গবেষকদের দাবি, বিষয়টি এমন এক জৈবিক পরিবর্তন ছিল, যা আগে কোনো উদ্ভিদের মধ্যে দেখা যায়নি। আর এটিই ভবিষ্যতে আলু তৈরির পথ খুলে দিয়েছে।
আধুনিক আলুর উৎপত্তি আসলে কোথা থেকে? শেষ পর্যন্ত সেই রহস্যের সমাধান করেছেন বিজ্ঞানীরা, যা বহু বছর ধরে গবেষকদের বিভ্রান্ত করে রেখেছিল।
নতুন এক গবেষণায় উঠে এসেছে, আলু উৎপত্তি ঘটেছে প্রায় ৯০ লাখ বছর আগে দক্ষিণ আমেরিকায়, প্রাচীন বুনো টমেটো ও টিউবার বা আলুর মতো গাছের মধ্যে প্রাকৃতিক সংকরায়নের মাধ্যমে।
গবেষণাটি প্রকাশ পেয়েছে বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল ‘সেল’-এ। এতে দেখা গিয়েছে, সংকরায়ন বা সহজ করে বললে দুটি উদ্ভিদের জিনের মিশ্রণের ফলে মাটির নিচে নতুন টিউবার তৈরি হয়েছে। এ টিউবারই ছিল আধুনিক আলুর শুরু।
গবেষকদের দাবি, বিষয়টি এমন এক জৈবিক পরিবর্তন ছিল, যা আগে কোনো উদ্ভিদের মধ্যে দেখা যায়নি। আর এটিই ভবিষ্যতে আলু তৈরির পথ খুলে দিয়েছে।
এ টিউবার পুষ্টি সংরক্ষণ করে ও গাছকে কঠিন পরিবেশেও টিকে থাকতে সাহায্য করে। এগুলো গাছকে প্রতি বছর নতুন করে গজাতে সাহায্য করে এবং বীজ ছাড়াও প্রজনন সম্ভব করে তোলে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিজ্ঞানভিত্তিক সাইট নোরিজ।
আজকের বিশ্বে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফসল আলু। তবে আলুর সঠিক উৎপত্তি বিজ্ঞানীদের কাছে এতদিন স্পষ্ট ছিল না। আলু দেখতে চিলির তিনটি বন্য উদ্ভিদ প্রজাতির মতো, যেগুলোকে ‘ইটিউবেরোসাম’ বলা হয়। তবে চেহারায় একরকম হলেও এসব ‘ইটিউবেরোসাম’ আসলে আলুর মতো টিউবার তৈরি করে না।
অন্যদিকে, জেনেটিক বা বংশগত দিক থেকে আলু টমেটোর অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, যার জন্য গবেষকরা আরও বিভ্রান্ত হয়েছিলেন। এ ধাঁধার রহস্য উন্মোচনের জন্য চাষ হয় এমন সাড়ে চারশ ধরনের আলু ও ৫৬ ধরনের বন্য আলুর আত্মীয়দের ডিএনএ বিশ্লেষণ করেছেন বিজ্ঞানীরা।
গবেষণায় উঠে এসেছে, প্রতিটি আলু প্রজাতির মধ্যে ‘ইটিউবেরোসাম’ ও টমেটো গাছের জিনের একটি সুষম মিশ্রণ রয়েছে। যার মানে, প্রথম দিকের বিভিন্ন আলু ছিল এই দুই ভিন্ন প্রজাতির গাছের প্রাকৃতিক সংকরায়নের ফল।
টমেটো ও ‘ইটিউবেরোসাম’ প্রজাতি আলাদাভাবে প্রায় ৫০ লাখ বছর ধরে বিবর্তিত হলেও এদের মধ্যে এত বেশি জেনেটিক মিল ছিল যে সংকর বংশ উৎপাদন সম্ভব হয়েছিল। এ বিরল ঘটনার ফলে প্রায় ৯০ লাখ বছর আগে প্রথম টিউবার বা আলুর জন্ম হয়।
টিউবার তৈরির জন্য দায়ী নির্দিষ্ট জিনগুলোকেও শনাক্ত করেছেন গবেষকরা। যার মধ্যে প্রধান জিনের নাম ‘এসপি৬এ’, যেটি টমেটোর কাছ থেকে এসেছে। জিনটি সুইচের মতো কাজ করে, অর্থাৎ গাছকে বলে দেয় কখন টিউবার গজানো শুরু করতে হবে।
‘আইট১’ নামের আরেকটি জিন এসেছে ‘ইটিউবেরোসাম’ প্রজাতির কাছ থেকে এবং জিনটি মাটির নিচের ডালপালাকে আকৃতি দেয়, যা টিউবার গঠন করে। এ দুই জিনের কোনো একটি না থাকলে টিউবার বা আলুর তৈরি হত না।
গবেষকরা বলছেন, এ বিবর্তন এমন সময়ে ঘটে যখন আন্দিজ পর্বতমালা দ্রুত উঁচু হচ্ছিল এবং সেখানে নতুন ও কঠিন পরিবেশ তৈরি হচ্ছিল। টিউবার গঠনের কারণে প্রাথমিক বিভিন্ন আলু গাছের টিকে থাকার জন্য বড় সুবিধা মিলেছিল, যা এদের কঠোর পর্বতীয় পরিস্থিতিতেও বেঁচে থাকতে সাহায্য করেছিল।
এসব টিউবার বীজ ছাড়াও নতুন গাছ গজাতে পারে বলে আলু দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে এবং বিভিন্ন ধরনের জলবায়ু বিশেষ করে ঘাসের মাঠ থেকে শুরু করে ঠান্ডা পর্বতীয় তৃণভূমি পর্যন্ত পরিবেশে টিকে থাকতে পেরেছিল। এ কারণেই আজকের দিনে আমরা আলুর এত বিচিত্র প্রজাতি দেখতে পাই।
এ গবেষণার প্রধান গবেষক সানওয়েন হুয়াং বলেছেন, “কীভাবে বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে জিনের মিশ্রণের ফলে সম্পূর্ণ নতুন বৈশিষ্ট্যের উদ্ভিদ জন্ম নিতে পারে ও বিবর্তনের নতুন পথ খুলে যেতে পারে তারই ইঙ্গিত দিয়েছে এ গবেষণা।
“অবশেষে আমরা এখন বুঝতে পেরেছি আলু কোথা থেকে এসেছে।”