপেক্ষ থাকবে।”
সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলছেন, তাদের অধিকার নিয়ে কারা বেশি কথা বলছেন, কাদের পাশে পাওয়া যাবে তাদের প্রতিশ্রুতিসহ সবকিছু বিবেচনা করেই ভোট দেবেন তারা।
তারা মনে করছেন, নির্বাচনি প্রচারে বিভিন্ন প্যানেল থাকলেও ছাত্রশিবির ও ছাত্রদলের প্রার্থীরা অন্যদের চেয়ে এগিয়ে ছিল। বাম ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর ‘বৈচিত্র্যের ঐক্য‘ প্যানেলও ছিল সরব। তবে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের বেশিরভাগ পদে লড়াই হতে পারে মূলত ছাত্রশিবির ও ছাত্রদলের প্রার্থীদের মধ্যেই।
দর্শন বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী তৈমুল হাসিব বলেন, “ভোট ভালো হবে। নির্বাচনে শিবির ও ছাত্রদলের প্রার্থীদের মধ্যে মূল লড়াই হবে বলে মনে করছি।”
বৈচিত্র্যের ঐক্য প্যানেল থেকে ভিপি পদপ্রার্থী ধ্রুব বড়ুয়া বলেন, “আমরা বিভিন্ন যৌক্তিক দাবি নিয়ে ক্যাম্পাসে আন্দোলন করেছি। সাধারণ শিক্ষার্থীরা আমাদের পাশে থাকবে,
এ প্রত্যাশা আছে।”
ভোটগ্রহণ ও গণনা যেভাবে
চাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের প্রতিটি কেন্দ্র ও ভোট কক্ষে সিসি ক্যামেরা থাকছে।
নির্বাচনকে সামনে রেখে ব্যালট পেপার ছাপানোসহ সকল প্রস্তুতি ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে বুধবার সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত টানা ভোট গ্রহণ চলবে। ক্যাম্পাসের আইটি ভবন, নতুন কলা ভবন, বিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান ও বাণিজ্য (বিবিএ) অনুষদ ভবনে ভোট নেওয়া হবে।
পাঁচটি ভবনের ৬০টি কক্ষে প্রায় ৭০০টি বুথে ভোট নেওয়া হবে। প্রতিটি কক্ষে গড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ জন শিক্ষার্থী ভোট দেবেন। ভোট দেওয়ার সময় হিসেব করে পর্যাপ্ত সংখ্যক গোপন কক্ষ (বুথ) তৈরি করা হয়েছে।
রোববার এক বৈঠকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মনির উদ্দিন বলেন, চাকসুর মোট ব্যালট পেপার চার পৃষ্ঠার। হল ও হোস্টেল সংসদের ব্যালট পেপার এক পৃষ্ঠার। ব্যালটে প্রার্থীর নাম ও ব্যালট নম্বর থাকবে। বৃত্ত ভরাট করে ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থীদের ভোট দেবেন।
ফল গণনার বিষয়ে তিনি বলেন, “ভোট গণনার স্ক্যানিং হবে ইমেজ আকারে। সেই ইমেজকে দুইটা প্যারালাল স্ক্যানিং করা হবে। নির্বাচনে দায়িত্ব প্রাপ্তরা ভোট গণনা করবেন, তাদের বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইটি সেলের প্রোগ্রামার আলাদাভাবে গণনা করবেন। দুইটি মিলে গেলে আমরা ভোটের ফল প্রকাশ করব।”
চাকসু ভোটের তথ্য
এবারে চাকসু নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা ২৭ হাজার ৫১৬। এর মধ্যে ছাত্রীর সংখ্যা ১১ হাজার ৩২৯ এবং ছাত্র ভোট ১৬ হাজার ১৮৭।
চাকসু ছাড়াও ১৪ টি হল ও একটি হোস্টেলে নির্বাচন হবে।
চাকসু ভোটের প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মনির উদ্দিন জানান, প্রতিটি শিক্ষার্থী চাকসুতে (কেন্দ্রীয় সংসদে) ২৬টি এবং হল সংসদে ১৪টি ভোট দেবেন। তবে একটি হোস্টেলের নির্বাচনে ভোট দেবে ১০টি।
