“আরপিও অনুযায়ী, এখন আমরা দেখব আচরণ বিধিতে কোনো পরিবর্তন আনতে হবে কি না,” বলেন আব্দুর রহমানেল মাছউদ।
সংগৃহিত
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আইন সংস্কারের শেষ ধাপে সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন পাওয়ায় স্বস্তিতে রয়েছে নির্বাচন কমিশন। রাষ্ট্রপতির সইয়ের পর জারি হবে এ অধ্যাদেশ; এখন কেবল আচরণ বিধিমালা চূড়ান্ত হওয়া বাকি রইল।
এবারের ভোটে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে নির্বাচনি আইনে। আদালত ঘোষিত ফেরারি আসামি ভোট করতে পারবে না—এমন বিধান রাখা হয়েছে।
দেড় দশক পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় যোগ হয়েছে সশস্ত্র বাহিনীর নাম; সেই সঙ্গে ‘না’ ভোট ফিরছে একক প্রার্থীর আসনে। সমভোট পেলে হবে পুনঃভোট, জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকে করতে হবে নির্বাচন, জামানত বাড়িয়ে করা হয়েছে ৫০ হাজার টাকা, দল আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা জরিমানা, আইটি সাপোর্টেড পোস্টাল ভোটিং পদ্ধতি, অনিয়মে পুরো আসনের ভোট বাতিল, এআইয়ের অপব্যবহার করলে নির্বাচনি অপরাধ হিসেবে গণ্য এবং হলফনামায় অসত্য তথ্য দিলে (ভোটে অযোগ্য এমন) নির্বাচিত হওয়ার পরও ব্যবস্থা নেওয়া যাবে—এমন একগুচ্ছ সংস্কার প্রস্তাব সংবলিত সংশোধিত আরপিওতে সায় দিয়েছে সরকার।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন অধ্যাদেশ, ২০২৫ এর খসড়ার নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন বৃহস্পতিবার দেয় উপদেষ্টা পরিষদ। ইসি যেসব প্রস্তাব পাঠিয়েছিল, তার সবগুলোই রাখা হয়েছে কি না তা অধ্যাদেশ হাতে পাওয়ার পর আনুষ্ঠানিকভাবে পর্যালোচনা করবে কমিশন।
আর সংশোধিত আরপিও আইন ধরে আচরণবিধির গেজেট প্রকাশের ব্যবস্থা নেবে নির্বাচন আয়োজনকারী সংস্থাটি। ইতোমধ্যে সংসদ নির্বাচনে দল ও প্রার্থীর আচরণবিধি, ২০২৫ খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে।
জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী, এখন আমরা দেখব আচরণ বিধিতে কোনো পরিবর্তন আনতে হবে কি না, এটা আমরা পরীক্ষা করব।”
তিনি বলেন, এরপর আরপিও’র সঙ্গে সমন্বয় রেখে আচরণবিধির প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করবে ইসি সচিবালয়।
ভোটের পথে সব ধরনের আইনি সংস্কার হয়ে গেছে। এখন ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের জন্য আনুষঙ্গিক সব ধরনের প্রস্তুতি চলছে। সামনে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করার কথা রয়েছে। রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসার, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাসহ আইনশৃঙ্খলা ও প্রশাসনিক বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা চলছে।
নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ বলেন, “সকল প্রস্তুতি আমরা গ্রহণ করছি। আইনশৃঙ্খলা, প্রশাসনিক রদবদল বা রিটার্নিং অফিসার, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাসহ সব বিষয়ে সাথে আলাপ করার পরে সিদ্ধান্ত হবে।
“…আরপিও শিগগির আমাদের হাতে এসে যাবে। আরও কোনো আইনি সংস্কার বাদ রইল না। আমরা ফেব্রুয়ারির রোজার আগে পার্লামেন্ট ইলেকশনের জন্য যা দরকার সেটার জন্য পুরা দমে প্রস্তুতি নিচ্ছি।”
এর আগে গত ৩০ সেপ্টেম্বর প্রতীক সংক্রান্ত নির্বাচন পরিচালনা বিধি সংশোধন করে ইসি। সংস্থাটির কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আরপিও সংশোধনের লক্ষ্য ঠিক করা হলেও তা বৃহস্পতিবার সরকারের সায় পেল। এখন কেবল আচরণ বিধিমালা চূড়ান্তের কাজ বাকি রইল।
আরপিওতে কী কী পরিবর্তন
২ নম্বর ধারায় এ সংশোধন এনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর নাম যুক্ত করা হয়েছে। ২০০১ ও ২০০৮ সালের ভোটে এমন বিধান ছিল। গত তিন নির্বাচনে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তায় ছিল ছিল সশস্ত্র বাহিনী। এবার সংশোধন হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা আরও দৃশ্যমান হতে পারে।
৮ নম্বর ধারা পরিমার্জন করে ভোটকেন্দ্র (পোলিং স্টেশন) প্রস্তুতের ক্ষমতা জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার হাতে রাখা হয়েছে।
৯ নম্বর ধারা পরিমার্জন করা হয়েছে; রিটার্নিং অফিসার কোনো ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করলে তা ইসিকে অবহিত করতে হবে।
১২ নম্বর ধারায় যুক্ত করা হয়েছে—কোনো আদালত ফেরারি বা পলাতক আসামি ঘোষিত হলে সংসদ সদস্য হওয়ার অযোগ্য হবে। ফলে পলাতক আসমি প্রার্থী হতে পারবেন না এবার।
