কাজের ধরন যেমন ঘুমের সমস্যা তৈরি করে তেমনি পরিত্রাণের রয়েছে উপায়।
হতে সংগৃহিত
আমরা প্রায়ই বলি ‘অফিসের কাজ অফিসেই শেষ করা উচিত’। তবে বাস্তবতা হল, কাজের চাপ অনেক সময় অফিস ছাড়িয়ে ঘুমের ঘরে পৌঁছে যায়।
গভীর রাতে ই-মেইলের উত্তর দেওয়া, পরদিন সকালের মিটিংয়ের চিন্তা, কিংবা অনিয়মিত কাজের সময়সূচি, সবকিছু মিলিয়ে ঘুমের গুণগত মান কমে যায়।
সম্প্রতি ‘জার্নাল অব অকুপেশনাল হেল্থ সাইকোলজি’-তে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, কাজের ধরন সরাসরি ঘুমকে প্রভাবিত করে।
এই গবেষণার নেতৃত্ব দেন যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ড. ক্লেয়ার স্মিথ।
তিনি রিয়েলসিম্পল ডটকম’য়ে প্রকাশত প্রতিবেদনে বলেন, “স্বাস্থ্যকর ঘুম মানে শুধু ৭ থেকে ৯ ঘণ্টা ঘুমানো নয়। নিয়মিত ঘুম, ঘুম থেকে সন্তুষ্টি, দিনে সজাগ থাকা, জৈবিক সময়ের সঙ্গে ঘুমের মিল, কত দ্রুত ঘুমিয়ে পড়া যায় এবং মোট ঘুমের সময়- এসবই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।”
গবেষণায় পাওয়া তিন ধরনের ঘুমের অভ্যাস
প্রায় ১ হাজার কর্মজীবীর তথ্য বিশ্লেষণ করে গবেষকরা ঘুমের তিনটি ধরন শনাক্ত করেছেন।
ভালো ঘুমের মানুষ: নিয়মিত সময়মতো ঘুমানো ও পর্যাপ্ত বিশ্রাম পাওয়া যায় যাদের।
অনিদ্রায় ভোগা মানুষ: কম সময় ঘুমানো, অস্থির রাত কাটানো, অনিয়মিত ঘুমের কারণে ঘুমের গুণগত মান নষ্ট হয়।
‘ক্যাচ-আপ’ ঘুমের মানুষ: সপ্তাহের কাজের দিনে ঘুম কম হয়। আর সপ্তাহান্তে বা অবসরে দীর্ঘ ঘুম বা ঘুমের ঘাটতি পুষিয়ে নেওয়া হয়।
ড. স্মিথের মতে, “অনিদ্রা ধরনের ঘুমের সমস্যায় ভোগা মানুষরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। আর ‘ক্যাচ-আপ’ ঘুমানো মানুষরা তুলনামূলকভাবে ভালো ঘুম পান। তবে দীর্ঘমেয়াদে এরও নেতিবাচক প্রভাব থাকতে পারে।”
কোন ধরনের কাজ ঘুম নষ্ট করে
গবেষণায় দুই ধরনের কাজকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
- অফিসে বসে থাকা বা স্থির কাজ: সারাদিন চেয়ারে বসে থাকার মতো কাজ।
- অপ্রচলিত সময়সূচির কাজ: সন্ধ্যা, রাত বা সপ্তাহান্তে কাজ করতে হয় এমন পেশা।
ফলাফলে দেখা গেছে—
- স্থির কাজ করা মানুষেরা অনিদ্রার মতো উপসর্গে ৩৭ শতাংশ বেশি ভোগেন।
- অপ্রচলিত সময়সূচির কর্মীদের মধ্যে ঘুম ঘাটতি পুষিয়ে নেওয়ার ঝুঁকি ৬৬ শতাংশ বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যাশনাল স্লিপ ফাউন্ডেশন’-এর গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক-বিষয়ক জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি ড. জোসেফ জিয়েরজেউইস্কি বলেন, “খুব বেশি স্থির কাজ বা এমন কর্মক্ষেত্র যেখানে প্রাকৃতিক আলো নেই, সেগুলো ঘুমের ক্ষতি করে। আবার রাতের শিফট দেহঘড়িকে অস্বাভাবিক করে দেয়। ফলে ঘুম ও জাগরণের স্বাভাবিক সময় নষ্ট হয়।”
