“বিশেষজ্ঞরা সর্বসম্মতভাবে মতামত দিয়েছেন যে, জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে একটি আদেশ জারি করতে হবে,” বলেন তিনি।
হতে সংগৃহিত
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন প্রশ্নে গণভোট আয়োজন করতে একটি অধ্যাদেশ জারির ‘মতামত’ পাওয়ার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার সমাপ্তি ঘটার তথ্য দিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ সভাপতি আলী রীয়াজ।
বুধবার রাতে ঢাকার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শেষে আলী রীয়াজ এ অগ্রগতির কথা জানান।
তিনি বলেন, “আজ জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের তৃতীয় পর্বের আলোচনার ছিল পঞ্চম দিন। এর আগে আমরা যে চারবার বৈঠক করেছি, জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একটি গণভোট আয়োজন করতে হবে এবং সে বিষয়ে আমরা একমত।
“এই গণভোট কী কাঠামোর মধ্যে হবে এবং কবে হবে, সে বিষয়ে আলোচনা করে এক জায়গায় আসা যায় কিনা, সে চেষ্টা আমাদের।”
আলী রীয়াজ বলেন, “আমরা তৃতীয় পর্যায়ের এই আলোচনার প্রশ্নে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছি। বিশেষজ্ঞরা সর্বসম্মতভাবে আমাদের যে মতামত দিয়েছেন, জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় হিসেবে, সেটা হচ্ছে, একটি আদেশ জারি করতে হবে। ওই আদেশের মাধ্যমে গণভোট আয়োজন করতে হবে।”
রাষ্ট্র সংস্কারের যেসব প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে, সেগুলো সঙ্কলিত করে তার সঙ্গে বাস্তবায়নের অঙ্গীকারনামা যুক্ত করে ইতোমধ্যে জুলাই সনদের খসড়া চূড়ান্ত করেছে জাতীয় একমত্য কমিশন। কিন্তু এ সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে।
বিএনপিসহ কয়েকটি দল নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে এই সনদ বাস্তবায়নের কথা বলে আসছিল। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েক দল চাইছিল, নির্বাচনের আগেই এ সনদ বাস্তবায়ন হোক।
মূলত এ বিরোধ নিয়েই এক ধরনের অচলাবস্থা তৈরি হয়। এ অচলাবস্থা নিরসনে গণভোটের প্রস্তাব তোলে জামায়াতে ইসলামী ও সমমনা দলগুলো।
শুরুতে গণভোটের বিরোধিতা করলেও পরে সে অবস্থান থেকে সরে আসে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো।
এখন তারা বলছে, গণভোট হতে পারে, তবে সেটা হতে হবে সংসদ নির্বাচনের দিনেই; আলাদা ব্যালট পেপারে।
সবশেষ এমন পরিস্থিতি নিয়ে বুধবার বিকালে আলোচনায় বসে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
এদিন জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া কী, কিংবা গণভোট কবে কবে, সেই প্রশ্নে আগের সিদ্ধান্তেই অটল থাকে দলগুলো। তবে ‘জুলাই সনদ আদেশ’ নামে অধ্যাদেশ জারির প্রস্তাবে দলগুলো ইতিবাচক মনোভাব দেখায়।
সারাদিনের আলোচনায় দলগুলোর পক্ষ থেকে আসা নানা মতামত তুলে ধরতে গিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, “জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে একই দিনে পৃথক ব্যালটে গণভোট দেওয়ার প্রস্তাব এসেছে। আবার জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট করার মত এসেছে কয়েকটি দলের কাছ থেকে।
“এ বিষয়ে কমিশন মনে করছে, কার্যত এক ধরনের ঐকমত্য আছে, জাতীয় জুলাই সনদ ২০২৫ বাস্তবায়নে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত সংবিধানের মৌলিক কাঠামোগত পরিবর্তনের ক্ষমতা দিতে হবে।”
তিনি বলেন, “দল এবং জোটগুলোর পক্ষ থেকে এই মত দেওয়া হয়েছে যে, দলগুলোর এবং বিশেষজ্ঞদের মতামতকে বিবেচনা করে যেন ঐকমত্য কমিশন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং সরকারকে সে বিষয়ে স্পষ্ট পরামর্শ দেয়।
“ঐকমত্য কমিশন এই প্রেক্ষাপটে বিশেষজ্ঞদের মতামত, গত পাঁচ দিন ধরে আপনাদের যে মতামত, বিশেষত আজকের যে মতামত, সেগুলোকে সমন্বিত করে আমরা আগামী দুই-এক দিনের মধ্যে আলোচনা করে সরকারকে পরামর্শ দেব।”