সংশ্লিষ্ট নির্বাচনি এলাকার কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি বা অন্য কোনো পদে থাকলে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য হবেন।
কোনো প্রতিষ্ঠানের কাযনির্বাহী পদকে ‘লাভজনক’ পদের সংজ্ঞাভুক্ত করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের কাযনির্বাহী পদে থেকে নির্বাচন করার সুযোগ থাকছে না।
প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য সংক্রান্ত হলনামায় অসত্য তথ্যের প্রমাণ পেলে ভোটের পরেও ইসির ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা যুক্ত করা হয়েছে।
১৩ নম্বর ধারায় প্রার্থী হতে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে দেওয়া জামানতের পরিমাণ ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে। আগে এর পরিমাণ ছিল ২০ হাজার টাকা।
১৪ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, রিটার্নিং কর্মকর্তার আদেশে ক্ষুব্ধ হলে প্রার্থী বা ব্যাংকের পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা কোনো সরকারি সেবাদানকরী প্রতিষ্ঠানও আপিল করার সুযোগ পাবে।
১৯ নম্বর ধারায় ‘না’ ভোটের বিধান যুক্ত করা হয়েছে। কোনো আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী যদি একজন থাকে, তাহলে ব্যালট পেপারে ‘না’ ভোটের বিধান থাকবে। তবে দ্বিতীয়বার নির্বাচনের ক্ষেত্রে ‘না’ ভোট থাকবে না।
২০ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের জোটগতভাবে নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচন করার বিধান যুক্ত করা হয়েছে।
২১ নম্বর ধারা পরিমার্জন করে বলা হয়েছে—নির্বাচনী এজেন্ট নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনি এলাকার ভোটার হতে হবে।
২৫ নম্বর ধারায় প্রিজাইডিং অফিসারের ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে।
২৬ নম্বর ধারায় নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার না করার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ‘ইভিএমে ভোট দেওয়ার বিধান বিলুপ্ত’ করা হয়েছে।
২৭ নম্বর ধারায় পোস্টাল ভোটিংয়ের বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে। প্রবাসী, সরকারি চাকরিজীবি ও দেশের ভেতরে আটক ভোটারদের পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দেওয়ার বিধান করা হয়েছে।
২৯ নম্বর ধারার পরিমার্জন করে ভোটকেন্দ্রে প্রবেশের তালিকায় গণমাধ্যমকর্মীদের থাকার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।
৩৬ নম্বর ধারায় ভোট গণনার সময় গণমাধ্যমকর্মীদের উপস্থিত থাকার বিধান যুক্ত করা হয়েছে।
৩৭ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ভোটের দিন প্রিজাইডিং অফিসারের বাতিল করা সব ভোট কেন্দ্রে পরীক্ষা করা সম্ভব নয়; বিধায় বাধ্যবাধকতার পরিবর্তে ‘তিনি প্রয়োজন মনে করলে গণনা করতে পারবেন’ বিধানটি যুক্ত করা হয়েছে।
৩৮ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, সমভোট পেলে লটারির পরিবর্তে পুনঃভোট করা যাবে। আগে সমভোট প্রাপ্ত প্রার্থীদের মধ্যে লটারি করে একজনকে নির্বাচিত করার বিধান ছিল।
৪৪ নম্বর ধারায় প্রার্থীর নির্বাচনি ব্যয় ভোটার প্রতি ১০ টাকা হার ঠিক করা হয়েছে।
নির্বাচনি ব্যয়ের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলকে যুক্ত করে পরিমার্জন করা হয়েছে।
অনুদান হিসেবে পাওয়া অর্থের তালিকা বিস্তারিত ও সুস্পষ্ট করে ওয়েবসাইটে প্রকাশের বিধান যুক্ত করা হয়েছে।
নির্বাচন কর্মকর্তাদের বদলির বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শকের বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে।
৭৩ নম্বর ধারায় মিথ্যা তথ্য, অপতথ্য, গুজব ও এআই অপব্যবহার রোধে প্রার্থী ও দলের বিষয়ে অপরাধের বিধান যুক্ত করা হয়েছে।
৭৪, ৮১, ৮৭ ও ৮৯ নম্বর ধারায় ছোটখাট পরিমার্জন আনা হয়েছে।
দল নিবন্ধন ও আর্থিক অনুদানের বিষয় এবং নিবন্ধন স্থগিত হলে প্রতীক স্থগিতের বিষয় যুক্ত করা হয়েছে ৯০ নম্বর ধারায়।
৯১ নম্বর ধারায় অনিয়মের জন্য কেন্দ্রের ভোট বাতিলের পাশাপাশি প্রয়োজন হলে পুরো নির্বাচনি এলাকার ফল বাতিলের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে ইসিকে।
আচরণবিধি লঙ্ঘনে সর্বোচ্চ ছয় মাসের দণ্ডের পাশাপাশি সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। দলের ক্ষেত্রেও জরিমানার বিধান যুক্ত করা হয়েছে।
জাতীয় নির্বাচনের সময় গণভোট প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য ও সরকারি সিদ্ধান্ত এলে ইসির কর্মপরিকল্পনায়ও পরিবর্তন আসতে পারে বলে জানান নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা।