কানাডার ‘মেডভিডি’-এর মেডিকেল পরিচালক ডা. মাইকেল চিচ্যাক যোগ করেন, “দীর্ঘদিন ধরে রাতের শিফটে কাজ করলে ঘুমের অভাব তৈরি হয়, যা পরে নানান স্বাস্থ্য জটিলতার কারণ হতে পারে।”
যে কারণে কাজের ধরন ঘুমে প্রভাব ফেলে
স্নায়ুবিজ্ঞানী এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘ওয়েসপার’-এর প্রধান ঘুম বিশেষজ্ঞ ড. চেলসি রোরশেইব ব্যাখ্যা করেন, “দীর্ঘসময় বসে থাকা শরীরের রক্তসঞ্চালন কমিয়ে দেয়, পেশি শক্ত হয়ে যায় এবং মানসিক চাপ বাড়ায়। এগুলো ঘুমাতে সমস্যা তৈরি করে। আবার অনিয়মিত কাজের সময়সূচি দেহঘড়িকে বিঘ্নিত করে, ফলে মেলাটোনিন হরমোনের উৎপাদন কমে যায়।”
ঘুম ভালো রাখার সহজ উপায়
ড. স্মিথ বলেন, “অস্বাস্থ্যকর ঘুম সবার জন্য একরকম নয়। তাই সমাধানও সবার জন্য আলাদা হতে হবে।”
তবে কিছু সাধারণ উপায় মেনে চললে ঘুমের মান অনেক উন্নত হতে পারে।
শারীরিক নড়াচড়া বাড়ান
দিনে বসে কাজ করলেও নিয়মিত শরীরচর্চা জরুরি। হাঁটা, হালকা ব্যায়াম বা যোগব্যায়াম সবই ঘুমের জন্য সহায়ক। তবে শোয়ার তিন ঘণ্টা আগে ভারী ব্যায়াম এড়িয়ে চলা উচিত।
নিয়মিত ঘুমের সময় বজায় রাখা
প্রতিদিন প্রায় একই সময়ে ঘুমাতে যাওয়া ও জাগা দেহঘড়িকে সঠিক রাখে। রাতের শিফটে যারা কাজ করেন, তারা ‘ব্ল্যাকআউট’ পর্দা ব্যবহার করতে পারেন বা নীল আলো প্রতিরোধক চশমা পরতে পারেন।
প্রাকৃতিক আলোতে সময় কাটান
দিনভর জানালাহীন অফিসে থাকলে শরীরের ঘুম-জাগরণ চক্র নষ্ট হয়। তাই দিনের বেলা অন্তত কিছুটা সময় বাইরে প্রাকৃতিক আলোতে থাকা জরুরি।
সামাজিক যোগাযোগ বাড়ান
ডা. চিচ্যাকের মতে, “দিনের বেলা কম সামাজিক-মেলামেশার অভাব ঘুম ও মেজাজ দুটোকেই খারাপ করে। তাই অফিস শেষে বন্ধু বা সহকর্মীর সঙ্গে সময় কাটানো ঘুমের জন্য উপকারী।
ক্যাফিন নিয়ন্ত্রণ
ড. রোরশেইব বলেন, “ক্যাফিন শরীরের ঘুম আনার রাসায়নিক নিঃসরণ আটকে দেয়। তাই দুপুরের পর থেকে কফি বা চা না পান করাই ভালো।”
শোয়ার আগে স্ক্রিন এড়িয়ে চলা
ল্যাপটপ বা ফোন থেকে বের হওয়া নীল আলো মেলাটোনিন হরমোন কমিয়ে ঘুমাতে দেরি করায়। তাই রাতে স্ক্রিন থেকে দূরে থাকা এবং শান্তিপূর্ণ রুটিন তৈরি করা প্রয়োজন।
চাপ কমান
চাপযুক্ত কাজ শরীরে কর্টিসল হরমোন বাড়ায়, যা ঘুমকে বাধাগ্রস্ত করে। তাই ঘুমানোর আগে ধ্যান, ডিপ ব্রিদিং বা লেখা-লেখির মতো অভ্যাস চাপ কমাতে সাহায্য করে।
সুষম খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা
ড. রোরশেইব সতর্ক করে বলেন, “খাবারের অনিয়মিত সময়, রাতে ভারী খাওয়া বা অতিরিক্ত কফি সবই ঘুমের ক্ষতি করে।”
তাই দিনে নিয়মিত সময়ে হালকা ও সুষম খাবার খাওয়া উচিত।
মানসিক উদ্দীপনা বজায় রাখা
একঘেয়ে কাজ দিনে ক্লান্তি বাড়ায়, ফলে রাতে ঘুম নষ্ট হয়।
তাই বই পড়া, নতুন কিছু শেখা বা সমস্যা সমাধানের মতো মানসিক উদ্দীপক কাজে যুক্ত হওয়া দরকার।