আলী রীয়াজ বলেন, এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা অংশগ্রহণ করেছেন, সমস্ত রাজনৈতিক দল এবং জোটগুলোকে এ বিষয়ে আমরা অবহিত করব। আজ সামগ্রিকভাবে সারা দিনের কার্যাবলীর মধ্য দিয়ে আমরা এই জায়গায় উপনীত হয়েছি।”
তিনি বলেন, “কমিশনের পক্ষ থেকে আমরা চাই, যেন আগামী ১৫ তারিখের মধ্যে সম্ভব হলে না হলে সর্বোচ্চ ১৬/১৭ তারিখের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে, এই যে ঐতিহাসিক দলিল আমরা সকলে মিলে তৈরি করেছি, বিশেষত আপনারা তৈরি করেছেন, সেটির যেন একটি স্বাক্ষর অনুষ্ঠান হয়। এই সাক্ষর ছাড়াও আমাদের দিক থেকে আমরা একটা পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করব।”
এদিন আলোচনার শুরুতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন,”জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় সময়টার জন্য সংসদের স্বাধীনতা থাকতে হবে। সনদটা গ্রহণ করা হয়ে গেলে, সংবিধান সংশোধনী হয়ে গেলে তার ভিত্তিতে তো পার্লামেন্টের দ্বিতীয় কক্ষ করাই যাবে।
বিএনপির এ নেতা বলেন, “জুলাই সনদ প্রণয়ন প্রক্রিয়ার অধ্যায় শেষ হয়ে গেছে। এটা আমরা যে যেভাবে সম্মত হয়েছি, আমরা সেখানেই থাকি, নয়তো আমাদের জন্য একটু অসুবিধা হতে পারে।”
তিনি বলেন, “আমরা বলেছি, আমরা যে যেভাবে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছি, সেটা বিবৃতি থাকতে হবে এবং অঙ্গীকারনামায় একটা দফাযুক্ত থাকতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে ইশতেহারে সেগুলো তুলে ধরে যদি জনগণের ম্যান্ডেট প্রাপ্ত হয়, তারা সে মতো ব্যবস্থা নিতে পারবেন।”
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে সালাহউদ্দিন বলেন, “জুলাই সনদ আদেশটা প্রজ্ঞাপন আকারে যাবে এবং সেই প্রজ্ঞাপনের সূত্র ধরে যে গণভোটের আইনটা হবে, সেই আইনটা সেভাবে উল্লেখ থাকবে।
“প্রজ্ঞাপনে থাকবে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে জনগণের সম্মতি প্রয়োজন বিধায় এই গণভোট অধ্যাদেশ জারি করা হলো এবং এই গণভোটটা কীভাবে হবে, সেটার জন্য বিধিবিধান বিদ্যমান গণভোট আইন থেকে নেওয়া যায়, আরপিও থেকে নেয়া যায়। যেভাবে নির্বাচন কমিশনে ভোট পরিচালনা করে, সে সমস্ত বিধিবিধানগুলো প্রয়োজনে সরকার ইলেকশন কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করে বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা সেখানে দেওয়া হবে।”
গণভোট কবে হতে পারে, সে ব্যাপারে সালাহউদ্দিন বলেন, “কেউ তো আর সনদের বিপক্ষে বলবে না। সুতরাং সেই ফল আমরা অনুমান করতে পারি যে, জনগণ সংস্কার চায়; সব রাজনৈতিক দল সংস্কার চায়; জুলাই সনদের বাস্তবায়ন চায়।”
“যদি আমরা ধরে নিই, অনুমান করে নিই, তাহলে সেই গণভোটটা আগে হলেও যে ফল, নির্বাচনের দিনে হলেও একই ফল। তাহলে আগে আরেকটা নির্বাচনের আয়োজন করা এই জাতির পক্ষে এ সময়ের মধ্যে কী সম্ভব; অথবা প্রয়োজন কি আছে? এই দুটাই প্রশ্ন।”
আলোচনায় জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, “আমাদের দেশে জাতীয় নির্বাচনে নানা রকম ঘটনা ঘটছে অতীতে। নির্বাচন স্থগিত হয়, কোনো এলাকায় নির্বাচন স্থগিত হলে গণভোটের রায়, সে রায়ও তো স্থগিত হয়ে যাবে।
“এজন্য দুইটাকে একাকার করলে একটার বাক্যের সঙ্গে আরেকটার বাক্য মিলে যাবে। সুতরাং ইলেকশন যদি প্রশ্নবোধক হয়, তাহলে গণভোটের চার্টারও প্রশ্নবোধক হয়ে যাবে।”
তিনি বলেন, “জুলাই সনদ বাস্তবায়নে কিছুটা মতভিন্নতা থাকলেও পরে গণভোটের মাধ্যমে বাস্তবায়নে আমরা সবাই একমত হয়েছি । গণভোটের মাধ্যমেই জুলাই সনদকে করা হবে।”
তিনি বলেন, “গণভোটটি কখন হবে, এ নিয়েই কিছুটা দ্বিমত আছে। অনেকেই বলছেন, গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন একসঙ্গে হবে। আমরা বলেছি, না; গণভোট আলাদা বিষয়; জাতীয় নির্বাচন একটা আলাদা বিষয়। দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গণভোটটা হবে আমাদের যে সমস্ত সংস্কার, যেটাকে জুলাই সনদ হিসেবে, যেটা একটা প্যাকেজ হ্যান্ডেল করছি, সেটাকে নিয়ে গণভোট হবে। সুতরাং গণভোটটা আগেই হয়ে যাওয়া দরকার।”