এবারে চাকসুতে ভিপি, জিএসসহ মোট ২৬টি পদের বিপরীতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৪১৫ প্রার্থী। এর মধ্যে পুরষ প্রার্থী ৩৪৮ জন এবং নারী প্রার্থী ৪৭ জন।
১৪টি হল ও একটি হোস্টেলের সংসদ নির্বাচনে ২০৬ পদে প্রার্থী হয়েছেন ৪৯৩ জন। নয় ছাত্র হলে মোট প্রার্থী ৩৫০ জন, পাঁচ ছাত্রী হলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১২৩ জন।
চলাচলে বিধিনিষেধ
চাকসু নির্বাচনকে সামনে রেখে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এর অংশ হিসেবে ভোটের আগের দিন মঙ্গলবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে প্রশাসন।
এই সময় সকল শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং দ্বিতীয় বর্ষ থেকে স্মাতোকোত্তর শিক্ষার্থীদের পরিচয়পত্র এবং প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ভর্তি রশিদ সঙ্গে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
চাকসু ভোটকে সামনে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক হোসেন শহীদ সরওয়ার্দী এসব নির্দেশনার কথা বলেছেন।
নির্বাচন ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রবেশের ছোট বড় মোট ৩৩টি পথ আছে। যেগুলোর মধ্যে সাতটি পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রবেশের যেসব স্থান উন্মুক্ত থাকবে, সেখানে প্রবেশের ক্ষেত্রে পরিচয়পত্রের প্রয়োজন হবে।
হল, কটেজ ও আবাসিক এলাকার বাইরে ২৪টি স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে, যেখানে পুলিশ ও এপিবিএনের পাশাপাশি বিজিবিও মোতায়েন থাকবে। ভোটের দিন বহিরাগত কেউ যাতে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে না পারে, তা নিশ্চিত করার ওপর জোর দিচ্ছে প্রশাসন।
রোববার সাংবাদিক বৈঠকে প্রক্টর বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাটা পাহাড়, শহীদ মিনার মোড়, প্রীতিলতা হল মোড়, জীব বিজ্ঞান অনুষদ ভবন ও গোডাউন এলাকায় এ পাঁচটি স্থানে কার্ডধারী শিক্ষার্থীদের জন্য সুনির্দিষ্ট লেইন করা হয়েছে। এ লেইন অতিক্রম করার পর শিক্ষার্থীদের সরাসরি কেন্দ্রে প্রবেশ করতে হবে।
ভোট কেন্দ্রের পাঁচটি ভবনের জন্য একজন করে সহাকারী প্রক্টরের নেতৃত্বে শিক্ষক, নিরাপত্তাকর্মীদের সমন্বয়ে ৬০ সদস্যের একটি নিরাপত্তা দল থাকবে।
চাকসু নির্বাচনের পূর্বাপর
গেল ২৮ অগাস্ট চাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। এরপর ১ সেপ্টেম্বর খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশের পর যাচাই-বাছাই শেষে ১১ সেপ্টেম্বর চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হয়।
একই মাসের ১৪ তারিখ শুরু হয় মনোনয়নপত্র বিতরণ; যা শেষ হয় ১৭ সেপ্টেম্বর। এরপর যাচাই-বাছাই শেষে ২১ সেপ্টেম্বর প্রার্থীদের প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করা হয়।
সেপ্টেম্বরের ২৫ তারিখ প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হয়। এরপর নির্বাচনের জন্য ১২ অক্টোবর দিন ঠিক করা হলেও পরে শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে সেটি পিছিয়ে ১৫ অক্টোবর করা হয়।
